মাগুরার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এক অসাধারণ রায় দিয়েছেন। পর্নোগ্রাফি আইনের আওতায় বিচার করতে বসে নারী ভিকটিমের নাম-ধাম গোপন করেছেন। বাদী বা ভিকটিমের নাম দিয়েছেন ‘কল্প’। মাত্র ১৯-২০ বয়সেই হয়তো তিনি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চোখরাঙানির মধ্যে একটা সফল আইনি লড়াই দিয়ে বসলেন এবং জিতলেন। তাঁর মতো পরিস্থিতিতে হয়তো কত মেয়ে আত্মাহুতি দিয়েছেন। কিংবা পড়ালেখা বন্ধ করে খিল-আঁটা জীবন বেছে নিয়েছেন। কিন্তু আলোচ্য ‘কল্প’ তার কোনোটিই করেননি।
মাগুরার মামলাটির রায়টি সংক্ষিপ্ত। বাংলায় লেখা চার পৃষ্ঠার রায়টি পড়লাম। সাবেক প্রেমিকার নগ্ন ছবি মোবাইলে সংরক্ষণ করার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। সংক্ষেপে গল্পটি এ রকম: ছেলেটির সঙ্গে মেয়েটির একসময় প্রেমের সম্পর্ক ছিল। সেই প্রেম ভেঙে যায়। মেয়েটি নিজেই বলেছেন, তাঁর মেমোরি কার্ড থেকে ছেলেটি তাঁর ‘সব ছবি’ নিয়ে নিয়েছিলেন। প্রেমের সম্পর্ক বজায় থাকতে মেয়েটি শর্ত দিয়েছিলেন, লেখাপড়া শেষে উপযুক্ত হওয়ার পরে দুজনের বিয়ে হবে। সেটা ঘটেনি। অবশ্য সেটা আর কস্মিনকালেও ঘটবে না, তা তো হলফ করে বলা যাবে না।
তবে আসামিপক্ষের আইনজীবী যুক্তি দিয়েছেন, তাঁরা যে প্রেমিক-প্রেমিকা ছিলেন, সেটা তো উভয় পক্ষ স্বীকার করেছে। তাই প্রেমিকার এ ধরনের ছবি প্রেমিকের মোবাইলে থাকতেই পারে। তিনি তো সেটা বিতরণ করেননি। তবে বিচারক আসামিপক্ষের এই যুক্তি আইনের জোরে নাকচ করেছেন। বিচারক মো. জিয়াউর রহমান রায়ে লিখেছেন, ‘আইন তাকে ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) দেয়নি।’ কথাটি সত্য।
২০১২ সালের পর্নোগ্রাফি আইনে কোনো ধরনের সম্পর্ককে খাতির করা হয়নি। ছেলেটিকে দণ্ড দেওয়া হয়েছে ওই আইনের ৮ ধারার ৫ উপধারার ‘ক’ দফায়। এটি বলেছে, ‘কোন ব্যক্তি পর্নোগ্রাফি বিক্রয়, ভাড়া, বিতরণ, সরবরাহ, প্রকাশ্যে প্রদর্শন বা যে কোন প্রকারে প্রচার করিলে অথবা উক্ত সকল বা যে কোন উদ্দেশ্যে প্রস্তুত, উৎপাদন, পরিবহন বা সংরক্ষণ করাই শাস্তিযোগ্য।’ এই ‘যে কোনো উদ্দেশ্যে’ মোবাইলে সংরক্ষণের অভিযোগটিই এখানে প্রমাণিত হয়েছে।
আসামির বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ ছিল, তিনি ওই ছবি ভিকটিমের আত্মীয়স্বজনের কাছে, এমনকি ফেসবুকেও ছেড়ে দিয়েছিলেন। এটি প্রমাণিত হলে তাঁর শাস্তি আরও গুরুতর হতো।
ভিকটিম নিজেও তাঁর সাক্ষ্যে দাবি করেছিলেন, ছবি প্রকাশ করায় তিনি সমাজে মুখ দেখাতে পারেননি। তাহলেও স্ক্রিনশটের মতো কোনো আলামত আদালতের সামনে ছিল না। সে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। সে কারণে সাবেক প্রেমিককে দুই বছর জেল, এক লাখ টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও তিন মাস জেল খাটতে হবে। এক মাসের মধ্যে আপিলের সুযোগ অবশ্য থাকছে।
ভারত, ব্রিটেন, মধ্যপ্রাচ্যসহ অনেক দেশের আদালত অনেক আগেই নারী ভিকটিমের পরিচয় গোপন করে রায় দেওয়া শুরু করেছেন। আমাদের দেশ এই ধারা প্রচলনে পিছিয়ে আছে। তবে এখন থেকে এটা যাতে সারা দেশের আদালত মেনে চলেন, সেটা নিশ্চিত করার নানা পথ আছে। সব থেকে সহজ মনে হয়, সুপ্রিম কোর্ট যদি এই বিষয়ে একটি যথাযথ পরিপত্র জারি করেন। সব বিষয় তো আর রায়ে বলার দরকার নেই।
সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ বলছে, আপিল বিভাগের রায় হাইকোর্টসহ সব অধস্তন আদালতের জন্য এবং হাইকোর্টের রায় তাঁর অধস্তন আদালতের জন্য মেনে চলা বাধ্যতামূলক। সে কারণে মাগুরার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের ওই রায় মেনে চলতে অধস্তন আদালতের বিচারকদের ওপর কোনো বাধ্যবাধকতা তৈরি হবে না। অবশ্য এটা আইনি কথা। বাস্তবে আমরা বিশ্বাস করি, ‘কল্প’ রায়টি চোখ খুলে দেওয়ার মতো। সামনের দিনগুলোতে বিশেষ করে নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের বিচারকেরা উপযুক্ত ক্ষেত্রে নারী ভিকটিমদের ছদ্মনাম ব্যবহার শুরু করতে পারেন।
তবে সুপ্রিম কোর্টের তরফে এই বিষয়ে দিকনির্দেশনা-সংবলিত যথাযথ প্রশাসনিক পদক্ষেপ প্রত্যাশিত। তাঁরা এমন পদক্ষেপ না নিলে ‘কল্প’ নামকরণের ধারাটি সহজে প্রচলিত হবে না। অথচ নারীর মর্যাদা ও অধিকার রক্ষায় ধারাটি বেগবান হওয়া দরকার। আবার এটা কেবল বিচার বিভাগ একা পারবে না। বিচার বিভাগের নথিপত্রে গোপনীয়তা রক্ষা করলেই তো হবে না; পুলিশ বিভাগকেও সংবেদনশীল হতে হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এগিয়ে আসতে হবে। মাগুরার ভিকটিম মেয়েটি কিন্তু নিজে বাদী হয়ে থানায় মামলা করেছিলেন। এখন এই ধরনের মামলার এজাহার বা জিডি তো পাবলিক রেকর্ড। সুতরাং থানা বা অন্যান্য সংস্থার দ্বারা তাঁর নাম-পরিচয় বা কোনো তথ্যের অপব্যবহারের সুযোগ যাতে তৈরি না হয়, সেই বিষয়ে একটা নীতিমালার দরকার পড়বে।
তবে আইনপ্রণেতাদের ভাবতে হবে যে নাম ও ছবি প্রকাশ না করার বিধান কি বিশেষ আইনে থাকবে, নাকি সাধারণ আইনে ঢোকাতে হবে। কারণ আলোচ্য রায়টি পর্নোগ্রাফি আইনে। পর্নোগ্রাফি নারীর জীবনকে হুমকিগ্রস্ত করে। অথচ এই আইনেই কিন্তু নারী ভিকটিমকে সুরক্ষা দেওয়া হয়নি। তাই বিচারক যদি ছদ্মনাম ব্যবহার না-ও করতেন, তাহলে আইনের ব্যত্যয় হতো না—কিন্তু ভিকটিমের মর্যাদাহানির সুযোগ থাকত।
যৌন অপরাধের নারী ভিকটিমদের নাম, ছবি প্রকাশ না করার বিধান তিনটি বিশেষ আইনে আছে। কিন্তু তা দেশের বিচারিক আদালতের রায়ে প্রকাশ পেয়ে আসছে। কিন্তু গণমাধ্যমে ভিকটিমদের নামধাম প্রকাশ পাচ্ছিল। এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে আমরা এই রায়টি পেলাম।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ১৪ ধারা অনুযায়ী ভিকটিমের পরিচয় প্রকাশ পায় এমন কিছু প্রকাশ নিষিদ্ধ। মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন-২০১২ এর ৩৭(২) ধারা অনুযায়ী আদালতের অনুমতি ছাড়া ভিকটিম বা তাঁর পরিবারের কোনো সদস্যের নাম, ছবি বা তথ্য প্রচার নিষিদ্ধ। শিশু আইন ২০১৩ এর ৮১(১) ধারা অনুযায়ী শিশুর স্বার্থের পরিপন্থী এবং শিশুকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শনাক্ত করা যায়, এমন কোনো প্রতিবেদন, ছবি, তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। এই বিধানগুলো সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারকসহ সবার জন্যই প্রযোজ্য বলে প্রতীয়মান হয়। বরং আদালতই যদি মেনে চলেন, তাহলে তো ‘ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে’-র মতো একটা প্রতিকার আমরা ভাবতে পারি।
মাগুরার রায়টির কিছু পর্যবেক্ষণ গণমাধ্যমের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক। বিচারক লিখেছেন, ‘দু-একটি পত্রিকা ভিকটিমের নাম না লিখলেও বিবরণ এমনভাবে লিখছে যে সহজেই ভিকটিমকে শনাক্ত করা সম্ভব। কোনো কোনো মিডিয়া (প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও সোশ্যাল) আইনের এই বিধানকে তোয়াক্কা না করে নামসহ ভিকটিমের ছবি বা ভিডিও প্রকাশ করছে, যা শুধু অনৈতিক নয়, আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।’
আমরা আশা করব, বিষয়টি বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলসহ সংবাদমাধ্যম সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা গুরুত্বের সঙ্গে নেবেন। প্রচলিত আইনের যাতে ব্যত্যয় না ঘটে, সেদিকে তাঁরা সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন।
সিজেএম জিয়াউর রহমান তাঁর রায়ে লিখেছেন, ‘আমাদের মামলায় এই ভিকটিম সাহসী এবং দৃঢ়সংকল্প। হতাশা তাকে গ্রাস করতে পারে নাই। সে জন্যই তিনি লোকলজ্জা দূরে ঠেলে বিচারপ্রার্থী হয়েছে এবং আদালতে সাক্ষ্য প্রদান করায় সে সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।’
বিচারকও সাধুবাদ পাওয়ার দাবিদার। এই ধরনের রায়, প্রতিকার ও পর্যবেক্ষণ সাধারণত উচ্চ আদালত দিয়ে থাকেন। এই রায়ে তিনটি নতুনত্ব আছে। প্রথমত, পর্নোগ্রাফি আইনে বিধান না থাকা সত্ত্বেও নারী ভিকটিমের ছদ্মনাম ব্যবহারের নজির তৈরি করা। দ্বিতীয়ত, প্রকাশ্য আদালতে এই মামলার শুনানি না করা—এর ক্যামেরা ট্রায়াল করা। তৃতীয়ত, জরিমানার অর্থ ভিকটিম পেতে পারে বলে সিদ্ধান্ত দেওয়া। এর সমর্থনে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪৫ ধারাটি প্রয়োগ করা। ধারাটির আওতায় আদালত চাইলে কোনো মিথ্যা ফৌজদারি মামলার ভিকটিমকে মামলা চালানোর খরচসহ ক্ষতিপূরণ দানের নির্দেশ দিতে পারেন। কিন্তু এর প্রয়োগ খুবই বিরল। আমরা অনেক সময় মিথ্যা মামলা বন্ধে শোরগোল তুলি। সরকারি দল বা পুলিশের উদ্দেশে রাগ ঝাড়ি। কিন্তু দেশের প্রতিটি ক্রিমিনাল কোর্ট যদি চান, তাহলে তাঁরাই ভুয়া মামলায় অতিশয় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দিতে পারেন। তাই প্রার্থনা করব, এ ধরনের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪৫ ধারা সবাই মেনে চলুক।
মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক