আলুর বাজারে শুরু হয়েছে অভিযান। শুধু বাজারেই নয়, যেখানে রক্ষণাবেক্ষণ এবং পাইকারি কেনাবেচা হয়; সেসব জায়গাতেও চলছে অভিযান। আলুর লাগামহীন বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্যই এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর আগে গতকাল বুধবার আলুর দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকারি প্রতিষ্ঠান কৃষি বিপণন অধিদফতর।
প্রায় দুই সপ্তাহ ধরেই আলুর বাজারে বিরাজ করছে চরম অস্থিরতা। পেঁয়াজের মতোই আলুর দামও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল। যে আলু এক সময় ১৮-২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে সেই আলুর দাম উঠেছে ৫৫-৬০ টাকায়। হঠাৎ করেই আলুর দামের এই ঊর্ধ্বগতি নিম্ন আয়ের মানুষকে ভাবিয়ে তুলে। যারা আলুভর্তা আর ডালনির্ভর জীবন যাপনে অভ্যস্ত তারা দিশেহারা। বিষয়টি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেরও নজরে আসে এবং সমালোচনা শুরু হয় সাধারণ মানুষের মধ্যে।
অবশেষে গতকাল আলুর দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার। তিন পর্যায়ে এই দাম নির্ধারণ করা হয়। কেজি প্রতি খুচরা পর্যায়ে ৩০, পাইকারিতে ২৫ ও হিমাগার থেকে ২৩ টাকা। এই দামে আলু বিক্রি না করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে সরকারিভাবে ঘোষণা দেয়া হয়। গতকাল কৃষি বিপণন অধিদফতর থেকে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। দেশের সব জেলা প্রশাসককে এই ব্যাপারে চিঠি দেয়া হয় সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাব মতে, এই বছর এক কেজি আলু উৎপাদনে খরচ পড়েছে আট টাকা ৪০ পয়সা। আর আলু উৎপাদিত হয়েছে এক কোটি ৯ লাখ টন। সংস্থাটির হিসাবে দেশে বছরে আলুর চাহিদা ৭৭ লাখ টন। আর বীজ আলু হিসাবে আরো ২০ টন আলুর প্রয়োজন হয়।
তবে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের হিসাব মতে, চলতি বছর ৮৫ লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। তাদের হিমাগারগুলোতে বর্তমানে আলু রয়েছে ৪০ লাখ টন। এর মধ্যে ১৫ লাখ টন বীজ আলু। মাসে দেশে আলুর প্রয়োজন হয় ৮ লাখ টন।
জেলা প্রশাসকদের বরাবরে প্রেরিত চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, সংরক্ষিত আলুর কোল্ডস্টোরেজ (হিমাগার) পর্যায়ে বিক্রয় মূল্যের ওপর সাধারণত ২ থেকে ৫ শতাংশ লভ্যাংশ, পাইকারি পর্যায়ে ৪ থেকে ৫ শতাংশ এবং খুচরাপর্যায়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ লভ্যাংশ যোগ করে ভোক্তার কাছে আলু বিক্রয় করা যুক্তিযুক্ত। এ ক্ষেত্রে হিমাগার পর্যায় থেকে প্রতি কেজি আলু ২৩ টাকা মূল্যে বিক্রি করলে আলু সংরক্ষণকারীর ২ টাকা মুনাফা হয় বলে প্রতীয়মান হয়। অন্য দিকে আড়তদারি, খাজনা ও লেবার খরচ বাবদ ৭৬ পয়সা খরচ হয়। সেই অনুযায়ী পাইকারি মূল্য (আড়ত পর্যায়ে) ২৩ টাকা ৭৭ পয়সার সাথে মুনাফা যোগ করে সর্বোচ্চ ২৫ টাকা দেয়া যেতে পারে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
একজন চাষির প্রতি কেজি আলুর উৎপাদনে খরচ হয়েছে ৮ টাকা ৩২ পয়সা জানিয়ে চিঠিতে আরো বলা হয়, এমতাবস্থায় হিমাগার পর্যায় থেকে প্রতি কেজি আলুর মূল্য ২৩ টাকা, পাইকারি/আড়তের মূল্য ২৫ টাকা এবং ভোক্তা পর্যায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৩০ টাকা হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু বাজারে দেখা যাচ্ছে, প্রতি কেজি আলু খুচরাপর্যায়ে ৩৮ থেকে ৪২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা অযৌক্তিক ও কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাই কোল্ডস্টোরেজ পর্যায়ে প্রতি কেজি আলু ২৩ টাকা, পাইকারি পর্যায়ে ২৫ টাকা এবং ভোক্তাপর্যায়ে ৩০ টাকা মূল্যে খুচরা ব্যবসায়ীরা বিক্রি করবেন। সরকার নির্ধারিত মূল্যে হিমাগার, পাইকারি বিক্রেতা এবং ভোক্তাপর্যায়ে খুচরা বিক্রেতাসহ তিন পক্ষই যাতে সবজিটি বিক্রয় করেন সে জন্য কঠোর মনিটরিং ও নজরদারির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়েছে ডিসিদের কাছে পাঠানো ওই চিঠিতে। এ দিকে, আলুর আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধির জন্য খুচরা বিক্রেতারা পাইকারি বিক্রেতাদের, আর পাইকারি বিক্রেতারা হিমাগার মালিকদের দুষছেন।
এ দিকে, গতকালই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আলুর বাজারে অভিযান চালায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। ভোক্তা অধিকার অধিদফতর সূত্র জানায়, প্রায় ৩০টি জেলার বিভিন্ন বাজারে গতকাল অভিযান পরিচালিত হয়। জেলাগুলো হচ্ছেÑ টাঙ্গাইল, খুলনা, দিনাজপুর, ফেনী, পঞ্চগড়, বরগুনা, খুলনা, সিরাজগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, কুমিল্লা, রাজশাহী, বাগেরহাট, যশোর, জামালপুর, বগুড়া, নওগাঁ, ভোলা, মাগুরা, নাটোর, কুড়িগ্রাম, ঝালকাঠি, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, পিরোজপুর ও শরীয়তপুর।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর সূত্র জানায়, রাজধানীর অন্তত সাতটি প্রতিষ্ঠানকে বাড়তি মূল্য রাখার অভিযোগে জরিমানা করা হয়। অধিদফতরের কর্মকর্তারা গতকাল মিরপুর শাহ আলী বাজার, কাওরানবাজার, হাতিরপুল বাজার ও মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে অভিযান চালায়। অধিদফতরের এক কর্মকর্তা জানান, আজ থেকে আরো ব্যাপকভাবে অভিযান পরিচালিত হবে। এ ছাড়া অন্যান্য সংস্থাও বাজার মনিটরিং করছে বলে জানা যায়।
একাধিক আলু ব্যবসায়ীর সাথে গতকাল কথা বলে জানা গেছে, আলুর সঙ্কট রয়েছে। এবার ত্রাণে অনেক আলু চলে গেছে। আবার বন্যার কারণে তরিতরকারি যখন নষ্ট হয়ে গেছে তখন আলুর ওপর চাপ পড়েছে। আর এই কারণে আলুর কিছুটা টান পড়েছে। আর যখন সংরক্ষণকারীরা এটা বুঝতে পেরেছে তখনই দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
মুন্সীগঞ্জ সিরাজদিখানের আলুচাষি আব্দুল কাদের নয়া দিগন্তকে বলেন, তাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন নেই। গত বছর এমনিতেই চাষিরা কম আলু চাষ করেছেন। কারণ আগের বছরগুলোতে তারা লোকসানের মুখে পড়েন। তারপরও যে পরিমাণ চাষ হয়েছে তাতে আলুর সঙ্কট হওয়ার কথা নয়। আব্দুল কাদের বলেন, অনেক চাষি আছেন যারা মাঠ থেকেই কম মূল্যে আলু বিক্রি করে দেন। বিশেষ করে যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না, তারা উৎপাদন মূল্যের চেয়ে একটু বেশি দাম পেলেই মাঠ থেকেই আলু বিক্রি করে দেন। মুনাফাটা হলো যারা সংরক্ষণ করেছেন তাদের।