২০১৭ সালের জানুয়ারি। ডোনাল্ড ট্রাম্প তখন সবে ক্ষমতা নিয়েছেন। তার ক্ষমতা গ্রহণের আগে থেকেই আমেরিকায় এবং এর বাইরে একটা আলোচনা কিছুটা মাথাচাড়া দিচ্ছিল। নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে যা বলেছেন এবং দেশের ভেতরে যা যা করবেন বলছিলেন, সেগুলোর সব করবেন তিনি? কিংবা চাইলেও করতে পারবেন তিনি? সবকিছু করলে রাষ্ট্র হিসেবে আমেরিকার অনেক বড় পরিবর্তন হয়ে যেত।
পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে মার্কিন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো খুব বড় বাধা হওয়ার কারণ ছিল না। প্রশ্ন ছিল, দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ট্রাম্প তার নীতি কতটা বাস্তবায়ন করতে পারবেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতার মেয়াদের শেষ অংশে দাঁড়িয়ে এখন আমরা বলতেই পারি, বহির্বিশ্বে মার্কিন নীতির একটা বড় ধরনের পরিবর্তন ট্রাম্পের হাতে হয়েছে। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে যাচ্ছেতাই হয়নি। না, এটি এজন্য নয় যে তিনি নির্বাচনে জেতার জন্য কথার কথা বলেছেন, আর নির্বাচিত হওয়ার পর সেসব থেকে সরে এসেছেন।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য কথার কথা হিসেবে তিনি সবকিছু বলেছেন তা মোটেও নয়, ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তিনি অনেক কিছু তার মতো করে করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেই ট্রাম্প সফল হতে পারেননি। উল্লেখযোগ্য দুই-একটি ঘটনা একটু দেখে নেয়া যাক।
ট্রাম্প আমেরিকার রাজনীতিতে পরিচয়বাদী রাজনীতিকে প্রকাশ্য করেছেন। ক্ষমতায় এসেছিলেন শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী রাজনীতিকে অবলম্বন করে। এ রাজনীতির সঙ্গে আমেরিকায় ইমিগ্রেশনের সরাসরি সংঘাত রয়েছে। তাই আমেরিকায় বৈধ ইমিগ্রেশনের সংখ্যা যতটা সম্ভব কমিয়ে আনা ছিল ট্রাম্পের খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রাধিকার।
শৈশবে আমেরিকায় চলে আসা অনেক ছেলেমেয়ের বৈধ ইমিগ্রেশনের কাগজপত্র না থাকা সত্ত্বেও ওবামা সরকারের সময় Deferred Action on Childhood Arrivals (DACA) নামে একটা প্রোগ্রামের অধীনে তাদের আমেরিকায় থাকার বৈধতা দেয়া হয়েছিল। ট্রাম্প সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন এ প্রোগ্রামটি বাতিল করার। কিন্তু সুপ্রিমকোর্ট এক রায়ে এ প্রোগ্রামটি বহাল রাখেন। এতে আট লাখেরও বেশি ছেলেমেয়ে আমেরিকায় থেকে যেতে পারবে।
ট্রাম্প চেয়েছিলেন আমেরিকান আদমশুমারি থেকে বৈধ কাগজপত্র ছাড়া ইমিগ্র্যান্টদের বাদ দিতে। কিন্তু এক্ষেত্রেও মার্কিন আদালত রায় দেন, ট্রাম্পের এ পদক্ষেপ অবৈধ। আমেরিকায় ইমিগ্রেশনের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে গিয়ে এভাবেই ট্রাম্প বারবার ব্যর্থ হয়েছেন।
করোনার সময় বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রণোদনা দেয়ার জন্য ট্রাম্প ১.৮ ট্রিলিয়ন ডলারের একটি প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন। সেটার পরিমাণ এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে বরাদ্দের অনুপাত নিয়ে মতদ্বৈধতায় কংগ্রেসের উভয় কক্ষ হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভস ও সিনেটের মধ্যে কেউ সেটি অনুমোদন করেনি।
এখানে খুবই উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, মার্কিন সিনেটে ট্রাম্পের পুরো সময়টাতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল তার দল রিপাবলিকান সদস্যদের। নিজ দলের কিছু সিনেটর তার বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে প্রস্তাবকে বাতিল করেছেন।
এমন উদাহরণ আরও বেশকিছু দেয়া যায়; কিন্তু লেখার কলেবর সীমিত রাখার স্বার্থে এ আলোচনা আর দীর্ঘায়িত না করে আমরা বরং চলে যাই সাম্প্রতিককালে অতি আলোচিত মার্কিন নির্বাচন প্রসঙ্গে। এ সময়ে মার্কিন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে কাজ করেছে সেটা একটু দেখে নেয়া যাক।
নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছিল ডোনাল্ড ট্রাম্প দফায় দফায় বলছিলেন, ডেমোক্র্যাটরা নির্বাচনে কারচুপি করবে এবং সেটার মাধ্যমে তাকে জোর করে হারিয়ে দেয়া হবে। তিনি এটিও বলছিলেন, নির্বাচনের ফল তার মনঃপূত না হলে সেটার বিরুদ্ধে তিনি আইনগত ব্যবস্থা নেবেন।
নির্বাচনের দেড় মাস বাকি থাকা অবস্থায় মার্কিন সুপ্রিমকোর্টের একজন বিচারপতি রুথ গিন্সবার্গ মারা যান। ডেমোক্র্যাট পার্টি মনোনীত গিন্সবার্গ একজন উদারপন্থী বিচারক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার মৃত্যুতে সুপ্রিমকোর্টে একটি বিচারকের পদ খালি হয়।
ডেমোক্র্যাট শিবিরসহ আমেরিকার অনেকে যৌক্তিকভাবেই বলেছিলেন, যেহেতু সামনেই একটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আছে, তাই নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে এখতিয়ার থাকলেও ট্রাম্পের উচিত হবে না নতুন কাউকে সেই পদে নিয়োগ দেয়া।
কিন্তু ট্রাম্প তার চরিত্রের প্রতি ‘সুবিচার’ করেছেন- অতি রক্ষণশীল অ্যামি কনি ব্যারেটকে বিচারপতি হিসেবে সুপ্রিমকোর্টে নিয়োগ দেন। এতে সুপ্রিমকোর্টের নয়, বিচারকদের মধ্যে রক্ষণশীল আর উদারপন্থী বিচারকের অনুপাত দাঁড়ায় ৬:৩। ট্রাম্পের এ নিয়োগের মূল উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচনের ফলাফল তার মনঃপূত না হলে যাতে কোর্টে গিয়ে সেই ফল তার পক্ষে নিয়ে আসতে পারেন। সফল হবেন কি তিনি?
নানাভাবে চেষ্টা করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। বেশ কয়েকটি রাজ্যে তার পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছে। পেনসিলভানিয়া রাজ্যে ট্রাম্প শিবিরের মেইল ব্যালটসংক্রান্ত মামলা খারিজ করে দেন আপিল আদালত। মিশিগানে নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ এনে করা মামলা ভিত্তিহীন জানিয়ে খারিজ করা হয়।
অ্যারিজোনায় করা মামলায় পরাজয় নিশ্চিত হওয়ায় মামলা থেকে সরে আসে ট্রাম্পের দল। এ ব্যাপারে আর বিচারকের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই বলে মন্তব্য করেন ট্রাম্পের আইনজীবী।
ট্রাম্পের অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার ১৬ জন ফেডারেল প্রসিকিউটরকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি, জালিয়াতি, অনিয়মের তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য। তারা সবাই লিখিত পত্রে জানিয়েছেন, নির্বাচনে অনিয়মের কোনো ঘটনার প্রমাণ তারা পাননি। এখানেও ট্রাম্প রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে তার পক্ষে কাজে লাগাতে পারেননি।
ট্রাম্পের নির্বাচনে জালিয়াতির প্রপাগান্ডা এরপরও থামেনি। কিন্তু তাতে খুব শক্তভাবে বাধা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ও স্টেট কর্মকর্তাদের একটি জোট। ইলেকশন ইনফ্রাস্ট্রাকচার গভর্নমেন্ট কো-অর্ডিনেটিং কাউন্সিল ও সেক্টর কো-অর্ডিনেটিং এক্সিকিউটিভ কমিটির এ জোট এক যৌথ বিবৃতিতে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার সহযোগীদের নির্বাচন নিয়ে জালিয়াতির দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে।
এক বিবৃতিতে জোট জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট নিয়ে সমঝোতা বা ভোটের ফলাফলের পরিবর্তন করার কোনো প্রমাণ তাদের কাছে নেই। বিবৃতিতে এবারের ৩ নভেম্বরের নির্বাচনকে আমেরিকান ইতিহাসের সবচেয়ে সুরক্ষিত নির্বাচন হিসেবে দাবি করেছেন তারা।
এছাড়াও নির্বাচনের সময় অনলাইনে নানা মিথ্যা প্রচারণার বিরুদ্ধে কাজ করেছে সাইবার সিকিউরিটি ও ইনফ্রাস্ট্রাকচার সিকিউরিটি এজেন্সি (সিসা)। অনিবার্যভাবেই তাদের কাজের প্রধান প্রভাব পড়েছে ট্রাম্পের প্রচারণার ওপরে। এর জেরে ট্রাম্পের হাতে চাকরি হারাতে হয়েছে ওই প্রতিষ্ঠানের সহকারী পরিচালককে এবং প্রধান ক্রিস ক্রেবসকে। চাকরিচ্যুত হয়েছেন ক্রিস ক্রেবস; কিন্তু দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন, নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সব অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন।
একটা রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যখন স্বাধীন হয় এবং তারা তাদের মতো করে কাজ করে যেতে পারে, তখন সেই রাষ্ট্রের গণমাধ্যমও সাহসী হয়; দায়িত্ব পালন করতে কুণ্ঠিত হয় না। নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে ৫ নভেম্বর ট্রাম্পের ভাষণ প্রচার শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে নির্বাচনে কারচুপি ও জালিয়াতি নিয়ে মিথ্যাচারের দায়ে সম্প্রচার বন্ধ করে দেয় সব টিভি নেটওয়ার্ক এবং সামাজিক মাধ্যম।
অনেক মিডিয়াই ঘোষণা করেছিল- এ ভাষণ ছিল সর্বকালের সবচেয়ে অসৎ ভাষণ। গণমাধ্যমগুলো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নয়; কিন্তু গণতন্ত্রের অলিখিত চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে গণমাধ্যম সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এটিও শক্তিশালী আচরণ করতে পারে, সুষ্ঠুভাবে কর্তব্য পালন করতে পারে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের শক্তিতেই। এ প্রসঙ্গে আমরা স্মরণ রাখব, ট্রাম্পের সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা মুখের ওপর তার মিথ্যা বলার পরিসংখ্যান দিয়ে তার মিথ্যাচারকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন।
মধ্যযুগীয় সম্রাট শাসিত রাজ্যগুলোর সঙ্গে আধুনিক, কার্যকর রাষ্ট্রের পার্থক্য নিশ্চয়ই অনেক। কিন্তু যদি জিজ্ঞাসা করা হয়- একেবারে মৌলিক পার্থক্য কোনটি? আমার বিশ্বাস এর উত্তর হবে- একটা আধুনিক কার্যকর রাষ্ট্রে সেপারেশন অব পাওয়ার থাকে। একটা আধুনিক রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ এবং বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করে। প্রতিটি বিভাগের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় তার অধীনস্থ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে।
আজ থেকে ৮০০ বছর আগে ম্যাগনাকার্টা সেপারেশন অব পাওয়ারের প্রথম মাইলফলকটি তৈরি করেছিল। ক্রমবিকাশের মাধ্যমে আজ একটা রাষ্ট্রব্যবস্থা এ জায়গায় এসে পৌঁছেছে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার দীর্ঘ পথপরিক্রমায় এটি খুব স্পষ্টভাবে দেখা গিয়েছিল যে, সেই রাষ্ট্রটিই সবচেয়ে ভালোভাবে টিকে থাকে এবং তার নাগরিকদের স্বার্থের পক্ষে কাজ করতে পারে, যার প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করে।
ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে আমেরিকাকে তার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে পরিচালনা করতে চেয়েছেন; কিন্তু পেরে ওঠেননি পুরোপুরি। তারপর তার সেই রাষ্ট্রপরিচালনার পদ্ধতি যেহেতু মানুষ পছন্দ করেনি, তাই তারা নির্বাচনে তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। সেখানেও নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানগুলো সেই নির্বাচনকে সুষ্ঠুভাবে হওয়া নিশ্চিত করেছে। সেটাও মেনে নিতে চাননি ডোনাল্ড ট্রাম্প। ভেবেছিলেন সুপ্রিমকোর্টের রক্ষণশীলদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাধিক্য তাকে কোর্টে গিয়ে নির্বাচনী ফল পাল্টে দিতে সাহায্য করবে। হয়নি সেটাও।
ট্রাম্পের ক্ষমতায় আসা এবং ক্ষমতা থেকে চলে যেতে বাধ্য হওয়া পৃথিবীতে দীর্ঘকাল নানারকম বিশ্লেষণের বিষয় হয়ে থাকবে। ট্রাম্পের সময়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে কাজ করেছে, সেটা আমাদের মতো দেশের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে থাকবে। আমরা আলোচনা করব কীভাবে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করার ফলে একজন ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত আমেরিকার গণতন্ত্রকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে ব্যর্থ হয়েছেন। শক্তিশালী, স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ছাড়া জনসংখ্যাসহ একটা ভূখণ্ড বড়জোর মধ্যযুগীয় সাম্রাজ্য হতে পারে, আধুনিক রাষ্ট্র নয়।
ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা : সংসদ সদস্য, বিএনপি