শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৩১ অপরাহ্ন

‘আমেরিকান শতাব্দী’র অবসান কি আমেরিকাতেই!

হামিদ দাবাশি
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০
  • ২৪৪ বার

আমেরিকা-যুগ কি ফুরিয়ে এসেছে? মার্কিন পরাশক্তি কি কার্যত ব্যর্থ হয়ে পড়েছে? আমরা কি তাহলে পরবর্তী বিম্বে পা রাখছি? আশির দশকের শেষের দিকে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তা ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা বড় আড়ম্বরে ঘোষণা করেছিলেন, ‘ইতিহাসের অবসান ঘটেছে এবং আমেরিকাই উদার গণতন্ত্রের শিরোপাধারী।’ তিনি কি নিজের অজান্তেই আমেরিকান অধ্যায়ের অবসানের প্রতি ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য ছুড়ে দিয়েছিলেন?

এ ঘটনার আড়াই দশক পর, একের পর এক সমস্যায় বিপর্যস্ত ও ডোনাল্ড ট্রাম্প শাসিত আমেরিকাতেই মানুষ আমেরিকা-অধ্যায়ের অবসান নিয়ে কল্পনা-জল্পনা করছে। উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মার্কিন সাম্রাজ্যের অবসান নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। বাকি বিশ্ব কি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে, না এই অবসানের আসল অর্থ খুঁজতে বিস্ময়ভরা চোখে সামনের দিকে তাকাবে? এই অবসানে কি বড় কোনো ‘ধামাকা’ বয়ে যাবে, না একটু গোঙানির করুণ সুর উঠবে- তারা এখনো বুঝতে পারছে না। আমেরিকাতে আমাদের অবস্থানের সুবাদে বিনয়ের সাথে বলতে পারি, এভাবে ইতি টানার জন্যই কি কথিত ‘মুক্তবিশে^র শাসননীতি’র সূচনা হয়েছিল? বিশ্বজুড়ে আমেরিকার নিষ্ঠুর সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের কথা নাহয় বাদই দিলাম!

‘এ্যান্ড অব এ্যাম্পায়ার’ শীর্ষক সাম্প্রতিক এক নিবন্ধে প্রখ্যাত মার্কিন ঐতিহাসিক আন্দ্রে বেসিভিস যুক্তি তুলে ধরেছেন- কেন তিনি বিশ্বাস করেন যে, মার্কিন সাম্রাজ্যের সূর্য ডুবে গেছে। রাষ্ট্রের কাঠামোগত দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে তুমুল বিদ্রোহ এবং প্রধান শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়া বর্ণবাদের আগুন বিস্তীর্ণ জনপদ পুড়িয়ে দেয়ার পর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের একজন কড়া সমালোচক হিসেবে নিশ্চয় তার সিদ্ধান্ত নবরূপ লাভ করেছে। বেসিভিস পর্যবেক্ষণ করেছেন, ‘আমেরিকার রাজত্বের অবসান ঘটেছে। তাই এখন আর আভিজাত্যের অহঙ্কার করে মার্কিনিরা নিজেদের অনিবার্যতার কল্পকাহিনী বলবে, সেই সামর্থ্য তাদের নেই…। বিশ্বনেতৃত্বের কথিত অপরিহার্য শক্তি, আমেরিকান জনগণের মঙ্গলকামনা বিশে^র কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে। এই মঙ্গলকামনাই বর্ণবাদ, বৈষম্য ও অন্যান্য সমস্যা প্রতিনিয়ত ঘরে বসেই উসকে দিচ্ছে।’

নিবন্ধে বেসিভিসের দেয়া রূপরেখা ‘রাষ্ট্রের ভেতর বর্ণবাদ ও দারিদ্র্য সত্ত্বেও বিশ্বনেতৃত্বের করুণ ও ব্যর্থ প্রচেষ্টা’র বিষয়টিকে আমাদের সামনে স্পষ্ট করে তোলে। বিষয়টি পুরো বিশ্ব এমনকি অধিকাংশ মার্কিনির ভালো করেই জানা আছে। তবে সাম্প্রতিককালে, ট্রাম্পের শাসনামলে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় তার অন্যায় অবহেলা বিষয়টিকে আরো জোরালোভাবে স্পষ্ট করে তুলেছে।

এই আমেরিকা কি কখনো বিশ্বনেতা ছিল, না এত দিন তারা ‘বোকার স্বর্গে’ বসবাস করছিল? বিপর্যস্ত বিশ্বের নেতা হওয়ার নৈতিক অধিকার কি তাদের কখনো ছিল? ফুকুইয়ামার দম্ভপূর্ণ অযৌক্তিক উক্তি এবং বেসিভিসের বুদ্ধিদীপ্ত জোরালো চিন্তার আলোকে আমরা বুঝতে পারি- আমেরিকা অধ্যায় কখন শুরু হয়েছিল এবং কোথায় তার গন্তব্য।

কী ঘটেছিল ‘আমেরিকান শতাব্দী’তে?
আমেরিকা এক ব্যর্থ অভিজ্ঞতার নাম। খুব সম্ভবত, শুরু থেকেই এটি ব্যর্থ হওয়ার পথে এগোচ্ছিল। নেটিভ আমেরিকানদের গণহত্যা দিয়েই শুরু হয়েছিল আমেরিকা সৃষ্টির ধারণা। আফ্রিকান দাসত্বের মজবুত কাঁধে চড়ে এটি সামনে এগিয়ে চলে। গণহত্যা ও বর্ণবাদের ধারাবাহিকতায় এই ধারণা আরো প্রসার লাভ করেছে। অনেক দুঃখ-কষ্ট সয়ে যেসব অভিবাসী সাগর উপকূলে আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের সন্তানরাই এই বর্বরতার নেতৃত্ব দেয়। এভাবেই সাম্রাজ্যবাদীরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম এখানে আধিপত্য ধরে রেখেছে। এই অব্যাহত পাপের মূল্য তাকে দিতে হবেই!

আমেরিকা যে ব্যর্থ হচ্ছে- তা নতুন কোনো ধারণা বা সাম্প্রতিক আবিষ্কার নয়। ট্রাম্পের শাসনকালে, গত তিন বছর ধরে পুরো বিশ্বই এটি সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছে। ট্রাম্প নিজের অশ্লীল আচরণ এবং ভণ্ডামিই প্রকাশ করছেন না শুধু, বরং আরো গুরুতর কথা হলো, তিনি ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ অব্যাহত রেখেছেন- যা তিনি ক্ষমতা গ্রহণের আগেই বলেছিলেন। ট্রাম্পের বিষাক্ত বর্ণবাদ অন্য সব অন্যায়ের মতো ইউরোপ থেকেই আমেরিকায় এসেছে। সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের সাথে করে এসব অন্যায়ও নিয়ে এসেছিল। অবাক ব্যাপার হলেও সত্য যে, এই নীতির প্রতি কোটি আমেরিকানের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন রয়েছে। আর এটাই আমেরিকার সর্বনাশের কারণ।

প্রত্যেক রাষ্ট্র ও ভূখণ্ডের অদ্ভুত কিছু রাজনৈতিক রোগ আছে। যেমন, বিরক্তিকরভাবে মিসর সিসির জন্ম দিয়েছে, রাশিয়া পুতিনের, চীন শি’র, ভারত মোদির, ব্রাজিল বোলসোনারোর, মিয়ানমার অং সান সু চির, ইরান খামেনির, সিরিয়া আসাদের। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, সুপারপাওয়ার আমেরিকা এবং তার সাম্রাজ্যবাদী অন্যায়-ঔদ্ধত্যের চোরাগলি তাকে শূন্য গহ্বরে ঠেলে দিচ্ছে।
অবশ্য, আমেরিকা অধ্যায়ের অবসান নিয়ে খোলামেলা আলোচনা ট্রাম্পকে উত্তেজিত করে তুলেছে। ডেভিড এ ম্যাসনের ‘দ্য এ্যান্ড অব দ্য আমেরিকান সেঞ্চুরি’ (২০০৯) এ বিষয়ক বিশ্লেষণধর্মী নিবন্ধের একটি আদর্শ উদাহরণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাথে সূচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও বৈশ্বিক আগ্রাসনের বিভিন্ন ধাপ সেই বিশ্লেষণে আমরা দেখতে পাই। তার নিবন্ধে, জর্জ প্যাকার মার্কিন কূটনীতিক রিচার্ড হলব্রুকের জীবনকালকে (১৯৪১-২০১০) ‘মার্কিন সাম্রাজ্যের সোনালি অধ্যায়’ হিসেবে অবহিত করেছেন। এরপর পতনের ঘণ্টা বাজতে শুরু করে। এ দিকে মার্কিন রাজনীতির চতুর সাম্রাজ্যবাদীরা অন্য চিন্তায় ব্যস্ত ছিল তখন। ’৯০ এর দশকের শেষের দিকে, ‘দ্য প্রজেক্ট ফর দ্য নিউ আমেরিকান সেঞ্চুরি’ (পিএনএসি) ছিল ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক একটি সংস্কারবাদী প্রকল্প। তারা মার্কিন নেতৃত্বাধীন নব্য রক্ষণশীল ও নব্য-উদার প্রকল্পগুলোকে নিশ্চিতরূপে বিজয়ী ঘোষণা করেছিল। এটিকে তারা ‘আমেরিকার বিশ্ব-নেতৃত্ব’ বলে প্রচার করেছিল- তাদের ইচ্ছে মতো। উইলিয়াম ক্রিস্টল ও রবার্ট কাগানের নেতৃত্বাধীন পিএনএসির সেই সব লোক তাদেরই বিভ্রান্তির কারণে আজ মানুষের হাসির খোরাক।

তাদের বেশির ভাগ লোক ছিল কট্টর ইহুদিবাদী। তারা ইসরাইলের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থকে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে রূপান্তরিত করে দিয়েছিল এবং এটিকেই তারা ‘নতুন আমেরিকান অধ্যায়’ বলে অভিহিত করেছিল। তাদের কুৎসিত মুখোশ খসে পড়ার আগেই তারা জর্জ বুশ ও ডিক চেনিকে অলীক ভবিষ্যদ্বাণীর জোরে আয়ত্তে নিয়েছিল। ফলে তারা ‘মার্কিন নেতৃত্ব’-এর অলীক মিথ প্রচার করে ইরাকের মতো একটি সুন্দর দেশকে অন্যায় আগ্রাসন চালিয়ে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়।
খাঁটি আমেরিকান, মার্টিন কাপলান তার প্রবন্ধে ‘ট্রাম্প অ্যান্ড দ্য এ্যান্ড অব দ্য আমেরিকান সেঞ্চুরি’ (২০১৭) মার্কিন সাম্রাজ্যের পতনে শোক প্রকাশ করেছেন। ট্রাম্পের নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের সবাইকেই যুক্তরাষ্ট্রের অপ্রত্যাশিত ও দুঃখজনক চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে হবে। ঐতিহাসিক, গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে তাদের নেতৃত্ব ত্যাগ করতে হবে। এই কাজ বহির্বিশ্বের সাথে খোদ যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরের মানুষদেরও করতে হবে।’ তবে বহির্বিশ্বের লোকজন হয়তো ভাবছেন, এটা কখন এবং কিভাবে সম্ভব!

মার্কিন সব শাসকই দেশের ভেতরে ও বাইরে যত অযোগ্যতার আখড়ায় পরিণত হয়েছে। সেই দীর্ঘ বিভ্রম-ইতিহাসের সমাপ্তিতে শোক প্রকাশ করার মতো কিছু আছে বলে মনে করি না।

আমেরিকান শতাব্দীর পরবর্তী বিশ্ব
মাত্র ২০ বছর আগে, ক্লিনশেভ করা নিউ কনজারভেটিভ গুণ্ডারা ভেবেছিল, তারাই আগামী বিশ্ব শাসন করতে চলেছে। ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণের তিন বছর পর, আজ চরম বিপর্যস্ত, জনস্বাস্থ্য খাতের ব্যর্থতা কোটি মানুষকে মারাত্মক মহামারীর দিকে ঠেলে দিয়েছে। আর এ কারণেই রাষ্ট্রের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ছে এবং মানবাধিকারের সাথে তাদের স্বপ্নগুলোও টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। আমেরিকায় গেড়ে বসা বর্ণবাদের মূলোৎপাটনের দাবিতে অনেক বিক্ষোভ হচ্ছে। ওরিগন, সিয়াটল, ওকল্যান্ড, শিকাগো ও নিউ ইয়র্কের সড়কগুলোতে গুয়াতেমালা ও চিলির সামরিক অভ্যুত্থানের দৃশ্যের অবতারণা হচ্ছে। অন্য দিকে ইতর স্বৈরাচারী আমেরিকান বর্ণবাদ আমাদের বিশ্বাস করাচ্ছে যে, এসব অভ্যুত্থান কেবল এশিয়া, আফ্রিকা কিংবা লাতিন আমেরিকাতেই হওয়া সম্ভব! তা ছাড়া প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের পোস্টাল সিস্টেম ভেঙে দিয়ে প্রহসনের মাধ্যমে আবার নির্বাচিত হওয়ার ফন্দি আঁটছেন। বিশ্বব্যাপী মার্কিন আগ্রাসন, সামরিক বাহিনীর নিষ্ঠুরতা এবং মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি অবজ্ঞাগুলো আজ ষোলকলায় পূর্ণতা পাচ্ছে এবং এসব অন্যায় যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেই বুমেরাং হচ্ছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামার অনুসরণ করে ট্রাম্প ও তার রিপাবলিকান অনুসারীরা ভোটারদের দমিয়ে পুনরায় নির্বাচিত হওয়া নিশ্চিত করতে ডাক ব্যবস্থাকে ‘হাঁটু গেড়ে’ বসিয়েছেন এবং যুক্তরাষ্ট্র এক প্রহসনের নির্বাচন করতে যাচ্ছে। যেমনটি অতীতে আমরা মিসর, সিরিয়া ও ইরানে দেখেছি।

বিপরীত প্রক্রিয়া হিসেবে, আমেরিকা-পরবর্তী বিশ্ব খোদ আমেরিকাকেই তার ভণ্ডামি থেকে মুক্ত করবে। মার্কিনিদের তারা আগলে নেবে মানবতার প্রশস্ত বুকে। আমেরিকা কেবল তখনই মুক্তি পাবে, যখন সে তার দীর্ঘ বর্ণবাদের ইতিহাসের সাথে বোঝাপড়া করবে এবং সব বর্ণবাদী প্রতিষ্ঠান ভেঙে দেবে। আজ উপকূল থেকে উপকূলে বিদ্রোহের দাবানল জ্বলছে। বিদ্রোহীরা বলছে, আসল আমেরিকানদের চাপাপড়া স্বপ্নগুলোর পুনরুদ্ধার করা এবং সাম্রাজ্যবাদী অহঙ্কারের দুর্গ মাটিতে মিশিয়ে দেয়াই তাদের লক্ষ্য।

লেখক : যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির ইরানিয়ান স্টাডিজ ও কম্পারেটিভ লিটারেচারের অধ্যাপক।

‘আলজাজিরা’ থেকে অনুবাদ ইজাজ নাজিম

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com