২০২০ সালে পেঁয়াজ নিয়ে ২০১৯ সালের মতো ‘সঙ্কট সৃষ্টি হবে না’ বলে ৪০০০ দিন বয়সী এই প্রবীণ সরকারের পক্ষ থেকে ৩৬৫ দিন আগে যে প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছিল প্রতিবেশী বন্ধু দেশের সরকারের নির্বাচনী স্বার্থের এক সিদ্ধান্তেই আমাদের সরকারের সেই প্রত্যয় ভেঙে খান খান হয়ে গেল কেন?
কারণ ভারতে তো আমাদের দেশের ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো বিরোধী দলের প্রার্থীবিহীন ও ভোটারবিহীন নির্বাচন বা ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের মতো নিশি রাতে ভোট কেটে নির্বাচনে জয় লাভের কোনো সুযোগ নেই। তাদের জনতুষ্টির মাধ্যমে ভোট ভিক্ষা করে নির্বাচনে জয়লাভ করতে হয়। গত বছর মহারাষ্ট্রের বিধান সভার নির্বাচনে জয়লাভের লক্ষ্যে ১৪ সেপ্টেম্বর পেঁয়াজের রফতানি মূল্য টনপ্রতি ৬০০ ডলার বৃদ্ধি করে ৮৫০ ডলার নির্ধারণের পরও বাংলাদেশের রফতানিকারকদের থামাতে না পেরেই ৩০ সেপ্টেম্বর ভারত পেঁয়াজ রফতানি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়ায় আমাদের ৩০০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ খেতে হয়েছিল। অবশ্য পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের সুফল হিসেবে বিজেপি মহারাষ্ট্রের নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল। চলতি বছর বিহার বিধানসভার নির্বাচনের কারণে আমাদের গত বছরের অনুরোধ প্রত্যাখ্যানপূর্বক বিনা নোটিশে গত ১৪ সেপ্টেম্বর ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ ঘোষণা করার সাথে সাথে দিল্লিতে আমাদের হাইকমিশনার অফিস ই-মেলের মাধ্যমে ওই সিদ্ধান্ত ঢাকাকে অবহিত করার আগেই আমাদের দেশের ‘গত বছরের করিৎকর্মা’ মুনাফাখোর আমদানিকারক, ব্যবসায়ী, আড়ৎদার ও খুচরা বিক্রেতারা ইন্টারনেটের গতিতে এ ব্যাপারে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া ও ভোমরা থেকে বিয়ানীবাজার পর্যন্ত দেশের সবাইকে সচেতন করে দেয়ায় একদিকে তারা সবাই দাম বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে।
অপর দিকে এক বছর আগে ৩০০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ ক্রয় করার তিক্ত অভিজ্ঞতায় ক্রেতারা যাদের হাতে টাকা ছিল তারা সরকারের আশ্বাসের ওপর আস্থা না রাখতে পেরে ৫/১০/২০ কেজি পেঁয়াজ ৮০/৯০/১০০ টাকা কেজি দরে ক্রয় করে আগামী তিন মাস কৃচ্ছ্র সাধনের মাধ্যমে ৩০০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ ক্রয়ের হাত থেকে বেঁচে গিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসতে থাকেন। বর্তমান শাসনামলে ২০১৫ সালে পেঁয়াজের কেজি হয়েছিল ৮০ টাকা আর ২০১৭ সালে হয়েছিল ১২০ টাকা। তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করায় ২০১৯ সালে পেঁয়াজের কেজি ৩০০ টাকা হয়ে রেকর্ড বুকে স্থান করে নিয়েছিল। সরকারকে শুধু নিজ দেশের নির্বাচনী বছর মনে রাখলেই চলবে না, ভারতের ২৯টি রাজ্যের মধ্যে কোন কোন রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচন আগামী তিন বছরে হবে সে হিসাবও রাখতে হবে। পরপর তিন বছর পেঁয়াজ সঙ্কট থেকে সরকার শিক্ষা না নিলেও জনগণ ঠিকই শিক্ষা গ্রহণ করায় সচ্ছল মধ্যবিত্ত শ্রেণী মে-জুন মাসে ৩০ টাকা কেজি দরে ৪০-৫০ কেজি করে পেঁয়াজ ক্রয় করে রেখেছিল। বাজারে দাম বৃদ্ধি না পাওয়া পর্যন্ত তারা বাজার থেকে পেঁয়াজ ক্রয় করে খাওয়ায় মজুদ পেঁয়াজে তাদের তিন-চার মাস চলবে। ধান কাটার মজুরি প্রদানের জন্য অনেক পেঁয়াজ চাষি তাদের পেঁয়াজ মে-জুন মাসেই বিক্রয় করতে বাধ্য হয়। নিম্নমধ্যবিত্তদের পেঁয়াজ ক্রয় করে রাখার ইচ্ছা থাকলেও করোনাভাইরাসের কারণে আয় রোজগার কমে যাওয়ায় তারা কম দামে পেঁয়াজ কিনে রাখতে পারেননি। এই ফটকাবাজারিতে সমস্যায় পড়েছেন স্বল্প বেতনভুক কর্মজীবীরা। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে ভারত সরকার ও দেশের ভোক্তাদের ওপর দোষ চাপাচ্ছে কেন?
‘দুর্গাপূজার শুভেচ্ছার নিদের্শনস্বরূপ’ পাঠানো ইলিশের খোঁটা দেয়া হচ্ছে। ১৪ ও ১৫ সেপ্টেম্বর ১০-২০ কেজি পেঁয়াজ একবারে ক্রয়ের জন্য ভোক্তাদের দোষারোপ করা হচ্ছে। যারা একবারে ১০-২০ কেজি পেঁয়াজ ক্রয় করেছেন, বাজার স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত তারা আর বাজারে আসবেন না। ফলে বাজারে ক্রেতার চাপ কম পড়বে এই বিষয়টি সরকারের মাথায় কেন ঢুকছে না? সিন্ডিকেট যেমন ১৪, ১৫, ১৬ সেপ্টেম্বর বাজারে হাহাকার সৃষ্টি করেছিল তেমনি ভোক্তারাও ১৭ তারিখ থেকে বাজারকে ক্রেতাশূন্য করেছে। যেমন বুনো ওল তেমন বাঘা তেঁতুল। গত ১২ বছর যাবৎ টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ক্যাসিনোবাজি, দখলবাজি, নিয়োগবাজি, ঘুষবাজি, ঠগবাজি ও ফটকাবাজারি করে দলীয় যে, লাখ লাখ সমর্থক কোটিপতি হয়েছেন তারা ১০-২০ কেজি পেঁয়াজ এক সপ্তাহে সাবাড় করে দিতে পারেন। কিন্তু করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ জনগণের হাতে অত টাকা নাই যে, ১০০ টাকা কেজি দরের ১০-২০ কেজি পেঁয়াজ এক সপ্তাহে সাবাড় করে দিয়ে আবার বাজারে আসবেন। পেঁয়াজের বাজার স্বাভাবিক না হলে সাধারণ জনগণ ১০-২০ কেজি পেঁয়াজেই ১০-১৫ সপ্তাহ চালিয়ে নেবেন। ’৭০ দশকে ঢাকা শহরের এক ভদ্র লোকের বাবুর্চি এক মাসের ছুটিতে যাওয়ার সময় যাকে বদলি দিয়ে গিয়েছিল সেই নতুন বাবুর্চি ‘এক মাসে পাঁচ কেজি পেঁয়াজ ক্রয়’ দেখিয়ে ছিল। পুরনো বাবুর্চি ফিরে এসে আগের মতো মাসে ২০ কেজি পেঁয়াজ খরচ দেখালে ওই ভদ্রলোক বাবুর্চিকে বলেছিলেন, তুমি যাকে বদলি দিয়েছিলে সে পাঁচ কেজি পেঁয়াজে মাস চালিয়ে নিতে পারলে তোমার ২০ কেজি লাগে কেন? ওই বাবুর্চির জবাব ছিল- ‘স্যার, ও গোটা পেঁয়াজটি রান্নায় ব্যবহার করত, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আমি সবটুকু ফেলে দিয়ে ভেতরের শাঁসটুকু রান্নায় ব্যবহার করে থাকি। ওই বাবুর্চি আরো তিন-চার মাস থাকলে আপনি মারাই যেতেন।
এবার দেখা যাক পেঁয়াজের বার্ষিক উৎপাদন, চাহিদা, আমদানি ও মজুদ সম্পর্কে কী তথ্য সরকারের ভাণ্ডারে আছে। গত ১৫ সেপ্টেম্বরের দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন গত ৯ সেপ্টেম্বর পেঁয়াজের বাজার, আমদানি ও মজুদ পরিস্থিতি নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তাতে বলা হয়েছে- বাংলাদেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২৫ লাখ টন। কৃষি বিভাগের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছর উৎপন্ন হয়েছে ২৫ লাখ ৫০ হাজার টন। সংরক্ষণজনিত ক্ষতি ছয় লাখ টন বাদে বাজারজাতযোগ্য দেশী পেঁয়াজের পরিমাণ ১৯ লাখ ৫০ হাজার টন।
আগস্ট পর্যন্ত আমদানি হয়েছে চার লাখ ৩৬ হাজার টন। বর্তমানে মজুদ আছে পাঁচ লাখ ২৫ হাজার টন। সরকারি তথ্যানুযায়ী দেশে উৎপন্ন ১৯ লাখ ৫০ হাজার টন এবং আগস্ট পর্যন্ত আমদানিকৃত চার লাখ ৩৬ হাজার টন এবং ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যদি ১৪ হাজার টন আমদানি হয়ে থাকে তাহলে পেঁয়াজের মোট পরিমাণ দাঁড়ায় ২৪ লাখ টন যা মোট চাহিদার চেয়ে মাত্র এক লাখ টন কম। গত ১৮ সেপ্টেম্বর দৈনিক পত্রিকার রিপোর্ট থেকে জানা যায়- দেশে প্রতি মাসে এক লাখ ৭৫ হাজার টন পেঁয়াজের প্রয়োজন হয়। তাহলে মজুদ পাঁচ লাখ ২৫ হাজার টন পেঁয়াজ একটু কৃচ্ছ্র সাধন করে ব্যবহার করলে তিন মাসের স্থলে সাড়ে তিন মাস অনায়াসে চালিয়ে নেয়া যাবে। ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে মুলিকাটা পেঁয়াজ বাজারে আসতে শুরু করবে। সরকারি তথ্য মতে, পেঁয়াজ মজুদের এই শক্ত অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও ১৪ সেপ্টেম্বর ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ ঘোষণার সাথে সাথে ‘পেঁয়াজের ঝাঁজে ভোক্তাদের চোখে পানি ঝরতে থাকল’ কেন? তবে কি পেঁয়াজের বার্ষিক উৎপাদন, চাহিদা আমদানি ও মজুদের যে তথ্য সরকারের ভাণ্ডারে ছিল তাও জিডিপির প্রবৃদ্ধির মতো পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যাবলির অনুরূপ মনগড়া ছিল? বিষয়টি আঁচ করতে পেরেই হয়তো কয়েক দিন আগে থেকেই টিসিবির মাধ্যমে ‘পুকুর থেকে ঘটি ভরে পানি এনে সাগর ভরা’র ব্যর্থ প্রচেষ্টা চলছিল।
ভারত রফতানি বন্ধ করার ২৪ ঘণ্টা পর ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণের নামে আরো টালমাটাল অবস্থার সৃষ্টি করা হলো কার স্বার্থে? গত ’৫০ ও ’৬০ এর দশকে কোনো বাড়িতে ডাকাতি হয়ে যাওয়ার পর মাসাধিককাল ওই বাড়িতে পুলিশ প্রহরা বসানোর কারণে পুলিশকে খাওয়াতে গৃহকর্তা ডাকাতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মতো অবস্থা। সরকারের ভ্রান্ত পদক্ষেপ থেকে প্রতীয়মাণ হয় যে, কোনো বিশেষ গোষ্ঠীকে মজুদ ৫২ কোটি ৫০ লাখ কেজি পেঁয়াজে প্রতি কেজিতে ৫০ টাকা হিসাবে ২৫ শ’ কোটি টাকা জনগণের পকেট থেকে নেয়ার সুযোগদানের উদ্দেশ্য ছিল! ৪২ হাজার ভোটকেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের মতো প্রয়োজনীয় লোকবল সরকারের হাতে থাকা সত্ত্বেও ১৪ তারিখে দেশের সব পেঁয়াজের আড়ৎ, ব্যবসায়ীদের গুদাম, কাঁচাবাজারের পেঁয়াজের দোকান ও খুচরা বিক্রয়ের দোকানগুলো পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি মোতায়েন করে কর্ডন করে রেখে পেঁয়াজের মজুদ পরীক্ষা ও ক্রয়মূল্য যাচাই করে ১৩ তারিখে তারা যে দরে বিক্রয় করেছে সেই দরে পেঁয়াজ বিক্রয়ের ব্যবস্থা করা হলে গত বছরের সিন্ডিকেট বাজারে টালমাটাল অবস্থা সৃষ্টি করার সুযোগ পেত না। তা না করে, ২৪ ঘণ্টা তাদের দর বৃদ্ধির ‘নৈপুণ্য’ অবলোকনের পর ভ্রাম্যমাণ আদালত নামানোর কোনো সুফল ভোক্তারা পেলেন না। ভোক্তাদের হাতে অফুরন্ত টাকা ছিল না যে, ৫২ কোটি ৫০ লাখ কেজি পেঁয়াজ ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ক্রয় করে নিয়ে যাবে।
গত ২৬০ মাস যাবৎ জনগণ দেখে আসছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ব্যতীত কেউ স্বীয় সিদ্ধান্তে সঙ্কট মোচনে এগিয়ে আসেন না। পেঁয়াজের ফটকাবাজারি বন্ধে ২৪ ঘণ্টা দেরিতে যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল তা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশিত পথে হয়েছে বলে মনে হয় না। কারণ ক্রাইসিস মোকাবেলায় তার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অতুলনীয়। বছরে ছয় লাখ টন পেঁয়াজ, যা মোট উৎপাদিত পেঁয়াজের ২৫ শতাংশের বেশি, তা সংরক্ষণের সময় নষ্ট হয়ে যায় বলে যে তথ্য দেয়া হয়েছে তাও মনগড়া।
কারণ উৎপাদিত ফসলের ২৫ শতাংশের নষ্ট হয়ে খাওয়ার বা বাজারজাতকরণের অনুপযোগী হয়ে পড়লে আর্থিক ক্ষতির কারণে চাষিরা ওই ফসলের চাষ বন্ধ করে দিয়ে বিকল্প কোনো ফসলের চাষ করতেন। মুলিকাটা ও ছিট বুনা পেঁয়াজ, যার চাষ সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত এবং ডিসেম্বরের শেষ থেকে মার্চ পর্যন্ত যা উঠে, ওই সব পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা যায় না বিধায় চাষিরা তা সাথে সাথে বাজারজাত করে থাকেন। চারা লাগানো পেঁয়াজের চাষ ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসব্যাপী হয়ে থাকে এবং এপ্রিল-মে মাসে তা উঠে আসে। এই পেঁয়াজ ডিসেম্বর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। কোনো বছর এপ্রিল-মে মাসে অতি বৃষ্টির কারণে পেঁয়াজের জমিতে সাত-আট দিন পানি জমে থাকলে ওই পেঁয়াজ মাঠেই পচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অল্প বৃষ্টি হলে পেঁয়াজ উঠিয়ে যদি দেখা যায় তা সংরক্ষণ করা যাবে না, সাথে সাথে বিক্রি করে দেয়া হয়। পেঁয়াজ উঠানোর সময় অসাবধানতাবশত নিড়ানির আঘাতে কেটে গেলে তা বাছাই করে চাষিরা খেয়ে ফেলেন। তা অতিরিক্ত হলে কৃষিশ্রমিকদের দিয়ে দেন। পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য ঘরের চালায় স্থাপিত বাঁশের মাচায় উঠানোর আগে ভালোভাবে বাছাই করা হয়। যেগুলো পচে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে সেগুলো সাথে সাথে বাজারজাত করা হয়ে থাকে। তারপরও মাঝে মধ্যে সংরক্ষণ করা পেঁয়াজ পরীক্ষা করে দেখা হয়ে থাকে, যেগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সেগুলো চাষিরা নিজেরা খান এবং বাজারজাত করে থাকেন। তবে পেঁয়াজের রস শুকিয়ে ওজন কিছুটা কমে গেলেও ভাদ্র-আশ্বিন মাসে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ওই ক্ষতি পূরণ হয়ে যায়। সংরক্ষণজনিত কারণে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ বা দুই লাখ ৫০ হাজার টন পেঁয়াজ বছরে নষ্ট হতে পারে।
যদি সত্যই ২৫ লাখ ৫০ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয় তাহলে সংরক্ষণজনিত ক্ষতি দুই লাখ ৫০ হাজার টন বাদে বাজারজাতযোগ্য পেঁয়াজের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৩ লাখ টন এবং আমদানি চার লাখ ৫০ হাজার টন একুনে ২৭ লাখ ৫০ হাজার টন, যা মোট চাহিদা ২৫ লাখ টনের চেয়ে দুই লাখ ৫০ হাজার টন বেশি। পেঁয়াজ আমদানি নিয়ে সরকারের উৎকণ্ঠা প্রকাশ এবং আরো প্রায় দুই লাখ টন পেঁয়াজ আমদানির এলসি খোলার তোড়জোর দেখে মনে হয়, পেঁয়াজের উৎপাদন ও চাহিদা নিয়ে সরকারি তথ্যে বড় রকমের ঘাপলা রয়েছে।
প্রতি বছর নদী ভাঙনজনিত কারণে বন্যা নিয়ন্ত্রণের বাঁধ অনেক জায়গায় ভেঙে যাওয়া সত্ত্বেও তা মেরামত না করায় বগুড়া থেকে আরিচা ঘাট পর্যন্ত যমুনা নদীর দুই পাড়ের সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, টাঙ্গাইল ও মানিকগঞ্জের এবং রাজশাহী থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত পদ্মা নদীর দুই পাড়ের নাটোর, কুষ্টিয়া, পাবনা, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর ও শরিয়তপুরের হাজার হাজার একর পেঁয়াজ চাষের জমিতে বালুর আধিক্যজনিত পলি পড়ে পেঁয়াজ চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়ায় ওইসব জমিতে বর্তমানে ভুট্টা ও চিনাবাদাম চাষ হয়। মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা এলাকা এককালে উন্নতমানের পেঁয়াজ ও হাজারি খেজুরের গুড়ের জন্য খুবই প্রসিদ্ধ থাকলেও খেজুরগাছ কমে যাওয়ায় ফরিদপুর ও রাজবাড়ীর পেঁয়াজকেই ‘ঝিটকার পেঁয়াজ’ বলে বেশি দামে বিক্রি করে গ্রাহকদের প্রতারিত করছেন।
ভারত সরকার তার নির্বাচনী স্বার্থে ২০১৯ ও ২০২০ সালে বাংলাদেশ সরকারকে বোকা বানালেও আমাদের সরকার ভ্রুক্ষেপহীন কেন? কারণ ভারতে আমাদের দেশের মতো সব ক্ষমতা এক ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত নয়। ফেডারেল সিস্টেমে রাজ্যসরকার থাকায় আমাদের দেশের মতো নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের জয় নিশ্চিত নয় বিধায় ২০০৪ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় থেকেও বিজেপি পরাজিত হয়েছিল। আবার ২০১৪ সালে কংগ্রেস ক্ষমতায় থেকেও শুধু পরাজিত হয়নি বিরোধী দলের মর্যাদাও হারিয়েছে, যা ২০১৯ সালের নির্বাচনেও উদ্ধার করতে পারেনি। নির্বাচনে আমাদের দেশের ক্ষমতাসীন দলের জয় নিশ্চিত থাকায় ২০১৮ সালের কোটাবিরোধী আন্দোলন ও ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন পুলিশের সাথে হেলমেট বাহিনী নামিয়ে ঠাণ্ডা করার কোনো ছাপ ভোটের বাক্সে ফেলার সাহস ঢাকা শহরের ১৫টি আসনের একটি আসনের ভোটারদেরও হয়নি। কাজেই নির্বাচনে সরকারের পরাজয়ের সম্ভাবনা নামেমাত্র থাকায় সরকারি দলের সমর্থক ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের লোভের আগুনে পুড়ছে সাধারণ জনগণ। একেক বছর একেকটি নিত্যপণ্যের ফটকাবাজারী হয়তো ঘটতেই থাকবে। সমস্যার মূলে আঘাত না করে ভারত সরকারকে দোষারোপের কারণে ভারত ভদ্রতার খাতিরে ‘সরি’ বলেছে, কিন্তু একসাথে ১০-২০ কেজি পেঁয়াজ ক্রয়ের কারণে ভোক্তাদের যে দোষারোপ করা হচ্ছে, তার জন্য জনগণ ‘সরি’ বলবেন কাকে?