রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০১:০৪ পূর্বাহ্ন

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন, ধর্মবিশ্বাস ও বিচারপতি নিয়োগ

কামাল আহমেদ
  • আপডেট টাইম : বুধবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২০
  • ৪৭০ বার

যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি পদে প্রফেসর এমি কনি ব্যারেটের মনোনয়নে অনুমোদন দেওয়ার পর সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা মিচ ম্যাককনেল বলেছেন এই বিচারপতি আমাদের ‘একটি রাজনৈতিক সম্পদ’। বিচারপতি নিয়োগে সিনেটের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং রিপাবলিকান পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে ডেমোক্র্যাটদের বিরোধিতা সত্ত্বেও এই মনোনয়ন অনুমোদিত হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচনের আগে এত তড়িঘড়ির পেছনে অবশ্য প্রধান কারণ নির্বাচনে খ্রিষ্টধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যে যাঁরা গোঁড়া, তাঁদের সমর্থন আদায়। গোঁড়া ক্যাথলিক খ্রিষ্টধর্মবিশ্বাসী অ্যামি কোনি ব্যারেটকে তিন বছর আগে ফেডারেল আপিল কোর্টেও বিচারক হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। সাত সন্তানের মা ৪৮ বছর বয়সী এমি ব্যারেট গর্ভপাতবিরোধী হিসেবে পরিচিত, যিনি রক্ষণশীলদের কাছে আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হবেন।

ধর্মীয় রক্ষণশীলতা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার বেশ কিছু নজির তুলে ধরেছেন পুলিৎজার বিজয়ী সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড তাঁর সদ্য প্রকাশিত সাড়াজাগানো বই ‘রেজ’-এ। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে সে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্সের (ডিএনআই) প্রধান পদে সাবেক সিনেটর ড্যান কোটসের নিয়োগ পাওয়ার ঘটনাটি।
ড্যান কোটসের স্ত্রী মার্শা কোটসের জবানিতে এ বিবরণ পাওয়া যায়। ড্যান কোটস ও মার্শা উভয়েই ধর্মীয় কারণে ট্রাম্পকে পছন্দ করতেন না। মার্শা ইন্ডিয়ানা রিপাবলিকান পার্টির রাজ্য কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন থাকায় দলের পক্ষে অবস্থান নেওয়া এবং অন্যদের উদ্বুদ্ধ করার দায়িত্ব ছিল তাঁর কাঁধে। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আলোচনায় ভোটের প্রসঙ্গ উঠতে তাঁর এক আত্মীয় বলেন, ‘ট্রাম্প তো লোক ভালো না, ভালো খ্রিষ্টান না, ভালো নৈতিকতার অধিকারী না।’ মার্শা তাঁদের বলেন, তিনিও জানেন ট্রাম্প দুশ্চরিত্র, নারীদের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করেন। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে, ট্রাম্প গর্ভপাতবিরোধী এবং তিনি শক্তিশালী সেনাবাহিনীর জন্য অর্থায়নের অঙ্গীকার করেছেন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আগে সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিল গোরশুক ও ব্রেট কাভানার নিয়োগের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের গোঁড়া ধর্মবিশ্বাসী রক্ষণশীলদের প্রত্যাশা পূরণ করেছেন। সুপ্রিম কোর্টের নয়জন বিচারপতির মধ্যে রক্ষণশীলের সংখ্যা পাঁচে উন্নীত করেন।

মার্শার কথায় পরিবারের সদস্যদের মন গলল না। কিন্তু মার্শা তখন বললেন, ‘আমরা যদি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থনে ঐক্যবদ্ধ না হই, তাহলে আমরা আবারও বামপন্থী এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য ওয়াশিংটনের দরজা চার বছরের জন্য খুলে দেব। রক্ষণশীলরা যে শুধু হোয়াইট হাউস ও নির্বাহী সংস্থাগুলোর নিয়ন্ত্রণ হারাবে, তা–ই নয়, সুপ্রিম কোর্টও হারাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘রক্ষণশীল, প্রো-লাইফ, ইভানজেলিকাল নারী রিপাবলিকান হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন করার সমস্যাটা আমি বুঝি। ট্রাম্প আমার প্রথম পছন্দ নয়, দ্বিতীয় পছন্দও নয়। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, এই পদ তাঁকে বদলে দেবে। ট্রাম্প নির্দেশনার জন্য স্রষ্টার মুখাপেক্ষী হবেন।’
সিআইএ ও ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির মধ্যে সমন্বয় ও তাদের তদারকির দায়িত্ব হচ্ছে ডিরেক্টর ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্সের (ডিএনআই)। ট্রাম্প যখন ড্যান কোটসকে গোয়েন্দাপ্রধানের পদ নেওয়ার প্রস্তাব করেন, তখন তিনি দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী তাঁকে এটা ‘ঈশ্বরের ইচ্ছা’ বলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রস্তাবে রাজি করান। অতীতে তিনি প্রকাশ্যেই ট্রাম্পের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও নির্বাচনে তিনি এবং তাঁর স্ত্রী ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়েছেন। এই সমর্থনের অন্যতম প্রধান কারণ সুপ্রিম কোর্টে রক্ষণশীল বিচারকদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আগে সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিল গোরশুক ও ব্রেট কাভানার নিয়োগের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের গোঁড়া ধর্মবিশ্বাসী রক্ষণশীলদের প্রত্যাশা পূরণ করেছেন। সুপ্রিম কোর্টের নয়জন বিচারপতির মধ্যে রক্ষণশীলের সংখ্যা পাঁচে উন্নীত করেন।

বিচারপতি রুথ বেইডার গিন্সবার্গের মৃত্যুতে সুপ্রিম কোর্টে রক্ষণশীলদের প্রাধান্য আরও সুদৃঢ় করার যে সুযোগ এসেছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং রিপাবলিকান পার্টি তাকে কাজে লাগাতে যে তাড়াহুড়ো করলেন, তার কারণও নির্বাচন। মানুষ হিসেবে তিনি নিজে না বদলালেও গোঁড়া ইভানজেলিক্যাল ভোটারদের কাছে তিনি এখন একজন সংস্কারক। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা যখন তাঁর পুনর্নির্বাচনের সম্ভাবনাকে অনিশ্চিত করে ফেলেছে, তখন গোঁড়া ধর্মীয় রক্ষণশীলদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসার এটাই সবচেয়ে ভালো উপলক্ষ।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিচার বিভাগে যে কত বড় রূপান্তর ঘটিয়েছেন, তা যে শুধু সুপ্রিম কোর্টের পরিধিতেই সীমিত, তা নয়। সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে মিক ম্যাককনেল এবং সিনেটের বিচার বিভাগবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর লিন্ডজি গ্রাহামের সঙ্গে মিলে তিনি তাঁর মেয়াদকালে ফেডারেল আদালতের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বিচারক নিয়োগ করেছেন, যাঁদের অন্যতম প্রধান যোগ্যতা হচ্ছে তাঁরা রক্ষণশীল।

গত ২২ মে সাংবাদিক বব উডওয়ার্ডের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে আলোচনার সময়েও বিচারক নিয়োগে তাঁর সাফল্যের কথা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তাঁর নিয়োগ করা বিচারকের সংখ্যা ২৮০ ছাড়িয়ে যাবে। তিনি এ কথাও স্মরণ করিয়ে দেন যে প্রেসিডেন্ট ওবামা তাঁর দুই মেয়াদে নিয়োগ দিতে পেরেছিলেন ১৪২ জন বিচারক। নির্বাচনী প্রচারণার সময়ে ফক্স টেলিভিশনেও মিচ ম্যাককনেল ও সিনেটর গ্রাহাম বিচার বিভাগের এই পরিবর্তনের কৃতিত্ব বেশ গর্বের সঙ্গে জাহির করেছেন।

এসব বিচারক ফেডারেল আদালতের এবং তাঁদের একটা বড় অংশই আপিল নিষ্পত্তি করে থাকেন। ডেমোক্র্যাটদের আশঙ্কা, বিভিন্ন রাজ্যে পোস্টাল ব্যালট কিংবা ভোটারদের ভোট দেওয়ার পথে বাধা সৃষ্টির ঘটনাগুলোর প্রতিকারের মামলায় এসব বিচারক হয়তো বস্তুনিষ্ঠভাবে আইন প্রয়োগ না করে পক্ষপাতমূলক আচরণ করতে পারেন। আর সুপ্রিম কোর্টের ক্ষেত্রে এই আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি।

প্রেসিডেন্ট বুশের বিরুদ্ধে আল গোরের মামলায় সুপ্রিম কোর্টে হেরে যাওয়ার দুঃস্বপ্ন এখনো ডেমোক্র্যাটদের তাড়িয়ে ফেরে। সিনেট জুডিশিয়ারি কমিটির শুনানিতে তাই ডেমোক্র্যাটরা জানতে চেয়েছেন, নির্বাচনসংক্রান্ত কোনো মামলা সুপ্রিম কোর্টে গড়ালে বিচারপতি হিসেবে এমি ব্যারেট নিজেকে শুনানি থেকে প্রত্যাহার করে নেবেন কি না। প্রশ্নটির কোনো জবাব মেলেনি। ফলে, নির্বাচনের প্রাক্কালে তাঁর নিয়োগের পর ডেমোক্র্যাটদের প্রত্যাশা একটাই, তাঁদের প্রার্থী জো বাইডেন যেন এত বিপুল সংখ্যায় ভোট পান, যাতে কোনো আইনি লড়াইয়ের প্রশ্নই না ওঠে।

কামাল আহমেদ সাংবাদিক

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com