ব্যাংকের বেশির ভাগ মেয়াদি ঋণই গত জানুয়ারি মাস থেকে আদায় হচ্ছে না। এতে ঋণের ওপর অর্জিত সুদ পুনঃবিনিয়োগ হিসেবে খাতায় যুক্ত হচ্ছে। এভাবে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধির বড় একটি অংশ সঞ্চিতি সুদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছে। ফলে প্রকৃত ঋণপ্রবৃদ্ধি কত তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বেশির ভাগ ব্যাংকই এখন নতুন বিনিয়োগে যাচ্ছে না। যেটুকু ঋণ দেয়া হচ্ছে তা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে। কারণ ঋণ আদায় হচ্ছে না। এতে ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি বাড়ছে পুঞ্জীভূত সুদ। সুদই আবার মূল ঋণের সাথে যুক্ত হচ্ছে। এতে ব্যাংকের মুনাফা বাড়ছে না। এটা ব্যাংক খাতের জন্য মোটেও ভালো ফল বয়ে আনবে না।
জানা গেছে, ঋণ পরিশোধ না করলেও খেলাপি করা যাবে না- কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রথমে জুন মাস পর্যন্ত এ সুযোগ দেয়া হয়। পরে তা তিন মাস বাড়িয়ে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করা হয়। ব্যাংকাররা জানান, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেশির ভাগ ঋণই আদায় হয়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের এমডি গতকাল শনিবার নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতিমালা শিথিল করার সময় ব্যাংকারদের সাথে কোনো আলোচনা করে না। নীতিমালা শিথিল করার পর ব্যাংকগুলোতে কী ধরনের প্রভাব পড়বে তা-ও পর্যালোচনা করা হয় না। শুধু ব্যবসায়ীদের কথা শোনা হয়। কিন্তু ব্যাংকিং খাত বেকায়দায় পড়ে গেলে ব্যবসায়ীদের কিভাবে ঋণ দেয়া হবে তা-ও চিন্তা করা প্রয়োজন ছিল।
ওই এমডি জানান, ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপিরা এমনিতেই ঋণ পরিশোধ না করার জন্য নানা ফন্দি খোঁজেন। একবার ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যে নীতিমালা শিথিল করা হচ্ছে, এতে ইচ্ছেকৃত ঋণখেলাপিরা আরো সুযোগ পেয়ে যাবেন। এর সাথে প্রকৃতপক্ষে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হননি এমন অনেক ব্যবসায়ীও সুযোগ পেয়ে গেছেন। তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালার দোহাই দিয়ে ঋণ পরিশোধ করছেন না।
ব্যাংকাররা আশা করেছিলেন, সেপ্টেম্বরের পর আর কোনো সময় বাড়ানো হবে না। কিন্তু ব্যাংকের কথা না ভেবে আবারো ব্যবসায়ীদের সুযোগ দেয়ার জন্য ঋণ পরিশোধের শিথিলতা তিন মাস বাড়িয়ে ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায় কার্যত এক বছর বন্ধ হয়ে গেল।
এতে দুই ধরনের সঙ্কট ব্যাংকের সামনে হাজির হয়েছে। প্রথমত, প্রকৃত ঋণ না বাড়লেও আপনা-আপনি ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংকিং খাতে বর্তমানে প্রায় ১০ লাখ কোটি টাকার পুঞ্জীভূত ঋণ আছে। প্রতি মাসেই এ ১০ লাখ কোটি টাকা ঋণের ওপর ৯ শতাংশ সুদ আরোপ করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধ করলে এতে সুদ আদায় হতো। সুদ সঞ্চিতি হতো না। কিন্তু ঋণ আদায় না হওয়ায় ১০ লাখ কোটি টাকা ঋণের ওপর ৯ শতাংশ হারে সুদ আরোপ হয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়ে যাচ্ছে। ফলে ব্যাংকিং খাতে ঋণের যে প্রবৃদ্ধি দেখানো হচ্ছে তা প্রকৃত না, কৃত্রিম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত আগস্টে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। প্রতি মাসে সঞ্চিতি ঋণের সুদ বাদ দিলে প্রকৃত ঋণ প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশও হতো কি না সন্দেহ রয়েছে। অথচ ঋণের প্রবৃদ্ধি দেখানো হচ্ছে ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ হারে। দ্বিতীয় সমস্যা হলো, প্রতি মাসেই আমানতকারীদের অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে। ব্যাংকের কাছে গ্রাহক যে পরিমাণ আমানত রাখেন তার প্রায় ৮৭ শতাংশই অন্য গ্রাহকদের ঋণ দেয়া হয়। এখন ঋণ আদায় না হলেও গ্রাহকদের আমানতের অর্থ ফেরত দিতে হচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনায় একধরনের টানাপড়েন শুরু হয়েছে। এটা কত দিন ব্যাংকগুলো টানতে পারবে তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সবমিলেই ব্যাংকিং খাতের প্রকৃত অবস্থা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। আবার টানা এক বছর ঋণ আদায় করতে না পারলে ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফাও থাকবে না। বেশির ভাগ ব্যাংকই লোকসানের মুখে পড়ে যাবে। তখন সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের কিভাবে সামাল দেয়া হবে তারও কোনো উত্তর নেই ব্যাংকগুলোর কাছে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবসায়ীদের মতো ব্যাংকারদেরও কোনো নীতিমালা দিয়ে মুক্তির উপায় বের করবে- এ প্রত্যাশা ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের। অন্যথায় ব্যাংকগুলোর টিকে থাকাই দায় হবে।