শেষ পর্যন্ত আমেরিকার জনগণ বিদায় ঘণ্টা বাজিয়ে দিলো ডোনাল্ড ট্রাম্পের। তার জায়গায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে নতুন করে আমেরিকার হাল ধরার ভার নিশ্চিতভাবে পড়ল ডেমোক্র্যাটদলীয় নেতা জো বাইডেনের ওপর। তিনি হবেন আমেরিকার সে প্রেসিডেন্ট যিনি দেশটির ইতিহাসে রেকর্ডসংখ্যক ভোট পেয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। তার এই অভিষেকের মধ্য দিয়ে অবসান ঘটল ট্রাম্পের বহু বিতর্কিত নেতিবাচকতায় ভরপুর চার বছরের আত্মম্ভরী শাসনের। ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ এবং ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ স্লোগানের আড়ালে তার সদ্য সমাপ্ত শাসন সময়ে হোয়াইট হাউজে চর্চিত হয়েছে তার এই আত্মম্ভরী শাসন। এই চার বছরে ট্রাম্প যতবার সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন তার বেশির ভাগই ছিল নেতিবাচক; যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমর্যাদার জন্য ক্ষতিকর, জাতি হিসেবে আমেরিকানদের জন্য গৌরব হানিকর। তার এই নেতিবাচকতা বিস্তৃত ছিল অর্থনীতি, রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি থেকে শুরু করে এমনকি, তার ব্যক্তি জীবনেও। তাই এই পুরো চার বছরই তাকে থাকতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের আর সব প্রেসিডেন্টের তুলনায় সবচেয়ে বেশি মাত্রায় গণমাধ্যমের তীক্ষ্ণ নজরদারিতে। ট্রাম্প এবারের নির্বাচনী প্রচারণায় বাইডেনকে হেয় করার জন্য তাকে ঘিরে বারবার উচ্চারণ করেছেন নানা অগ্রহণযোগ্য বিশেষণ। নির্বাচনী প্রচারাভিযানে তিনি বলেছেন- বাইডেন র্যাডিকেল সোশ্যালিস্ট, করাপ্ট ও ইনএপ্ট বা অযোগ্য। ট্রাম্পের এ ধরনের নেতিবাচক প্রবণতা আমেরিকার জনগণ ভালো চোখে দেখেনি, তা সদ্য সমাপ্ত নির্র্বাচনের ফলাফলই স্পষ্ট করে তুলেছে। তার নেতিবাচকতার শেষ নেই।
ট্রাম্প গোটা বিশ্বকে করে তুলেছেন আগের তুলনায় আরো অনেক বেশি অনিরাপদ। এর একটি উদাহরণ হচ্ছে- তিনি ইরানেরর সাথে পারমাণবিক চুক্তি বাতিল করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি উদ্যোগের পথে সৃষ্টি করেছেন নানা জটিল সমীকরণ। সেখানকার দেশগুলোর মধ্যে বিভাজনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছেন। ইসরাইলের সাথে প্রতিবেশী মুসলিম দেশগুলোর সম্পর্ক উন্নয়নের নামে এসব দেশকে যে পথে ধাবিত করেছেন ট্রাম্প, তার ফলে সেখানে দ্বন্দ্ব-বিগ্রহ আরো তীব্রতা লাভ করেছে। এ ছাড়া বিশ্বের নানা ক্ষেত্রে তিনি নতুন করে যেসব ধ্বংসাত্মক পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে আনা নতুন প্রশাসনের পক্ষে কঠিন হবে। তিনি এই চার বছরের শাসনামলে তার যথেচ্ছাচারের কারণে আস্থা হারিয়েছেন অনেক মিত্রদেশের। তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনা খুব একটা সহজ হবে না নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জন্যও। ট্রাম্প বিশ্ব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শুধু নেতিবাচক পথেই হেঁটেছেন। এর ফলে এরই মধ্যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার যে ক্ষতিটা তিনি করে গেছেন, তা পূরণ করা নিয়ে আছে সংশয়। পরবর্তী প্রেসিডেন্ট তা পুনরুদ্ধার করতে চাইলেও খুব সহজে তা পারবেন বলে মনে হয় না।
ট্রাম্পের পুরো শাসনামলে তিনি ছিলেন বিশ্বের স্বৈরশাসকদের বন্ধু ও লালন-পালনকারী। বিশ্বের তাবৎ অগণতান্ত্রিক স্বৈরশাসক ও কর্তত্বপরায়ণ শাসকদের পাশে থেকেছেন তিনি। উত্তর কোরিয়ার স্বৈরশাসক কিম উনকে তিনি অভিহিত করেছেন একজন ‘রিয়েল লিডার’ হিসেবে। মনে হয়, এ ধরনের শাসকদের নিয়ে নিয়ে তিনি ‘রিয়েলি’ ভালোই ছিলেন। আমাদের সবার জানা, উত্তর কোরিয়া হচ্ছে বিশ্বের নিকৃষ্টতম স্বৈরতান্ত্রিক দেশের উদাহরণ। সেখানে সরকারবিরোধীদের আটকে রাখা হয় শ্রমশিবিরে। আদায় করে নেয়া হয় বাধ্যতামূলক শ্রম। সাথে আছে নির্যাতন-নিপীড়ন। দেশটি শাসন করে একটি পরিবার। শাসক পরিবারের নির্দেশে চলে ভিন্ন মতাবলম্বীদের যখন-তখন হত্যাকাণ্ড। সবই চলে সবার অগোচরে। কারণ, এসব ঘটনার খবর গণমাধ্যমে আসে না।
গণতন্ত্রের প্রতি ট্রাম্পের ঘৃণার আরেকটি সুস্পষ্ট উদাহরণ হচ্ছে তার মধ্যপ্রাচ্য নীতি। ট্রাম্প চেষ্টা চালিয়েছেন তার মধ্যপ্রাচ্য নীতি নতুন করে ঢেলে সাজাতে। পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের মতো মধ্যপ্রাচ্যেও তিনি প্রশান্তি বোধ করেছেন স্বৈরশাসক ও কর্তৃত্বপরায়ণ শাসকদের পাশে থাকতে। তিনি জাপানে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স বিন সালমানকে অভিহিত করেছেন ‘ফ্রেন্ড অব মাইন’ হিসেবে এবং মন্তব্য করেন, বিন সালমান আসলে ‘স্পেক্টেকুলার জব’ সম্পাদন করছেন। তিনি বিন সালমানের সাথে মিলিত হতে পেরে ‘গ্রেট অনার’ ফিল করছেন বলেও জানান। আমরা জানি, সৌদি আরবে গণতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ। দেশটি শাসিত হয় রাজকীয় পরিবার দিয়ে। সেখানে জনগণের ভোটে দেশের শাসক নির্বাচনের ব্যবস্থা অনুপস্থিত। অভিযোগ আছে নানা ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এমনটিও বলেন- আমি সাংবাদিক খাশোগি হত্যার ব্যাপারে খুবই ক্ষুব্ধ। তবে কেউই এ নিয়ে বিন সালমানের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলেনি।’ অথচ নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিন সালমান এই হত্যার আদেশ দেন। জাতিসঙ্ঘের এক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ আছে যে, তিনি এর জন্য দায়ী। তা ছাড়া গত বছর জি-৭ বৈঠকে ট্রাম্প মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ সিসিকে উল্লেখ করেন ‘মাই ফেবারিট ডিক্টেটর’ হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্রের এই মুখ্য মিত্র একটি নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারকে সামরিক কায়দায় সরিয়ে এখন ক্ষমতায়। এই সাক্ষাৎ স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে।
নানা দেশের স্বৈরশাসকদের পক্ষাবলম্বন ছাড়াও তিনি গুরুত্বহীন করে তুলেছেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে। তার চার বছরের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্র অনেক আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকে বের হয়ে যায়। সেই সাথে তিনি অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার প্রাসঙ্গিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। অথচ এসব সংস্থা ঐতিহাসিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ সহায়তার ওপর বরাবর নির্ভর করে আসছিল। ট্রাম্প প্রশাসনের এই নেতিবাচক পদক্ষেপ বহুজাতীয়তাবাদের কার্যকারিতার ওপর নিশ্চিত বিরূপ প্রভাব ফেলে। করোনা মহামারীর মাঝামাঝি সময়ে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) থেকে এবং কোনো প্রমাণ উপস্থাপন ছাড়াই অভিযোগ করেন- এই সংস্থা চীনের স্বার্থ রক্ষা করে চলছে।
ট্রাম্প ২০১৭ সালের জুনে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নেয়ার কথা ঘোষণা করেন। সেই সাথে বলতে থাকেন, যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তিতে ফিরে যাবে, যদি এর শর্তগুলোকে যুক্তরাষ্ট্র, এর ব্যবসায়, এর শ্রমিক, এর জনগণ ও করদাতাদের স্বার্থের অনুকূল করে তোলা হয় কিংবা সম্পূর্ণ নতুন ধরনের এ সংক্রান্ত কোনো চুক্তি করা হয়। ট্রাম্প বলেন, প্যারিস চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর এবং এ চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রকে স্থায়ীভাবে ক্ষতি করে যাবে। তাই এই চুক্তি সংশোধন করতে হবে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি অনুসরণ করে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০১৮ সালে মে মাসে একতরফাভাবে ইরানের সংশ্লিষ্ট পারমাণবিক চুক্তি বাতিল ঘোষণা করেন। ওবামার আমলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানসহ সাতটি দেশ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এই চুক্তিটি ছিল তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার বিদেশনীতির একটি সফল অর্জন। এই চুক্তির মাধ্যমে ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছিল। বিনিময়ে ইরানের ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়েছিল। ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ তার অনেক পশ্চিমা মিত্রের অসন্তুষ্টির কারণ হয়। ইরানের সাথে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো এই চুক্তি লঙ্ঘনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করে। এই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করার পাশাপাশি ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানের শীর্ষ সেনা কমান্ডার কাসেম সোলেইমানিকে হত্যার ঝুঁকি নিতেও দ্বিধা করেননি। আইএসআই ঘোষিত ‘খলিফা’ হত্যার অনুমোদনও দেন ট্রাম্প। অভিযোগ আছে- ইসরাইলের নিরপত্তার স্বার্থে ট্রাম্প প্রশাসন তার পুরো মেয়াদে ইরানকে চাপের মধ্যে রেখেছেন। সেই সাথে তিনি ইসরাইলকে অব্যাহত সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন ফিলিস্তিনি ভূমি দখল করে নতুন নতুন ইহুদি বসতি গড়ায়। এখন ট্রাম তার ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’র মাধ্যমে বলছেন, ফিলিস্তিনকে এসব ইহুদি বসতির এলাকাগুলোতে ইসরাইলের সার্বভৌমত্ব মেনে নিতে হবে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়া এসব প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসযোগ্যতাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ুসংক্রান্ত প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর এলোপাতাড়ি বৃক্ষনিধন বন্ধ করায় আন্তর্জাতিক সমাজের সক্ষমতা নিশ্চিতভাবেই কমে গেছে। ট্র্রাম্পের এই ‘ইউনিলেটারেলিজম’ তথা একলা চলো নীতি অবলম্বনের দীর্ঘমেয়াদি বিরূপ প্রভাব আছে বৈ কি!
যুক্তরাষ্ট্র সুপরিচিত অভিবাসীদের দেশ হিসেবে। কিন্তু ট্রাম্প ছিলেন সবচেয়ে বেশি মাত্রায় অভিবাসনবিরোধী মনোভাবসম্পন্ন প্রেসিডেন্ট। গত চার বছরে তিনি সীমান্তে ৪০০ মাইলেরও বেশি নতুন দেয়াল নির্মাণ করেছেন। আর অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় সীমান্ত-নিরাপত্তা জোরদার করে তোলাকে তিনি নিজের সাফল্য হিসেবে বেশি প্রচার করেছেন। ট্রাম্পের কট্টরপন্থী সমর্থকরা এই নীতির প্রশংসা করলেও, অনেকেই এর সমালোচনা করেছেন। তার আমলেই অভিবাসীদের ৪ শতাধিক শিশুকে তাদের মা-বাবা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। ৫ শতাধিক শিশু এখনো তাদের বাবা-মাকে খুঁজে পায়নি। শিশুদের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের এই অমানবিক পদক্ষেপ বিশ্বব্যাপী প্রবল সমালোচিত হলেও কট্টর অভিবাসনবিরোধী ট্রাম্প তার অবস্থান থেকে একটুও নড়েননি। তা ছাড়া ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর অভিবাসন নীতির কারণে বহু অভিবাসীকে আমেরিকা ছাড়তে হয়েছে। তার আমলে নতুন করে আমেরিকায় নাগরিকত্ব পাওয়া মানুষের সংখ্যা কমেছে। বাইরের দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশেও ছিল কড়াকড়ি। অপরদিকে নতুন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের প্রতিশ্রুতি হচ্ছে আনডকুমেন্টেড অর্থাৎ কাগজপত্রবিহীন অভিবাসীদের বৈধ অভিবাসী করা।
সবাই জানেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রবলভাবে ইহুদি তথা ইসরাইল-প্রেমী, অন্য কথায় ইসরাইলের বেপরোয়া সমর্থক। তার বিগত চার বছরের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্র জেরুসালেমকে এককভাবে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং তেলআবিব থেকে জেরুসালেমে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস স্থাপন করে। ট্রাম্প এবারের নির্বাচনকালে প্রচার করে বেড়িয়েছেন, এটি যুক্তরাষ্ট্রের ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টানদের একটি বড় বিজয়।
ফিলিস্তিনি অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনে ছিল তার সক্রিয় সমর্থন। তার শাসনামলে তিনি ও তার জামাতা জ্যারেড কুশনারের কলকাঠি নাড়াচাড়া, কূটনৈতিক দৌড়ঝাঁপ আর ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার পর শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চলতি বছরের জানুয়ারির শেষ দিকে ঘোষণা করেন তার দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ও বহুল আলোচিত ‘মিডল ইস্ট পিস প্ল্যান’। অনেকের মতে, এটি আসলে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে অশান্তি সৃষ্টির এক ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা। তাদের মতে, ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা কখনোই মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনবে না। বরং এটি কাজ করবে অশান্তি সৃষ্টি ও পরিস্থিতিকে আরো উত্তপ্ত করে তোলার নয়া জ্বালানি হিসেবে। এই পরিকল্পনায় প্রস্তাব করা হয়েছে, অবিভক্ত জেরুসালেম হবে এককভাবে ইসরাইলের রাজধানী। ফিলিস্তিন হবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, তবে পশ্চিম তীরের বিতর্কিত অবৈধ ইহুদি বসতিগুলোর ওপর ইসরাইলের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নিতে হবে ফিলিস্তিনকে। হোয়াইট হাউজে ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু পাশাপাশি দাঁড়িয়ে এই পরিকল্পনা ঘোষণার সময় ট্রাম্প বলেন, এই প্রস্তাব ‘হতে পারে ফিলিস্তিনিদের জন্য সর্বশেষ সুযোগ’। তার এ ধরনের মন্তব্যের সারমর্ম হচ্ছে- হয় ফিলিস্তিন এই পরিকল্পনা মেনে নেবে, নয়তো ফিলিস্তিনে ইসরাইলি দখলদারিত্ব অব্যাহতভাবে চলবে।
বস্তুত ট্রাম্প তার শাসনের শুরুতেই ঘোষণা দিয়েছিলেন পূর্ববর্তী ‘দুই রাষ্ট্র’ তত্ত্ব ফিলিস্তিনকে ভুলে যেতে হবে। এর পরেই তিনি নেমে পড়েন ইসরাইলের স্বার্থ শতগুণে বাড়িয়ে তোলার নানামুখী তৎপরতায়। এ তৎপরতায় তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন তার জামাতা কুশনার। অস্বীকার করার উপায় নেই- তার সর্বশেষ ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’র মাধ্যমে তিনি ফিলিস্তিন সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানকে আরো জটিল করে তুলেছেন। জানি না, বাইডেন কী করে এই জটিলতার অবসান ঘটিয়ে ইসরাইল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাবেন সব মহলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি ন্যায়ভিত্তিক পরিকল্পনার মাধ্যমে। তবে এ ধরনের পদক্ষেপে তাকে ট্রাম্পের মতো অন্ধ ইহুদি প্রেম-প্রবণতা থেকে অপরিহার্যভাবে বেরিয়ে এসে নিরপেক্ষ অবস্থান নিতে হবে।
আমেরিকার যেকোনো প্রেসিডেন্টের তুলনায় ট্রাম্প ছিলেন সবচেয়ে কম শুদ্ধাচারী প্রেসিডেন্ট। সে জন্য কেউ কেউ বলছেন- ট্রাম্প হচ্ছেন আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি মাত্রার ‘নর্ম-স্যাটারিং’ প্রেসিডেন্ট। তিনি তার শাসনামলে বরাবর ভেঙে চুরমার করে চলেছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্টদের যাবতীয় শিষ্টাচার। এমনকি নির্বাচন কালটিতেও তিনি তার এই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। নির্বাচনের দিনের রাতের ভাষণে তিনি কয়েক দফা প্রমাণহীন মিথ্যা অভিযোগ করেন, যা সমালোচনার মুখে পড়ে এমনকি তার দলের অনেক নেতার। এসব অগ্রহণীয় অভিযোগ নিয়ে আদালতেও যান, প্রয়াস চালান এবারকার নির্বাচনের ভোট গণনা বন্ধ রাখার। বিতর্কিত করার প্রয়াস চালান দেশটির নির্বাচনী ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে। তা ছাড়া অভিবাসীদের ৪ শতাধিক শিশুকে তাদের মা-বাবা থেকে বিচ্ছিন্ন করা, ইসরাইলের সব অমানবিক কর্মকাণ্ডের প্রতি সক্রিয় সমর্থনসহ ট্রাম্পের নানা অমানবিক পদক্ষেপ তাকে অজনপ্রিয় করে তোলে যুক্তরাষ্ট্রসহ নানা দেশের উদার ও শান্তিবাদী মানুষের কাছে।
ট্রাম্পের কট্টর সমর্থকদের দাবি : প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ স্লোগান বাস্তবায়নে ছিলেন বরাবর আপসহীন। তার মুখ্য বিবেচ্য ছিল ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি। কিন্তু বিবেকবান মানুষ মনে করে : ট্রাম্পের সর্বব্যাপী নেতিবাচক ভূমিকা পালনের নীতি দ্বারা আমেরিকাকে করে তোলা হয়েছে গোটা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। মানবিক ন্যায়নীতি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে দূরে সরিয়ে আনা হয়েছে। ট্রাম্প তার এই চার বছরের শাসনে ধ্বংস করে গেছেন আমেরিকার ‘গ্রেটনেস’। এর বাইরে তার পুরো শাসনামলেই জারি রেখেছেন নেতিবাচক কর্মকাণ্ড, যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য যেমন কোনো উপকার বয়ে আনেনি, তেমনি উপকার পায়নি মানবজাতি। তার ভুল পদক্ষেপের কারণে থেমে গেছে বিশ্বের নানা অঞ্চলের শান্তি প্রয়াস। তিনি বিভিন্ন শান্তি প্রয়াসকে করে তুলেছেন আরো জটিল। এ কারণে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের মানুষের কাছে তিনি এখন পরিচিত আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে নেতিপ্রবণ প্রেসিডেন্ট হিসেবে। তার যাবতীয় নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি নিজের জন্য যেমনি কুড়িয়েছেন নিন্দা, তেমনি বিনষ্ট করেছেন তার দলের ও আমেরিকার ভাবমর্যাদা। তিনি তার একগুঁয়ে নীতি নিয়ে চলে পরবর্তী প্রেসিডেন্টের কাজকেও করে গেছেন কঠিনতর। তছনছ করে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সবকিছু। যুক্তরাষ্ট্র নামের রাষ্ট্রিক কাঠামো লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। সৃষ্টি হয়েছে নানা ধরনের ক্ষত। এখন জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী বাইডেনকেই তার দেশকে বের করে আনতে হবে নেতিবাচকতা থেকে। মোট কথা, তাকে নামতে হবে আমেরিকা মেরামতে। সারিয়ে তুলতে হবে ট্রাম্পসৃষ্ট দগদগে নানা ক্ষত; সে কাজ যতই কঠিন হোক। তবেই তিনি আমেরিকানদের আজকের ভালোবাসার প্রতিদানে সফল হতে পারবেন। তিনি যেন এতে সফল হন, সে কামনাই আমেরিকান জনগণের পাশাপাশি আমাদেরও।