শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩৩ অপরাহ্ন

কংগ্রেসের বপন করা বীজে ফসল তুলল বিজেপি

ফারুক আনসারী
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২০
  • ২১৯ বার

উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যায় সাড়ে ৫০০ বছরেরও বেশি পুরনো, বাবরি মসজিদের কাহিনী শেষ হয়ে গেল। ১৯৪৯ সালে যে মামলা শুরু হয়েছিল, তা কয়েকটি আদালতের আঙ্গিনা পার হয়ে সব আইনি ধাপ অতিক্রম করে গিয়েছিল। তাতে কী লাভ হলো? এটি সবাই জানে- এতে কারো জয় হয়নি, কারো পরাজয় হয়নি। এ জন্য মুসলমানদের দাবি এখনো জীবিত আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত জীবিত থাকবে। ইতিহাসবিদ যখন এ মামলার ইতিহাস লিখবেন, তখন অন্যায়-অত্যাচার এবং ক্ষমতা ও শক্তির অপব্যবহারের উল্লেখ না করে পারবেন না। কেননা এ বিষয়ের দু’টি মামলায় বিচারক তো রায় শুনিয়েছেন মাত্র, কিন্তু তা লেখা হয়েছে অন্য কোথাও, যার প্রমাণ কেউ করতে পারবে না, এ কথার দাবিও করতে পারবে না। কেননা রায় বিচারকদের মুখ দিয়ে ঘোষিত হয়েছে। রায়ের বক্তব্য যিনিই লিখুন না কেন, পাঠকারীর বক্তব্যটাই আইন। এ জন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও তা মেনে নিতে হবে, নতুবা আদালত অবমাননার অপরাধে অভিযুক্ত হতে হবে। এমনিতে বর্তমানে কোনো কারণ ছাড়াই এনএসএ, আদালত অবমাননা এবং ইউএপিএর মতো আইন আরোপ করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। কেউ টুঁ শব্দ করতে পারছে না। আমাদের আলোচনা বাবরি মসজিদের দু’টি মামলা সম্পর্কে, যা ৭০ বছর ও ২৮ বছর ধরে আদালতে বিচারাধীন ছিল এবং যার কারণে অনাকাক্সিক্ষত হইচই ও উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো, তা শেষ হয়ে গেল।

১৯৪৯ সালে কংগ্রেস প্রকাশ্যে যে বীজ বপন করেছিল, ২০২০ সালে বিজেপি তার তৈরি ফসল কেটে নিলো এবং নিজেরাই এর সব দায়দায়িত্ব মাথায় তুলে নিয়েছে। দু’টি মামলাতেই মুসলমানরা পরাজিত খেলোয়াড়ের মতো হাত কচলাচ্ছে। তারা আর কিইবা করতে পারত? তারা জুলুম-নির্যাতন, অধিকার হরণ ও অবিচারের স্রোতের মুখে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে গিয়ে পড়ে গেছে। এটা তো সময়ই বলে দেবে যে, মুসলমান আবার কবে উঠে দাঁড়াবে এবং কবে ন্যায়বিচার পাবে? বাবরি মসজিদের বিষয়টি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। কিন্তু বিজেপি নিজের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এটাকে নিরেট ধর্মীয় বিষয় বানিয়ে দেয়। রাষ্ট্রের বড় বড় তিলকধারীদের প্রকাশ্যে হিন্দুধর্ম সঙ্কটাপন্ন অবস্থার মুখোমুখি হচ্ছে এমন চিন্তাচেতনা সৃষ্টি করে উসকিয়ে দেয়া হয়। এরপর কী হলো তা সবাই জানে। কিন্তু মুসলমানরা যদি এ ব্যাপারে বিজেপি, আরএসএস বা বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে আসল অপরাধী সাব্যস্ত করার আগে এর ইতিহাস অধ্যয়ন করে নেয়, তা হলে খুব সহজে এ কথা বুঝে আসবে, যে শক্তিগুলো কংগ্রেসে অনুপ্রবেশ করে ১৯৪৯ সাল বাবরি মসজিদে মূর্তি প্রতিস্থাপন করিয়েছিল, কংগ্রেস ওই সময় ক্ষমতায় ছিল, তারা চাইলে সেই শক্তিগুলোকে প্রতিহত করে মূর্তি অপসারণ করে বাবরি মসজিদের আসলরূপ বহাল রাখতে পারত।

কেননা যে রাতে মসজিদে মূর্তি রাখা হয়েছিল, ওই রাতে মসজিদে এশার নামাজ জামাতের সাথে আদায় করা হয়েছিল। কিন্তু কংগ্রেস মূর্তি অপসারণের পরিবর্তে মসজিদে তালা লাগিয়ে দেয়। আর বিষয়টিকে ফয়েজাবাদ কোর্টে প্রবেশ করিয়ে দেয়। যদি ওই সময় কংগ্রেস সরকার নিজ দায়িত্ব সততার সাথে পালন করত, তা হলে আজ এ অবস্থা তৈরি হতো না। কংগ্রেস তালা লাগায়, এরপর তালা খোলায়, শিলান্যাস করায়, পূজা শুরু হয় এবং ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২ প্রকাশ্যে ওখান থেকে মসজিদের নামনিশানাও শেষ করিয়ে দেয়। ‘বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি’ আদালতে মালিকানার অধিকারের মামলাই লড়ে যাচ্ছিল। ওই সময় যদি কংগ্রেসের মধ্যে এই নাজুক ও স্পর্শকাতর সমস্যার সমাধান করার সততামূলক নিয়ত থাকত, তা হলে এ সমস্যা ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২ সালের পরও সমাধান করা যেত। কিন্তু হিন্দু ভোট ব্যাংকের লালসা কংগ্রেসকেও পিছু হটতে বাধ্য করে।

এটা তো মোদি সরকারের দুঃসাহস যে, তারা তাদের ক্ষমতা ও পদের সম্পূর্ণ ফায়দা নিয়ে বাবরি মসজিদের মালিকানার অধিকারের জন্য এমন রায় করিয়ে নিয়েছে যে, সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারক (চিফ জাস্টিসসহ) ওকালতির জীবনেও ভাবতে পারেননি যে, তাদের এমনও রায় শোনাতে হবে। বাবরি মসজিদের সম্পূর্ণ জায়গা রামমন্দির ট্রাস্টকে দিয়ে দেয়া হয়েছে। মুসলমানরা যেহেতু কথার মান রাখে, তাই তারা সেটাই করেছে, যে ওয়াদা তারা করেছিল। তাদের ওয়াদা ছিল, যদি রায় তাদের বিপক্ষেও যায়, তবুও তারা তা মেনে নেবে। অপর পক্ষ ঢাকঢোল পিটিয়ে বলেছিল, যদি রায় আমাদের বিপক্ষে হয়, তা হলে আমরা তা মেনে নেবো না। এতদসত্ত্বেও মুসলমানরা নীরব। মুসলমানদের কাছে জমির সব পাকা প্রমাণ বিদ্যমান ছিল।

এতদসত্ত্বেও এগুলো উপেক্ষা করে আদালত আস্থার ভিত্তিতে রায় দিয়েছেন। আইনের গ্রন্থে ভূমিকাস্বরূপ যে কথাগুলো লেখা রয়েছে, এ রায়কে তার বিপরীত মনে করা হয়েছে। সেখানে কিন্তু কেউ কিছুই করতে পারেনি। এ জন্য মোদি সরকারের মধ্যে রায় বের করে নেয়ার যে ক্ষমতা ছিল, তা কংগ্রেসের মধ্যে কখনো সৃষ্টি হয়নি। কংগ্রেস হিন্দু ভোট ব্যাংকের জন্য বাবরি মসজিদ মামলাকে জিইয়ে রেখেছে, কিন্তু বিজেপি কংগ্রেসের বপন করা বীজের ফসল তুলে নিলো। এরপর থাকল মসজিদ শহীদ করার মামলা। কেননা মসজিদের শাহাদতের পর কংগ্রেস বিচারপতি লিবারহান কমিশন গঠন করে এটা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল। কংগ্রেস কমিশন ও কমিটি গঠনে পটু ছিল। যখনই কোনো বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা হয়েছে তারা তার তদন্তের জন্য কমিশন বা কমিটি গঠন করে দিয়েছে, যাতে মানুষ চুপ হয়ে যায়। কেননা একবার যখন বিষয়টি শান্ত হয়ে যায়, তখন কে আবার দাফন করা মুর্দা উঠাবে?

এ জন্য কোনো কমিশনের সুপারিশের ওপর আজ পর্যন্ত কারো সাজা হয়নি। অথচ বিচারপতি লিবারহান কমিশন বাবরি মসজিদের শাহাদতের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ নাম উল্লেখ করেছিল। বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বজরঙ্গ দলের ৪৯ ব্যক্তিকে সেখানে চিহ্নিত করা হয়েছিল। সিবিআই তাদের সবাইকে অপরাধী সাব্যস্ত করে। আর তাদের সবার বিরুদ্ধে এতটাই মজবুত প্রমাণ ছিল যে, অবশ্যই সবার সাজা হওয়ার কথা। তারা নিজেরাই এ কথাই বলতেন, আমাদের যে শাস্তি হবে, তা আমরা মেনে নেবো। কারণ তারা সবাই অপরাধী। কিন্তু এখানেও আরএসএসের মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার মানসিকতা কাজ করছে এবং জাস্টিস এস কে যাদব সেই রায়ই পড়ে শুনিয়েছেন, যা প্রকাশ্যে আসার আগে ভেবেচিন্তে তৈরি করে রাখা হয়েছিল। বিজেপি সরকারের এই কৌশল থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেছে, তাদের দুঃসাহস রয়েছে। কেননা তারা তাদের চিন্তাধারা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কাউকে ভয় পায় না।

যদি তাদের মধ্যে ভয় থাকত, তাহলে তিন তালাকের আইন বানাতে পারত না। কৃষকদের জন্য কৃষি আইন বানাতে পারত না। বাবরি মসজিদের রায় নিজেদের মতো করাতে পারত না। তাই বলে কি তাদের অধিকার রয়েছে মিথ্যার বালুর ওপর দেয়াল নির্মাণ করার? আদালত ন্যায়বিচারের জন্য তৈরি করা হয়। কিন্তু এখন ওই আদালত ন্যায়বিচার শোনানোর কী কাজ করছেন? এর আগে বাবরি মসজিদের মালিকানার মামলায় রাষ্ট্র দেখেছে, বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটির সব প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও এবং আদালত কর্তৃক তার স্বীকৃতি দেয়া সত্ত্বেও তাকে এ কথা বলতে হয়েছে ‘এই ভূমির (বাবরি মসজিদের স্থানের) ওপর হিন্দুদের আস্থা নিহিত। এ জন্য সম্পূর্ণ ভূমি তাদের দিয়ে দেয়া হলো।’ অর্থাৎ মুসলমানদের আস্থাকে পিষে দিয়ে হিন্দুদের আস্থাকে মেনে নেয়া হলো এবং সম্পূর্ণ ভূমি রামজন্মভূমি ট্রাস্টকে অর্পণ করে দেয়া হয়। ওই সময় মুসলমানরা যে ঐতিহাসিক ধৈর্য প্রকাশ করেছিল, তা পুরো বিশ্ব দেখেছে।

আজ আবার সারা দেশের মুসলমান ওই স্থানে এসে পৌঁছেছে। কেননা বাবরি মসজিদ শাহাদতের মামলার রায় শোনানো হলো। আর এটাও আগের রায়ের মতো হতবাক করে দিয়েছে। কারণ ৪৯ জনের সবাইকেই সিবিআই অপরাধী সাব্যস্ত করেছিল যার মধ্যে ১৭ জন মারা গেছে। বাকি ৩২ জন অপরাধীর ব্যাপারে আদালত তার রায় শোনাতে গিয়ে বলেছেন, এরা সবাই বাবরি মসজিদ ধ্বংসকারী সমাজ-শত্র“গোষ্ঠীকে বাধা দিচ্ছিল। এ জন্য মসজিদ শাহাদতের ঘটনায় তাদের কোনো ভূমিকা ছিল না। এ জন্য সবাইকে সসম্মানে নির্দোষ ঘোষণা করা হচ্ছে।’ এটা ভারতের সিবিআইয়ের বিশেষ আদালতের রায়। অর্থাৎ দিনের আলোকে ন্যায়বিচার রক্তে রঞ্জিত হলো। আর সারা দেশ তা দেখল। সবাই যেন এ কথা মনে রাখে, আল্লাহর একটি আইন আছে। একটি আদালত আছে। যেখান থেকে শুধু ইনসাফ হয় এবং শাস্তি প্রদান করা হয় যার থেকে কেউ বাঁচতে পারবে না। কেননা ওখানে কোনো কৌশল চলবে না। কোনো সুপারিশ চলবে না।

মুসলমানরা ওই আদালতের ফায়সালার অপেক্ষা করছে এবং ধৈর্যধারণ করে সব বিষয় তার ওপর ছেড়ে দিয়েছে। কংগ্রেস বীজ বপনের সাজা পেয়েছে। এখন দেখার পালা বিজেপি ফসল তোলার শাস্তি কবে পাবে?

মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক উর্দুটাইমস ৩ অক্টোবর, ২০২০ হতে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com

লেখক : ভারতের সাংবাদিক ও কলামিস্ট

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com