মহীয়সী মাদার তেরেসা একবার বলেছিলেন, ‘কেবল সেবা নয়, মানুষকে দাও তোমার হৃদয়। হৃদয়হীন সেবা নয়, তারা চায় তোমার অন্তরের স্পর্শ।’ এই অনন্য বাণী নিজের জীবন ও কর্মে প্রমাণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের মানুষের ভরসার একমাত্র আশ্রয়স্থল তিনি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা হিসেবে মানবতা সম্পর্কে ধারণা পাল্টে দিয়েছেন তিনি। তার দৃষ্টিভঙ্গি, সৃজনশীলতা, বোধ ও ভাবনায় রয়েছে রুচির ছাপ। তার চিন্তার সূক্ষ্মতা, দূরদর্শিতা নৈঃশব্দ্যের পথ বেয়ে অনন্য মাত্রা অর্জন করেছে। তার রাজনৈতিক কর্মজীবন প্রায় চার দশকেরও বেশি সময়ব্যাপী বিস্তৃত। দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি। বাংলাদেশের ইতিহাসে দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন করা প্রধানমন্ত্রী। বহু বাধা ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে সাহস ও সংগ্রামে উচ্চশিরে দাঁড়িয়েছেন তিনি।
দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে দেশে ফিরে এলেন বঙ্গবন্ধুর প্রথম সন্তান শেখ হাসিনা। আমাদের প্রিয় বড় আপা, পরিবারের কাছে হাসু আপা। দুর্ভাগ্য আমার, সেদিনের এই জনস্রোতের সাক্ষী আমি হতে পারিনি। যেমনটি হয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের তেজোদীপ্ত জনস্রোতের, ১০ জানুয়ারি আনন্দ উদ্বেলিত গণসমাবেশে। ১৭ মে ১৯৮১ আমি উচ্চশিক্ষার জন্য তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অডেসা শহরে ছিলাম। প্রযুক্তির এত উন্নতি তখন হয়নি বিধায় সোভিয়েত ইউনিয়নে সিএনএন এবং বিবিসি দেখা দুর্লভ ছিল। সামান্যটুকু দেখার সুযোগ হয়েছিল রাশিয়ান টিভিতে এক ঝলকের মতো। তবে বিবিসিতে শুনেছিলাম। ১৭ মে ১৯৮১ বঙ্গবন্ধুকন্যার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে প্রকৃতিও কেঁদেছিল। জাতির পিতার লাখ লাখ সন্তান, ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে আজকের জননেত্রীকে কাছে পেয়ে আনন্দ ও বেদনার অশ্রু ফেলেছিল। সে কান্নাই ছিল আশার আলো। জš§ যেমন প্রত্যন্ত গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায়, ঢাকায় বেড়ে উঠলেও তিনি এখনো একজন গ্রামীণ সাধারণ নারী তথা মায়ের মতো। তিনি এসেছিলেন বলেই আজ জাতির পিতার বাংলাদেশ ধাপে ধাপে ১৯৮১-এর ১৭ মে থেকে এ পর্যন্ত অন্ধকারের অমানিশা দূর করে আলোর পথে এগিয়ে যাচ্ছে। তার হাতেই শুরু হয় সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। এজন্য তাকে বঙ্গবন্ধুর মতো বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের কাছে ছুটে যেতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথ ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য তার গতি ছিল দুর্নিবার। তিনি জনগণকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন দেশ ’৭৫-পরবর্তী ’৯০ পর্যন্ত অবৈধ আইনে পরিচালিত হয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী ১৯৮১ সালের পর থেকে একদিনের জন্যও ভুলে যাননি, সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদ : ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ।’ তাই সুপ্রিম অথরিটি জনগণের কাছেই তিনি বারবার গিয়েছেন। রাজনৈতিক খেলার অংশ হিসেবে তিনি জেনেশুনে ও অনেক সময় নির্বাচনে গেছেন লাভ তারই হয়েছে, অর্থাৎ জনগণের দল আওয়ামী লীগ সুসংগঠিত হয়েছে। শুধু আন্দোলনের মাধ্যমে তার নেতৃত্বে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হননি এবং ক্ষমতা থেকে নামার পথও বাতলে দিয়েছিলেন। আর এভাবেই সামরিক শাসনের যবনিকাপাত ঘটল চিরতরের জন্য। শেখ হাসিনার জন্যই জে. মইনুদ্দীন, ড. ফখরুদ্দীনদের একই পরিণতি হয়েছিল। তিন জোটের রূপরেখা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা এবং বাস্তবায়নের অঙ্গীকার শুধু হয়েছিল জননেত্রীর জন্য। সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতি-নীতিও শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
১৭ মে ১৯৮১ তিনি একা এসেছিলেন। লাখ লাখ মানুষ তাকে স্বাগত জানিয়ে অশ্রুজলে বরণ করে নিয়েছিল। হয়তো বা ক্ষণিকের জন্য হলেও তিনি মা-বাবা, ভাই-বোন হারানোর ব্যথা ভুলেছিলেন- যা কখনো ভোলার নয়। যা তিনি প্রতিনিয়তই অশ্রুসিক্ত নয়নে স্মরণ করেন। সেদিন তিনি দেশের মাটিতে পা রেখেছিলেন একজন গণতন্ত্রকামী নেত্রী হিসেবেই শুধু নয়, একজন বিপ্লবী কমান্ডার হিসেবে। মানিক মিয়া এভিনিউর সেই জনসমুদ্রে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি ঘোষণা করলেন- ‘সব হারিয়ে আমি আজ এসেছি, বাংলার মানুষের মুক্তির সংগ্রামে অংশ নিতে। আমার আজ হারানোর কিছু নেই।’ এ যেন জাতির পিতার ৭ মার্চের ভাষণেরই পুনঃঅঙ্গীকার। যোগ্য পিতার সুযোগ্য কন্যা। তিনিই হলেন ইতিহাসের একমাত্র জগৎনন্দিনী এবং জনমদুঃখিনী রাষ্ট্রনায়ক।
জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। তার স্বপ্নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বাংলার মানুষ। আর আজকের বিজ্ঞান-প্রযুক্তির এই সময়ে আমাদের সংগ্রাম, মহান মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও বাঙালির চেতনার নির্ভরতার প্রতীক শেখ হাসিনা। আমরা বিশ্বাস করি, তার নেতৃত্বে একুশ শতক হবে বিশ্বের বুকে বাঙালির উত্থানের শতক, জেগে ওঠার শতক। তিনি বিরোধী দলের নেতার দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৮১ সাল থেকে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। জনগণের বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে শেখ হাসিনা প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৯৬-২০০১ সালে। ২০০৮ থেকে বর্তমানে চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত। বিশ্ব জনমতে, ২০১৮-তে ফোর্বস সাময়িকীর দৃষ্টিতে বিশ্বের ক্ষমতাধর ১০০ নারীর তালিকায় তার অবস্থান ছিল ২৬তম।
শেখ হাসিনা দেশের সামষ্টিক উন্নয়নে নিয়ত পরিশ্রম করেছেন। বঙ্গবন্ধুর কর্মপ্রেরণা নৈতিক শক্তিরূপে গেঁথে আছে জননেত্রীর মনে। তিনি কঠোর পরিশ্রমী ও স্বাপ্নিক। তার হাতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে। জনকল্যাণে দিনরাত কাজ করছেন। তিনি মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, অবকাঠামো, কর্মসংস্থান সৃষ্টি নিশ্চিত করার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ। তার শাসনামলে দেশের আর্থ-সামাজিক খাতে অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছে। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে তার সরকারের উল্লেখযোগ্য সাফল্যগুলো ছিল- ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা নদীর পানি চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি, যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ এবং খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। এ ছাড়া তিনি কৃষকদের কল্যাণমূলক কর্মসূচি এবং ভূমিহীন, দুস্থ মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি চালু করেন। ২০০৯-২০১৩ মেয়াদে শেখ হাসিনা সরকারের উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোর মধ্যে রয়েছে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ১৩,২৬০ মেগাওয়াটে উন্নীতকরণ, গড়ে ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন, ৫ কোটি মানুষকে মধ্যবিত্তে উন্নীতকরণ, চিকিৎসাসেবার জন্য সারাদেশে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন প্রভৃতি। ২০১৪ সালের পর বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতকরণ, ভারতের পার্লামেন্ট কর্তৃক স্থলসীমানা চুক্তির অনুমোদন, মাথাপিছু আয় প্রায় ২০০০ মার্কিন ডলারে উন্নীতকরণ, ৩৬ বিলিয়ন ডলারের ওপর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন শুরু ইত্যাদি।
মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণ ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য শেখ হাসিনা নিবেদিতপ্রাণ। তার দেশপ্রেম ও সুচারু সিদ্ধান্তের জন্য বাংলাদেশের অগ্রগতি বহির্বিশ্বে সুনাম অর্জন করছে। ইতোমধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখার জন্য বিশ্বের বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রতিষ্ঠান তার প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়েছে। তিনি অনন্য মানবিতকতার অধিকারী। সাধারণ দরিদ্র মানুষকে সহজে জড়িয়ে নেন- তাদের উদারভাবে সাহায্য করেন। শিল্প-সাহিত্য অনুরাগী শেখ হাসিনা দেশের মানুষের একমাত্র নির্ভরতার প্রতীক। একজন লেখক হিসেবে তার সুনাম রয়েছে। লিখেছেন অনেক বই, সম্পাদনা করেছেন বঙ্গবন্ধুর নিজের ডায়েরি এবং পাকিস্তান সরকার কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর ওপর নজরদারি, অত্যাচার এবং গোয়েন্দা রিপোর্টের অনেক প্রামাণ্য দলিল। তার রচিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’, ‘ওরা টোকাই কেন?’, ‘বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম’, ‘দারিদ্র্য বিমোচন, কিছু ভাবনা’, ‘আমার স্বপ্ন, আমার সংগ্রাম’, ‘আমরা জনগণের কথা বলতে এসেছি’, ‘সামরিকতন্ত্র বনাম গণতন্ত্র’, ‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’ প্রভৃতি। তাই এক কথায় বলতে গেলে তিনি একজন বহুমাত্রিক দার্শনিক।
রাজনীতি শব্দটার সঙ্গে কিছু তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ ঐতিহাসিকভাবে সংযোজিত হয়, যেমন পলিটিক্যাল ফিলোসফার, পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্ট ইত্যাদি। ইতোমধ্যে তিনি রাজনীতির দার্শনিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাজনীতির ভূমিকা এবং রাজনৈতিক আন্দোলনসহ রাজনীতির প্রতিটি কোনায় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে স্বচ্ছন্দ বিচরণ ও দক্ষতার ছাপ রেখেছেন। শেখ হাসিনার নাক, কান ও গলা রোগের ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসেবে তার কাছ থেকে অনেক শিখেছি। একটি কথা না বললেই নয়, আমরা নাক কান গলার চিকিৎসক কারও গলার গভীরে কাঁটা বিঁধলে সাধারণ অবচেতন অর্থাৎ অ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগ করে এন্ডোসকোপের সাহায্যে বের করি। তার কাছ থেকে শিখেছি গলার একটি অংশকে কীভাবে ওপরে ঠেলে দিয়ে কাঁটা বের করা যায়। আমার পেশাগত জীবনে এটি এক বড় অবদান। তা ছাড়া ঘধভধষ ফড়ঁপযরহম-এর মতো এক বিশেষ চিকিৎসা, আমি রোগীদের ওপর প্রয়োগ করে সেবার মান বৃদ্ধি করতে পেরেছি।
জননেত্রী শেখ হাসিনা গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি ও অগ্রগতিতে বিশ্বাসী এবং দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন তার জীবনের অন্যতম লক্ষ্য। উপমহাদেশের রাজনীতিতে তিনি অনন্য কণ্ঠস্বর। তার শির উন্নত। একজন অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে, সংসদ নেতা হিসেবে অসীম সাহস ও দৃঢ়তার সঙ্গে দেশের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। তার সমকক্ষ অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ বিরল। জাতির পিতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন বাস্তবায়নে বাংলাদেশ শেখ হাসিনার হাতেই সবচেয়ে নিরাপদ।
আজ ২৮ সেপ্টেম্বর তার জন্মদিন। তাকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই। সুস্থ কর্মজীবন কামনা করি। জয়তু জাতির পিতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুকন্যা। বহুমাত্রিক দার্শনিক, মাদার অব হিউমেনিটি শেখ হাসিনার জয় হোক। জয় বাংলা।
অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়