শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৪০ অপরাহ্ন

খেলাপিদের গণছাড়, ব্যাংকের ষোলোআনাই মিছে

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২০
  • ২৩৪ বার

সুদ হিসেবে ২/৪ আনা আয় করতে ঋণ বিতরণ করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। যে টাকা ঋণ দেওয়া হয় তা জনগণের থেকে সংগৃহীত আমানত। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অনেকেই আত্মসাৎ করেছেন। নাম লেখিয়েছেন ঋণখেলাপি হিসেবে। সেই ঋণখেলাপিদের ছাড় দিতে ‘গণছাড়’ সুবিধা ঘোষণা করে সরকার। এতে ১৩ হাজার ৩০৭ জন খেলাপিকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। তাদের ৯ হাজার ১৯৮ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করে আদায় করতে পেরেছে মাত্র ৫৪৮ কোটি টাকা। সে হিসেবে ব্যাংকের পাওনার ১৭ ভাগের ১৬ ভাগই মওকুফ করতে হয়েছে। গ্রাহকের লাভ ষোলোআনা হলেও ব্যাংকের ষোলোআনাই হয়েছে মিছে।

সুকুমার রায়ের ‘ষোল আনাই মিছে’ কবিতার শেষ পঙ্ক্তি, ‘বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে,/ তোমার দেখি জীবন খানা ষোল আনাই মিছে!’ জ্ঞানী বাবুমশাইয়ের প্রতি মূর্খ মাঝির উক্তি এটি। আইন, নিয়মনীতিতে পরিচালিত ব্যাংকিং খাতকে নীতির মারপ্যাঁচে বোকা বানিয়ে ব্যাংকের লাভের ষোলোআনাই মিছে করে দিয়েছে সুচতুর খেলাপিরা।

সূত্র জানায়, মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে এক বছরে গ্রেস পিরিয়ডসহ ১০ বছরের জন্য খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেওয়া হয় ২০১৯ সালের ১৬ মে। সুদহারও কমিয়ে ৯ শতাংশ করা হয়। একই সঙ্গে একবারে কেউ ঋণ পরিশোধ করতে চাইলে তার সমুদয় সুদ মওকুফ করে এক বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধের সুযোগ দিতে ‘ওয়ান টাইম এক্সিট’ সুবিধা দেওয়া হয়। এ দুটি সুবিধা নিতে চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আবেদনের সুযোগ ছিল। এ সুবিধা নিতে সর্বমোট ২০ হাজার ৭০৩ ঋণখেলাপি আবেদন করেন। তাদের কাছে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরভিত্তিক ব্যাংকগুলোর পাওনা ছিল ২২ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। আবেদন করা গ্রাহকদের মধ্যে সুবিধা পেয়েছেন ১৩ হাজার ৩০৭ গ্রাহক। এ গ্রাহকদের ৯ হাজার ১৯৮ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করা হয়েছে। আর ব্যাংকের আদায় হয়েছে মাত্র ৫৪৮ কোটি টাকা।

ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্সের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী বলেন, ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলো সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেনি। ব্যাংকগুলো যদি প্রচলিত আইন অনুসারে ঋণের টাকা আদায়ে সচেষ্ট হতো তা হলে বিপুল পরিমাণ ছাড় দিতে হতো না। এতে ঋণখেলাপিরা লাভবান। তারা রাষ্ট্রের টাকা, জনগণের টাকা নিয়ে নয়-ছয় করেছে আবার বিদেশে পাচার করেছে। এখন ব্যাংক আবার ছাড় দিয়ে ওই খেলাপিদেরই সুবিধা দিচ্ছে।

সূত্র জানায়, সর্বমোট ১৯ হাজার ৬০৪ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ কমানোর সুযোগ পেয়েছে ব্যাংক। এর বিপরীতে ব্যাংকগুলোর স্থগিত খাত থেকে ২ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা এবং অনারোপিত সুদের ৬ হাজার ৭৫৪ কোটি টাকার সুদ মওকুফ করা হয়েছে। নিয়মানুসারে ঋণখেলাপি হয়ে গেলে তার বিপরীতের সুদ আদায় দেখাতে পারে না। প্রথমে তা সাসপেন্স হিসেবে রাখা হয় এবং পরে অনারোপিত সুদ হিসেবে আলাদা হিসাবায়ন করা হয়। খেলাপি না হলে বা বিশেষ ছাড়ে মওকুফ করতে না হলে ওই গ্রাহকরা ব্যাংকগুলোকে ৯ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা সুদ পরিশোধ করতে বাধ্য থাকতেন। ঋণের বিপরীতে এটি ব্যাংকের সুদ আয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, পুনঃতফসিল সুবিধা পেয়েছেন ৭ হাজার ৩২৮ ঋণ খেলাপি। তাদের ৭ হাজার ৪১৯ কোটি মওকুফ করে আদায় করা হয়েছে মাত্র ৪৮৫ কোটি টাকা। আর ৫ হাজার ৯৭৯ গ্রাহককে দেওয়া হয়েছে এককালীন এক্সিট সুবিধা। তাদের কাছ থেকে আদায় হয়েছে মাত্র ৬৩ কোটি টাকা। ব্যাংকের পাওনা ১ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা মওকুফ করা হয়েছে।

বরাবরের মতো ঋণখেলাপিদের ছাড় দিতে এগিয়ে সরকারি ব্যাংকগুলো। এ খাতের ব্যাংকগুলো ১১ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ কমিয়েছে বিশেষ পুনঃতফসিল ও এককালীন সুবিধার মাধ্যমে। আর বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো কমিয়েছে ৭ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা।

তবে ঋণখেলাপিদের ছাড় দেওয়ার ঘটনা এটি নতুন নয়। ২০১৩ সাল থেকে বিশেষ ছাড়ে পুনঃতফসিল করা হচ্ছে। ২০১৪ সালে বড় ঋণখেলাপিদের দেওয়া হয় ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা। গত পাঁচ বছরে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৯ সালে পুনঃতফসিল করা হয়েছে ৫২ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। এ সুবিধা নিয়েও অনেকে আবার খেলাপি হয়ে গেছেন। এমনকি ১২ বার পর্যন্ত সুবিধা নেওয়ার নজিরও রয়েছে। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুসারে ৩ বারের বেশি ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। আবার তৃতীয়বার ছাড় দেওয়ার নিয়মনীতিও অনেক কঠিন। কিন্তু বারবার ছাড় গ্রহণ করতেও খেলাপিদের বড় বাধার মুখে পড়তে হয়নি। বরং তাদের ছাড় দিতে সরকার, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট ব্যাণিজ্যিক ব্যাংক সব সময় উদার ছিল।

সর্বশেষ গণছাড় দেওয়ার সময় জারি করা সার্কুলারে বলা হয়, উৎপাদনশীল খাতসহ অন্য খাতে স্বাভাবিক ঋণপ্রবাহ বজায় রাখাসহ ব্যাংকিং খাতে বিরূপমানের খেলাপি ঋণ নিয়মিত আদায়ের জন্য ঋণ পুনঃতফসিলকরণ ও এককালীন এক্সিট সংক্রান্ত বিশেষ নীতিমালা জারি করা হয়। ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বরে মন্দমানের খেলাপি গ্রাহকরা এ সুবিধা গ্রহণের সুযোগ পেয়েছেন।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com