একটি বিশ্বমারীর (Pandemic) শেষ কোথায়? উত্তরটা আসলে কারোই জানা নেই। এর আগে ১৯২০ এ এসেছিল স্প্যানিশ ফ্লু, ১৮২০ এ কলেরা, ১৭২০ এ প্লেগ। শতবর্ষী মহামারীর এক অদ্ভুত চক্রের একবিংশ শতাব্দীর অনুপ্রবেশকারী প্রতিনিধি কোভিড-১৯। অষ্টাদশ, উনবিংশ আর বিংশ শতাব্দীর সাথে একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের কতো গুলো মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। যাতায়াত ব্যাবস্থার উন্নতির সুবাদে কয়েক মাসের যাত্রা এখন কয়েক ঘন্টায় সেরে ফেলা যায়। মানুষের এই দ্রুত গতির সাথে রোগ বিস্তারের গতিও তাই বেড়েছে একইভাবে। অতি দ্রুত সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে একটি মহামারী এখন বিশ্বমারীতে রূপ নিয়েছে। মানুষ বা রোগবিস্তারের গতির চেয়েও দ্রুত হয়েছে এখন তথ্য আদানপ্রদানের গতি।
পৃথিবীর এক প্রান্তে সংঘটিত ঘটনা নিমিষেই ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। স্বাভাবিক কারণেই এবারের মহামারীর বিস্তার এবং এর বিরুদ্ধে মানবসমাজের প্রতিক্রিয়াটাও হয়েছে পুরোপুরি ভিন্ন মাত্রায়। কিন্তু এই দূর্যোগের শেষ কোথায়?
তত্বগতভাবে কয়েকভাবে কোভিড বিশ্বমারীর সমাপ্তি আসতে পারে। আরএনএ ভাইরাস জীনের মিউটেশনের মাধ্যমে দ্রুত চেহারা পরিবর্তণ করে। আবার একের পর এক আক্রমণ চালিয়েও কয়েক প্রজন্ম পরে ভাইরাসটি দূর্বল হয়ে যেতে পারে। এভাবে এক সময় ভাইরাসটি আক্রমণ বা ক্ষতি করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে। যেমনটা ঘটেছে এক সময়ে ত্রাস সৃষ্টিকারী সার্স (SARS) ভাইরাসের ক্ষেত্রে। আবার ভাইরাসের বিরুদ্ধে গৃহীত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাসমূহ যেমন মাস্ক ব্যবহার, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, হাত ধোয়া, লকডাউন ইত্যাদির কারণে ভাইরাস বিস্তারের গতি একটি ক্রিটিক্যাল লেভেলের নীচে নেমে যেতে পারে। তবে বিশ্বব্যাপী মানুষের যে আচরণ, তাতে এ রকম কিছু ঘটার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সবচেয়ে বাস্তব সম্মত যে সমাধান হতে পারে তা হল এক বা একাধিক কার্যকর ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের মাধ্যমে একট উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলা। তাই কোভিডের বিরুদ্ধে কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরীর জন্যে বিদ্যমান পদ্ধতির পরিবর্তে সংক্ষিপ্ত পথে দ্রুত সাফল্য অর্জনের চেষ্টা করা হয়েছে। ভ্যাকসিন তৈরীর সনাতন পদ্ধতিতে যেখানে আট থেকে দশ বছর লাগে সেখানে মাত্র কয়েক মাসে নানা দেশে দেড়শোর বেশি ভিন্ন ভ্যাকসিন তৈরীর কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। এর মধ্যে কয়েকটি ভ্যাকসিন এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে গেছে।
কোভিড নিয়ে শুধু দুঃসংবাদ চারিদিকে। সবারই চেনাজানার মধ্যে আক্রান্ত আর মৃত্যুর খবর। একের পর এক দেশ দ্বিতীয় ঢেউ এর ধাক্কায় কুপোকাত। এ মহাদূর্যোগের মাঝে গত ক’দিনে কয়েকটা ভাল সংবাদ পাওয়া গেছে। এ খবরগুলো হয়তো বদলে দেবে কোভিডের বিরুদ্ধে মানবজাতির সংগ্রামের দিগন্ত।
১) কোভিডের বিরুদ্ধে ৯০% এর বেশি কার্যকর একাধিক ভ্যাকসিন এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্না, অক্সফোর্ড-এস্ট্রোজেনেকা, সিনোভ্যাক, স্পুটনিক-৫ অনেকগুলো ভ্যাকসিন এখন ব্যবহারের জন্য তৈরী। আগামী ১০ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভ্যাকসিন ব্যবহার অনুমোদনের জন্য এফডিএ বৈঠকে বসছে। অনুমোদনের পরদিন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সব কটি অঙ্গরাজ্যে তা প্রয়োগ আরম্ভ করে ডিসেম্বরে ২ কোটি এবং জানুয়ারী থেকে প্রতি মাসে ৩ কোটি মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। তারা আশাবাদী যে এর মাধ্যমে ২০২১ সালের মাঝামাঝি কোভিড মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে আসবে।
তবে সতর্কতা প্রয়োজন যে এই সব ভ্যাকসিন কতোদিন কার্যকর থাকবে সে সম্পর্কে কারো জানা নেই। কয়েক মাস সময়ে যে ভ্যাকসিনের জন্ম সেটার কার্যকারিতার মেয়াদ জানতে স্বাভাবিকভাবেই কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে। তাছাড়া সব ভ্যাকসিনের মতো এসব ভ্যাকসিনও স্বল্প সংখ্যক গ্রহীতার দেহে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। এ বিষয়েও আমাদের এখন পর্যন্ত আমাদের জানা সীমিত। কোন কোন ভ্যাকসিন মাইনাস ৭০ থেকে মাইনাস ৮০ ডিগ্রী তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়, সেটির অবকাঠামো তৈরী একটি ব্যায়সাধ্য প্রক্রিয়া। ভ্যাকসিন ভেদে খরচ বাংলাদেশী মূদ্রায় পাঁচ শত থেকে ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে। তবে আশা করা যায় যে এসব সীমাবদ্ধতা সত্বেও শীঘ্রই এক বা একাধিক ভ্যাকসিন কোভিডের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলবে।
২) ভ্যাক্সিন ছাড়াও মনোক্লোনাল এন্টিবডি রিজেনেরন (Regeneron) যা দিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চিকিৎসা দেয়া হয়েছিল, তা সম্প্রতি এফডিএর অনুমোদন পেয়েছে। এটি কোভিড চিকিৎসায় সহায়তা করতে পারে।
৩) সবশেষ গবেষণায় কোভিড চিকিতসায় রেমডিসিভির বা অন্য এন্টিভাইরালের কার্যকারিতার প্রমাণ পাওয়া যায় নি। আশা করা যায় এর ফলে অযথা এন্টিভাইরাল ঔষধ নিয়ে প্রীতি ও বিভ্রান্তি দূর হবে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার হাত থেকে রোগীরা রক্ষা পাবে।
৪) অক্সফোর্ডের এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আক্রান্তদের কোভিডের বিরুদ্ধে ইমিউনিটি কয়েক মাস কার্যকর থাকছে, হয়তো আরো দীর্ঘকাল। দ্বিতীয় দফা আক্রান্ত হবার হার খুবই নগন্য। এটি একটি আশার কথা।
৫) সহজে ব্যবহার উপযোগী দ্রুত পরীক্ষার কিট অনুমোদন পেতে যাচ্ছে। এর ফলে রোগ নির্ণয়ের কাজটি অনেক সহজ হয়ে যাবে।
এই সব সুসংবাদ আমাদের আশাবাদী করে তুলছে যে আগামী বছরের মাঝামাঝি নাগাদ কোভিড হয়তো অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসবে। কিন্ত ততদিন পর্যন্ত টিকে থাকার জন্য এ মুহূর্তে মাস্ক ব্যবহার, দূরত্ব বজায় রাখা এবং হাত ধোয়ার কোন বিকল্প নেই। এ বিষয়ে নিজে সচেতন হই এবং অন্যদের সচেতন করি।
মহান আল্লাহ আমাদের এই মহামারী ও যাবতীয় বালামুসিবত থেকে রক্ষা করুন।
[লেখকঃ বিভাগীয় প্রধান, কার্ডিয়াক সার্জারী বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল]