রবিউল আউয়াল মাস মানবজাতির জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার। কারণ এটি রাসূল সা:-এর জন্মগ্রহণের মাস। মহান আল্লাহ তায়ালার অশেষ কৃপায় আমরা পবিত্র রবিউল মাস অতিক্রম করছি। এই পবিত্র মাসেই বিশ্বনবী ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদ সা:কে পৃথিবীতে আল্লাহ পাক শান্তির অমিয় বাণী দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। ১২ রবিউল আউয়াল মানে, পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সা:। দয়াল নবীর শুভাগমনের দিন বা মিলাদের দিন হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় খুশির ও আনন্দের দিন। ৫৭০ সালের ২৯ আগস্ট ১২ রবিউল আউয়াল রোজ সোমবার শেষ ও শ্রেষ্ঠনবী হজরত মুহাম্মদ সা: পবিত্র মক্কা নগরীতে কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৬৩২ সালের ৭ জুন, ১২ রবিউল আওয়াল ১১ হিজরি একই দিনে সোমবার ৬৩ বছর বয়সে মদিনায় ইন্তেকাল করেন। তার পিতার নাম আবদুল্লাহ এবং মাতার নাম আমিনা। ১২ রবিউল আউয়াল যে দিন ও যে মুহূর্তে মহানবী সা:-এর ধূলির ধরায় আগমন করেন, সেই দিন ও সেই মুহূর্তটি বিশ্বজগতের জন্য মহানন্দের উপলক্ষ। কেননা তিনি সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ ও মহামানব। তিনি বিশ্বমানবতার প্রতীক ও সত্য সুন্দরের বাণীবাহক। তার পরশপাথরে যাযাবর বর্বর আরব জাতি একটি সুমহান জাতিতে পরিণত হয়েছিল। উৎপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষসহ সব শ্রেণীর মানুষের ছিলেন অকৃত্রিম বন্ধু। ৬১০ সালে হেরা গুহায় নবুওয়াত লাভের পর ইসলামের বাণী প্রচারে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। তিনি মক্কাবাসীর অত্যাচার ও নির্যাতনের মুখে একমাত্র আল্লাহর নির্দেশে ৬২২ সালে ২৪ সেপ্টেম্বর মদিনায় হিজরত করেন। তার তাওহিদের বাণী প্রচারের ফলে আরব জাহানে নবজাগরণ সঞ্চারিত হয়, নতুন সভ্যতা সংস্কৃতির উন্মেষ এবং আবির্ভাব ঘটে এক নতুন জীবন ব্যবস্থার। অচিরেই নতুন সভ্যতা, ঐক্য, শান্তি, সাম্য ও মানবকল্যাণের চিন্তাচেতনা এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের সার্বিক চিন্তাধারাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। নবুওত প্রাপ্তির মাত্র ২৩ বছরের ব্যবধানে এতবড় অভাবনীয় সাফল্য আর কোনো নবী রাসূল বা মহাপুরুষ অর্জন করতে পারেননি।
বিনয় ও নম্রতা ছিল রাসূল সা:-এর ভূষণ। আল্লাহর হুকুম এবং রাসূল সা:-এর জীবন দর্শন মানলে সবখানে শান্তি। উল্লেখ্য, বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর আগে যেসব নবী-রাসূল এসেছিলেন তারা ছিলেন নিজ কওমের বা নির্দিষ্ট কোনো বিশেষ অঞ্চলের লোকদের হেদায়েতের জন্য। তারা সবাই ছিলেন আঞ্চলিক ও জাতীয় নবী। কেউ বিশ্বনবী ছিলেন না। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা: সর্বশেষ নবী ও রাসূল হওয়ার কারণে তার উম্মতের ওপর দ্বীন প্রচারের বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। ইসলাম কোনো জাতির জন্য নয়, কোনো বর্ণের জন্য নয়, কোনো বিশেষ অঞ্চলের জন্য নয়, ইসলাম এসেছে বিশ্বমানবতার মুক্তির জন্য। শ্রেণী, গোষ্ঠী, ভাষা নির্বিশেষে বিশ্বমানবতার মুক্তির দিশারি হিসেবে তাই তিনি বিশ্বনবী, সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও মহামানব। মুহাম্মদ সা:-এর সততা, বিশ্বস্ততা, চিন্তাচেতনা, কর্মদক্ষতা ও ন্যায়পরায়ণতা ছিল অসাধারণ, অনন্যসাধারণ ও ব্যতিক্রমধর্মী। মানবতার মূর্ত প্রতীক হজরত মুহাম্মদ সা: ছিলেন আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে সেতুবন্ধ। মহানবী সা: সর্বাপেক্ষা সফল রাজনীতিবিদ। তিনি ছিলেন শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অতুলনীয় ও অবিসংবাদিত রাষ্ট্রনায়ক। তিনি পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের আলোকে জাতি গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল ও বিশ্বনবী মহামানব হজরত মুহাম্মদ সা:। রাসূল সা:-এর শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ হলো মিরাজ এবং মিরাজ হলো তাঁর একটি বিশেষ মোজেজা। বিশ্বনবী সা:কে আল্লাহ তায়ালা শুধু দু-একটি ছোটখাটো মামুলি উদ্দেশ্য নিয়ে দুনিয়ায় পাঠাননি, বরং বিশ্বমানবতার পরিপূর্ণ কল্যাণের মহতী উদ্দেশ্যেই মহানবী সা: কে এই জগতে পাঠানো হয়েছে। বিশ্বনবীকে বিশ্বজগতের জন্য রহমতস্বরূপ পাঠানো হয়েছে।
ইসলাম আমাদের মানসিক, দৈহিক ও আত্মিকভাবে নৈতিকতার শিক্ষা দেয়। নৈতিকতার শ্রেষ্ঠ উপমা হজরত মুহাম্মদ সা:। তিনি প্রেরিত হয়েছেন সুমহান নৈতিক গুণাবলির (মূল্যবোধ) পূর্ণতা সাধনের জন্য। উল্লেখ্য, মাইকেল এইচ হার্ট বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ জন মনীষীর মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের ক্রমানুসারে হজরত মুহাম্মদ সা: কে সর্বপ্রথম সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। বিশ্বনবী সা:-এর জীবনী লিখতে গিয়ে খ্রিষ্টান লেখক ঐতিহাসিক উইলিয়াম মুর বলেছেন, হজরত মুহাম্মদ সা: যে যুগে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন তাকে শুধু সে যুগেরই একজন মনীষী বলা হবে না বরং তিনি ছিলেন সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষী। আর বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছেন, হজরত মুহাম্মদ সা: ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যার কথা ও কাজের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখা যায়নি।
রবিউল আউয়াল মাসে আমাদের বেশি বেশি মহানবী সা:-এর জীবনাদর্শ নিয়ে আলোচনা এবং এর বাস্তবায়নের চেষ্টা করা উচিত। তাঁর জীবনাদর্শ, চরিত্র ও জীবন দর্শন আমাদের প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণই আলোচনা করে নিজ জীবনে বাস্তবায়ন করতে হবে। রাসূলুল্লাহ সা:-এর চরিত্র বলতে পূর্ণ পাক কুরআনকে বুঝায়। রাসূলের জীবন মূলত কুরআনকেন্দ্রিক। বরং তাঁর জীবন হলো ‘জীবন্ত কুরআন’। তার চরিত্র ও আদর্শ আমরা জীবনে বাস্তবায়িত করতে পারি না বলে আমাদের জীবনে শান্তি আসে না। আমাদের মনে এক, মুখে আর এক। কথার সাথে কাজের মিল নেই বলেই আমরা রাসূলুল্লাহ সা:-এর আদর্শ ও চরিত্র জীবনে বাস্তবায়িত করতে পারি না। আল্লাহ প্রদত্ত একমাত্র জীবনবিধান ইসলামের আলোকে এবং রাসূল সা:-এর রেখে যাওয়া মডেল অনুসারে সমাজ ও রাষ্ট্রের সার্বিক পুনর্গঠনই একমাত্র কাম্য হওয়া উচিত।
লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, কলারোয়া সরকারি কলেজ, সাতক্ষীরা