দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ঠেকাতে মোটরসাইকেল শিল্পে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা পুনর্বহালের সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। অন্যদিকে ভ্যাট অব্যাহতি না দিলে নতুন বিনিয়োগ আসবে না, পাশাপাশি এই খাতে বিনিয়োগ হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশ আমলে নিয়ে প্রজ্ঞাপনের মেয়াদ বাড়াতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে নির্দেশ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানায়, সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে লকডাউন ও অর্থনৈতিক স্থবিরতায় দেশের শিল্প খাত সমস্যায় পড়েছে। জাতীয় এ দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের স্বার্থে এপিআই, রিএজেন্ট উৎপাদন, ফ্রিজ, এসি, কম্প্রেসার, লিফট ও মোবাইল উৎপাদনের ন্যায় স্থানীয় মোটরসাইকেল উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা আরও কিছু দিন বহাল রাখা প্রয়োজন। তা না হলে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
এতে আরও বলা হয়েছে, বর্তমানে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে গণপরিবহন এই ভাইরাস সংক্রমণের অন্যতম মাধ্যম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই গণপরিবহনের বিকল্প দ্রুতগামী ও নিরাপদ যানবাহন হিসেবে মোটরসাইকেল ব্যবহার হতে পারে। তাই কমমূল্যে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে মোটরসাইকেল সরবরাহ করার লক্ষ্যে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত মোটরসাইকেলে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা এ শিল্পের যথাযথ বিকাশ না হওয়া পর্যন্ত বহাল রাখা প্রয়োজন।
জানা গেছে, ২০১০ সাল থেকে মোটরসাইকেল শিল্প ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা ভোগ করে আসছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে দেশের অন্য সব শিল্পে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা বহাল রাখা হলেও মোটরসাইকেল শিল্পে তা প্রত্যাহার করা হয়। এর পর স্থানীয় শিল্পের স্বার্থে অব্যাহতি সুবিধা পুনর্বহাল করতে শিল্প মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করতে সুপারিশ করে। ট্যারিফ কমিশনও শিল্পের বর্তমান প্রেক্ষাপট তুলে ধরে অব্যাহতি সুবিধা পুনর্বহাল করতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করে। অর্থ মন্ত্রণালয় ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশের আলোকে ভ্যাট অব্যাহতির প্রজ্ঞাপনের মেয়াদ বাড়াতে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে এনবিআরকে নির্দেশ দিয়েছে।
এনবিআর সূত্র জানায়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনের যৌক্তিকতা খতিয়ে দেখতে কাজ শুরু হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এনবিআর চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ বিষয়ে আলোচনা করবেন। পরে অর্থমন্ত্রীর কাছে সামগ্রিক বিষয় তুলে ধরে সার-সংক্ষেপ পাঠানো হবে। অর্থমন্ত্রীর অনুমোদন পেলে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।
জানা গেছে, বর্তমানে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রানার অটোমোবাইল, যমুনা ইলেকট্রনিকস, নিউ গ্রামীণ মোটরস ও রোডমাস্টার মোটরসাইকেল উৎপাদন করছে। পাশাপাশি হোন্ডা, বাজাজ, হিরো, টিভিএসের মতো ব্র্যান্ড দেশে মোটরসাইকেল উৎপাদনে বিনিয়োগ করছে। সামগ্রিকভাবে এই বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় আট হাজার কোটি টাকা। বাজার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রতিবছরই মোটরসাইকেলে বাজার সম্প্রসারণ হচ্ছে। ২০১৮ সালে যেখানে ৪ লাখ ৯০ হাজার ৮৫৫ ইউনিট মোটরসাইকেল বিক্রি হয়েছে, সেখানে ২০১৯ সালে বিক্রি হয়েছে ৫ লাখ ৩৩ হাজার ৭৬০ ইউনিট। চলতি অর্থবছরে ৬ লাখ ইউনিট মোটরসাইকেল বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিবছরই স্থানীয় মোটরসাইকেল বিক্রি বাড়ছে।
মোটরসাইকেল ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (এমএমইএবি) তথ্যমতে, করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে লকডাউন ও অর্থনৈতিক স্থবিরতার কারণে দুই মাসে এ শিল্পে ক্ষতি হয়েছে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা। এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে এ খাতে বিনিয়োগকৃত আট হাজার কোটি টাকা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ার আশঙ্কা করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, এ শিল্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ৫ লাখ মানুষ। চলমান পরিস্থিতিতে এসব মানুষের জীবন-জীবিকা চালানো হুমকির মুখে। ফলে সরকারের প্রত্যক্ষ নীতি সহায়তা ছাড়া এ খাত টিকিয়ে রাখাই এখন দুরূহ হয়ে পড়বে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংগঠনটির সভাপতি হাফিজুর রহমান খান বলেন, ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা পাওয়ায় স্থানীয় উৎপাদনকারীরা কম দামে ক্রেতাদের মোটরসাইকেল দিতে পারত। এখন সেই সুবিধা প্রত্যাহার করায় দেশি মোটরসাইকেলের দাম বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া এবারের বাজেটে সরকার স্থানীয় শিল্পের ভ্যাট অব্যাহতি বাতিল করলেও সিকেডি মোটরসাইকেলের শুল্ক হার অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। এতে ট্যারিফ পার্থক্য কমে আসায় দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অসম প্রতিযোগিতায় পড়তে হয়েছে।
তিনি বলেন, কর্মসংস্থান ও শিল্পে বিনিয়োগ চাইলে স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে হবে, পাশাপাশি ঘন ঘন নীতি পরিবর্তন না করে মোটরসাইকেল শিল্পে দীর্ঘমেয়াদি নীতি প্রণয়ন করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।