বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ পদে নিয়োগ দেওয়া হয় সরকারের পছন্দ মাফিক। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ দুই পদস্থ গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারকারী ব্যক্তির প্রতি নমনীয়। রাজনৈতিক প্রভাবের কাছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। আবার ঋণখেলাপিদের সুযোগ দেওয়ার জন্য বদলে ফেলা হচ্ছে আইন। এতে ব্যাংকে জনগণের টাকা সরাসরি নয়ছয় হচ্ছে। অন্যদিকে মূলধন সংকটে পড়া সরকারি ব্যাংকগুলোকে জনগণের করের অর্থ জোগান দেওয়া হচ্ছে।
গতকাল মঙ্গলবার ‘ব্যাংকিং খাত তদারকি ও খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ : বাংলাদেশ ব্যাংকের সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এসব মন্তব্য করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এবং উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের। গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলম।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর, খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গভর্নর নিয়োগবিষয়ক অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হলেও বাংলাদেশ ব্যাংকে সরকারের পছন্দ মাফিক গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয়। এমনকি বিভিন্ন সমালোচনা থাকা সত্ত্বেও একই ব্যক্তিকে গভর্নর হিসেবে পুনঃনিয়োগ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক অধ্যাদেশ সংশোধন করে গভর্নরের বয়সসীমা বৃদ্ধি করা হয়।
ব্যাংক খাতে নীতি পরিবর্তন করে একই ব্যক্তি ও পরিবারে হাতে ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাবে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করে এক পরিবার থেকে ২ জনের পরিবর্তে ৪ জন পরিচালক এবং দুই মেয়াদের ৬ বছরের পরিবর্তে ৩ মেয়াদে ৯ বছর পরিচালক থাকার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাবে চেয়ারম্যান বা পরিচালনা পর্ষদ নিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করা হয় এবং অনুগত প্রধান নির্বাহী নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী নিয়োগেও বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শ উপেক্ষা করা হয়। এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলোর দৃষ্টান্ত উপেক্ষা করে বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্ষদে তিনজন সরকারি কর্মকর্তা এবং দুজন সাবেক আমলা রাখা হয়েছে, যা পরিচালনা পর্ষদের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরোপের ঝুঁকি সৃষ্টি করে।
গবেষণায় বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি কার্যক্রমে অভ্যন্তরীণ সুশাসনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে নেতৃত্বের সক্ষমতায় ঘাটতি অন্যতম হিসেবে উঠে এসেছে। বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতসংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারকারী গ্রুপের চাপের কাছে গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদের নমনীয়তা লক্ষণীয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর সরকারের হস্তক্ষেপ করার চেষ্টার বিপরীতে সরকারের চাপের কাছে নতিস্বীকার না করে গভর্নরের পদত্যাগের দৃষ্টান্ত থাকলেও বাংলাদেশে তা অকল্পনীয়। পাশাপাশি জনবল সংকটের কারণে তদারকি কার্যক্রমকে সীমাবদ্ধ করে এবং অনিয়ম-দুর্নীতি চিহ্নিত করতে বিলম্ব হয়। আবার পরিদর্শন দলের ক্ষমতা হ্রাস করায় পরিদর্শন কার্যক্রমকে মন্থর করে এবং ব্যাংকিং খাতের অনেক অনিয়ম-দুর্নীতি ও জালিয়াতির ঘটনা উদঘাটনে বিলম্ব হয়। জনবল ঘাটতির কারণে পর্যালোচনা প্রতিবেদন প্রেরণেও বিলম্ব হয়।
রাজনৈতিক প্রভাব, নিয়ন্ত্রণের দুর্বলতা ও আইনগত সুবিধা দিতে প্রতিনিয়ত খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে। ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বরে যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। আলোচ্য দশ বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪১৭ শতাংশ। এর বাইরে পুনঃতফসিল করে নিয়মিত করা হয়েছে আবার অবলোপন করে হিসাব থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ। পুনঃতফসিলের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ আদায় না করেই গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ কমিয়ে চলতি বছরে মার্চ পর্যন্ত ৯২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ হিসেবে দেখানো হয়। ঋণখেলাপিদের বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদান ও খেলাপি ঋণ কম দেখাতে বিবিধ কৌশল অবলম্বন সত্ত্বেও জুনে খেলাপি ঋণের পরিমাণ পুনরায় বেড়ে দাঁড়ায় ৯৬ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। অথচ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের কারণে সৃষ্ট মূলধন ঘাটতি মেটাতে ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত সরকার কর্তৃক ১২ হাজার ৪৭২ কোটি ৮৭ লাভ টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়। ব্যাংক খাতে এ সংকটের মধ্যেও শুধু রাজনৈতিক কারণে নতুন ১৪টি লাইসেন্স দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ব্যাংকের জমানো অর্থের মালিক জনগণ। কিন্তু জনগণের স্বার্থকে পাশ কাটিয়ে ঋণখেলাপিরা এ অর্থ ভোগদখলে সুযোগ পেয়েছে। ব্যাংক মালিক, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সরকার- এ তিন পক্ষও ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ যে জনগণের সম্পদ সেটি ভুলে গিয়ে লুটপাটকারী তথা ঋণখেলাপিদেরই ক্রমাগতভাবে সুযোগ করে দিচ্ছে। অনেক সময় তারা ঋণখেলাপি, জালিয়াতিকারী, অর্থ আত্মসাৎকারী ও অর্থ পাচারকারীদের সহায়ক শক্তি হিসেবেও ভূমিকা পালন করছে। তিনি বলেন, যেই বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব জনগণের আমানত তদারকি এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করা- তারাও নেতৃত্বের অদক্ষতা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং ঋণখেলাপিদের চাপের কাছে নতিস্বীকার করে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অকার্যকর একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
ব্যাংক খাতের সংকট সমাধানে ১০ দফা সুপারিশ করেছে টিআইবি। এর মধ্যে রয়েছে স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠন, ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬ ও ৪৭ ধারা সংশোধন, গভর্নর, ডেপুটি গভর্নর, পরিচালক নিয়োগে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা, পরিবারিক আধিপত্য কমাতে আইন পরিবর্তন, রাজনীতিতে যুক্তদের পরিচালক না করা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন সংশ্লিষ্ট জনবল বাড়ানো এবং ব্যাংকে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি ও বাস্তবায়নে সংঘটিত অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।