করোনায় ঘরে বন্দি প্রবাসীরা ‘আঙ্গিনা কৃষি’তে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন বিশ্বের রাজধানী নিউইয়র্ক সিটিতে। প্রতিটি বাড়ির আঙ্গিনা ভরে উঠেছে সবুজ-আবিষ্ট ভিন্ন এক আমেজে। এমন নির্মল পরিবেশ রচনার অবলম্বন হচ্ছে লাউ, বেগুন, শশা, টমেটো, পেপে, পটল, ঢেড়স, মরিচ,পালং শাক, পুঁই শাক, লাল শাক, কচুপাতা, পাটশাক, ধনেপাতা, গোলআলু, আদা, রশুন, হলুদ, লেবু, করল্লা, চিচিঙ্গা, ঝিঙ্গা উৎপাদন।
যাদের বাসার পেছনে সবজি উৎপাদনের জায়গা নেই, তারা বাসার বেলকনি অথবা জানালার সঙ্গে থাকা প্ল্যাটফরমে টব বসিয়ে সবজির বাগান করেছেন।
নিউইয়র্ক সিটিতে বাংলাদেশি ছাড়াও পাকিস্তানি, ভারতীয়, শ্রীলঙ্কান, নেপালিরাও আঙ্গিনা কৃষিতে বেশ ক’বছর ধরেই উজ্জীবিত। এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে টাটকা সবজির দাম আকাশ ছোঁয়া। গ্রোসারি কিংবা হাঁটাপথে ভ্রাম্যমান দোকানে পছন্দের যেকোনও সবজির প্রতি পাউন্ডের দাম কমপক্ষে ৫ ডলার করে। ৪ সদস্যের একটি পরিবারের জন্যে একবেলার সবজি ক্রয় করতে অন্তত ১০ ডলার লাগে। তবুও কর্মজীবী সকলেই সময় বিবেচনা করে খুব কম সময়েই আঙ্গিনায় সবজি চাষে মনোযোগ দিয়েছেন। ২৫ শতাংশ প্রবাসীর স্ত্রী শুধুমাত্র গৃহিনী হিসেবে বসবাস করায় তারাই শীত বিদায়ের পরই আঙ্গিনা কৃষিতে লিপ্ত হতেন। এবার একেবারেই ভিন্ন চিত্র। ৮৫ শতাংশ বাড়ির আঙ্গিনাতেই এবার সবজির চাষ হয়েছে। কুইন্সের জ্যামাইকা, কুইন্স ভিলেজ, রিগোপার্ক, ওজনপার্ক, রীচমন্ডহীল, জ্যাকসন হাইটস, উডসাইড, এস্টোরিয়া, এলমহার্স্ট, ব্রুকলিনের নিউকার্ক, চার্চ-ম্যাকডোনাল্ড, প্রসপেক্ট পার্ক, ব্রঙ্কসের পার্কচেস্টার প্রভৃতি এলাকায় প্রাইভেট হাউজের আঙ্গিনা এবং এপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের বেলকনি সবুজে ছেয়ে আছে। কোনও কোনও স্থানে ৩/৪ ফুট লম্বা লাউ ঝুলে থাকতেও দেখা যাচ্ছে। বড়বড় বেগুন ছাড়াও শশা, লেবু, করলা ঝুলে রয়েছে। প্রকৃতি যেন বাঙালিয়ানায় উদ্ভাসিত। যা করোনা ভীতিকেও ছাড়িয়ে যেতে সামান্য হলেও অবদান রাখছে।
নিউইয়র্ক অঞ্চলে রিয়েল এস্টেট এজেন্ট হিসেবে গত কয়েক বছরেই ব্যবসায় অধিক মুনাফার জন্যে ‘সেরা এজেন্ট’র পুরষ্কার পেয়েছেন মোর্শেদা জামান। নিউইয়র্ক মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মোর্শেদা জামান সারাক্ষণই কাজে ব্যস্ত থাকতেন। তার স্বামী কৃষিবিদ আশরাফুজ্জামান (যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের কৃষি বিষয়ক সম্পাদক) ও পেশাগতভাবে ব্যস্ততার পাশাপাশি সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে অবসর সময় ব্যয় করতেন। এই দম্পতি ৩০ বছর ধরে নিউইয়র্কে থাকেন। সেখানকার রিগোপার্কে চমৎকার একটি এলাকায় নিজস্ব বাড়িতে বসবাস করছেন। বাসার পেছনে গাড়ি পার্কিংয়ের সুপরিসর জায়গা ছাড়াও বেশ বড় একটি অংশ ফাঁকা। আগে কখনো চিন্তা করেননি যে, সেই জায়গায় সবজির চাষ করবেন। সময়ের অভাবে এটি কল্পনারও অতীত ছিল। কিন্তু এবার মধ্যমার্চেই নিউইয়র্কে লকডাউন ঘোষণার পর চ্যানেল আই টিভির শায়েখ সিরাজের ‘আঙ্গিনা কৃষি’ এ দম্পতিকে অঢেল এ সময়ে সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ করেছে বলে অকপটে স্বীকার করলেন এ সংবাদদাতার কাছে। তারা বললেন, ঘরে বন্দি থাকার পুরো সময়টি আমরা কাজে লাগিয়েছি বাসার পেছনের জায়গায় সবজি চাষে।
উল্লেখ্য, কৃষিবিদ আশরাফুজ্জামান নিউইয়র্কে একটি সফ্টওয়্যার কোম্পানির কর্মকর্তা হিসেবে ঘরে বসেই কাজ করছেন। এ সুবাদে স্ত্রীকে সবজি চাষে সহায়তা এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান কাজে লাগাচ্ছেন।
তারা বললেন, সবজির জন্যে প্রতিমাসে ৩০০ ডলারের অধিক ব্যয় হতো। মার্চ থেকে সেই অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে। মোর্শেদা উল্লেখ করেন, ‘শুধু তাই নয়, আত্মীয়-স্বজন এবং পরিচিতজনদেরও দিচ্ছি সবজি।’
আঙ্গিনা কৃষির প্রভাব পড়েছে সবজির বাজারেও। বিভিন্ন গ্রোসারিতে এবার টাটকা সবজির প্রতি পাউন্ডের দাম গড়ে দেড় ডলার করে কম। তবুও ক্রেতার অভাব বলে উল্লেখ করলেন ব্রুকলিন, জ্যাকসন হাইটস আর জ্যামাইকার কয়েকজন ব্যবসায়ী।
নিউইয়র্ক সিটিতে লকডাউনের প্রভাব এখনও কিছুটা রয়েছে। তবে জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ওষুধ ও খাদ্য-সামগ্রী ক্রয় ছাড়া বাসার বাইরে যাবার সুযোগ না থাকায় আঙ্গিনায় উৎপাদিত সবজিতেই প্রতিটি পরিবার খাবারের আয়োজন সেরেছেন। করোনাভীতি এখনও অব্যাহত থাকায় অনেকে অফিস-আদালত বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে না যাবার কৌশল গ্রহণ করেছেন। এ শ্রেণির প্রবাসীর বড় একটি অংশ নিকটস্থ নদী অথবা মোহনায় গিয়ে বড়শি অথবা জাল দিয়ে মাছ ধরছেন। এক ধরনের অবকাশ বলা যায় করোনা ভীতি থেকে নিজেদের অবমুক্ত রাখতে।
নিউইয়র্ক স্টেটের বাফেলো, আলবেনি, লং আইল্যান্ড এলাকাতেও আঙ্গিনা সবজি চোখে পড়ে এবং নারী-পুরুষ সকলেই সেই সবজি বাগানে পরিচর্যায় নিয়োজিত থাকতে দেখা যায়। এ কর্মসূচির সাথে প্রবাস প্রজন্মকেও সম্পৃক্ততার খবর আসছে। স্কুল-কলেজে লাগাতার ছুটি চলায় তাদেরও সময় কাটানোর স্বাস্থ্যসম্মত একটি অবলম্বন বলে বিবেচিত হচ্ছে সবজি উৎপাদন।
প্রসঙ্গত, সবজির চারা অথবা বীজ পাওয়া যায় বাংলাদেশি প্রতিটি গ্রোসারি স্টোরেই। আগের তুলনায় এবার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দামও বেশি নেওয়া হয়েছে।