উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ব্যাপারটি প্রতিবছরের মতো এবারও সামনে চলে এলো। পরীক্ষা না নিয়েই কোবিড-১৯ কালে উচ্চমাধ্যমিক পাসের সার্টিফিকেট পাবে পরীক্ষার্থীরা। সারা পৃথিবীর এই ক্রান্তিকালে এমন সিদ্ধান্ত বাধ্য হয়েই নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অনেকে অবশ্য বলেছেন, বিষয়-সংখ্যা কমিয়ে পরীক্ষা গ্রহণ করা যেত। হ্যাঁ, যেত। কিন্তু তাতে মারাত্মক হতে পারত রোগের সংক্রমণ। কারণ প্রায় পনেরো লাখ পরীক্ষার্থীর এ পরীক্ষায় অভিভাবকসহ প্রায় তিরিশ লাখ মানুষ পরীক্ষার দিন অতিরিক্তভাবে রাস্তায় নেমে আসেন।
শহরে জনঘনত্ব বেশি বলে সেখানে রোগ সংক্রমণের ভয়ও বেশি। আবার শহরে পরিবারে সন্তানসংখ্যাও সীমিত; কোনো কোনো পরিবারে একটি বা দুটি। যে পরিবারে এক বা দুজন সন্তান, তাদের একজন করোনা আক্রান্ত হলে উপায় কী? সত্যটা ভেবে দেখি একটু। এমনিতেই শহরের এই ছেলেপুলেগুলো কায়িকশ্রম বা খেলাধুলার সুযোগের অভাবে গ্রামের ছেলেপুলেদের তুলনায় শক্তি-সামর্থ্যে যেন একটু পিছিয়ে। দৌড় প্রতিযোগিতা অথবা মল্লযুদ্ধ খেলায়ও এর খুব ভালো প্রমাণ পাওয়া যায়। এ অবস্থায় শহরে কোনো ছেলেমেয়েকে কোবিড ভাইরাস আক্রমণ করলে তার জন্য কঠিনই হবে রোগ মোকাবিলা করা। গ্রামের ছেলেমেয়েদের শক্তসামর্থ্য মনে হলেও রোগের কাছে নিশ্চয় তারাও দুর্বল। এ অবস্থায় উল্লিখিত পনেরো লাখ তরুণকে ঝুঁকিমুক্ত রেখে পরীক্ষার ফল প্রদান করায় এমন কিছু ক্ষতি হয়নি।
গত কয়েক বছরে দেখা গেছে, যারা জেএসসিতে ভালো ফল করেছে এসএসসিতেও তাদের ফল সমধারায়। এসএসতিতে যে ফল করেছে, কিছু ছেলেমেয়ের ফল বিপর্যয় ছাড়া এইচএসসিতেও তারা প্রায় সে ফলই করেছে। তা হলে এই পদ্ধতিতে ফল বিপর্যয় হতে পারত এমন অল্প কিছু ছাত্রছাত্রীর লাভ হলো। হোক। ক্ষতি তো হয়নি। একেই বলে ‘উইন উইন সিচুয়েশন’। কোভিড আক্রমণ থেকেও রেহাই মিলল, সবাই খুশিও হলো। কিন্তু এই খুশিটি ধরে রাখতে হলে তাদের ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করতে হবে। যদি ভালো না করে, যদি তারা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ না পায়, তা হলে লোকে কিন্তু বুঝে যাবে তাদের পাসের ফাঁক। ধরা তাদের পড়তেই হবে। ফলে উচ্চমাধ্যমিকে এবারের ফল প্রদান নিয়ে আর প্রশ্ন মনে না রাখাই ভালো।
একটি তথ্য জেনে সবাই আনন্দিত হবেন। গবেষণা করে আমি দেখেছি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলে আমাদের দেশে এখন প্রতিদিন গড়ে আঠারো কোটি শিক্ষা-ঘণ্টা লেখাপড়া হয়। শিক্ষার্থী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর পরিমাণটাও বাড়বে আগামী বছরগুলোতে। আবার আতঙ্ক আছে! আতঙ্ক হলো : এই কোভিডকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রতিদিন আঠারো কোটি শিক্ষা-ঘণ্টা লেখাপড়া হয়নি। এটা ক্ষতি। অবশ্য এই ক্ষতি বিশ্বব্যাপীই হয়েছে। কিন্তু উন্নত বিশ্ব যেভাবে এটি প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে অনেকটা পুষিয়ে নিচ্ছে, আমাদের পক্ষে সেভাবে সম্ভবপর হচ্ছে না। প্রতিদিন এই আঠারো কোটি শিক্ষা-ঘণ্টা লেখাপড়ার ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা সত্যি কঠিন। তা ছাড়া এই সময়ে ছাত্রছাত্রীদের যে ‘মাইন্ড সেটআপ’ তৈরি হয়েছে, তা থেকে বের করে আনতেও বেগ পেতে হবে। বিশেষ করে, স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে তাদের যে অভ্যাস গড়ে উঠছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আবার খুললে তাদের হাত থেকে সেই ফোনসেট ফেরত নেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। যা হোক : সংকট আছে, এ থেকে পরিত্রাণের উপায়ও বের করতে হবে।
কথা হচ্ছিল উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে। অনেক ঢাকঢাক গুড়গুড় করার পর অবশেষে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মধ্যস্থতায় সরকারি অনুদানভোগী উনিশটি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো : ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। সিদ্ধান্তটি সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। সফলতার ওপর এই পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণে আগ্রহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশা করি। কিন্তু শুরু হলো, এটাই আনন্দের কথা। এখানে সাধারণ এবং বিজ্ঞান-প্রযুক্তি দুই ধারার বিশ্ববিদ্যালয়ই আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন এ পদ্ধতিতে যাচ্ছে না, অনেকে এই তর্ক তুলেছিলেন এবং তা নিয়ে সময়ও ক্ষেপণ হয়েছে বেশ। কিন্তু তারা ভাবতে চাননি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েই কেন শুরু করতে হবে? এই নিবন্ধ লেখার সময় (ডিসেম্বর ২০২০) আমি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ওয়েবসাইটে গিয়ে সরকারি অনুদানভোগী ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়’ তালিকায় ছেচল্লিশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পেলাম। অবাক করার ব্যাপার, এই ছেচল্লিশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কয়েকটির এখনো ওয়েবসাইটই নেই! এতেই অনুমান করা যায়, এগুলোর ভেতরের অবস্থা কী। তা হলে? একশ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এই সেদিন প্রতিষ্ঠিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব দিক থেকে পার্থক্য অস্বীকার করবে কে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দল আছে, অন্দোলনও আছে, দুর্মুখরা এর দুর্নামও করে অনেক। কিন্তু এখানে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেনি।
ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদার প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষক সমচিন্তাধারণ করেন। কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ছাত্রছাত্রীরাও একই ভাবনা লালন করে থাকে। তা ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করার জন্য একটি পরীক্ষিত ‘সেটআপ’ তৈরি হয়েছে। তাই তারা বাইরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাও গ্রহণ করে দেওয়ার জন্য অনুরুদ্ধ হন; সফলতার সঙ্গে করেনও। তা ছাড়া আর একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং সেটি হলো : ছাত্রছাত্রীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আকাক্সক্ষার সঙ্গে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির আকাক্সক্ষা সমকোটির নয়। যেমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ ও কলা অনুষদ সারাদেশের ছাত্রছাত্রীদের পছন্দের প্রথমে থাকে। বিজ্ঞান অনুষদ তেমনি মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পরেই অবস্থিত। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের কাছে সিলেটের একটি বিশ্ববিদ্যালয় আর কুমিল্লার একটি বিশ্ববিদ্যালয় আগ্রহের বিবেচনায় আকাশ-পাতাল নয় বরং কাছাকাছি। অনুরূপভাবে গোপালগঞ্জের একটি বিশ্ববিদ্যালয় ও বরিশালের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও ছাত্র-আগ্রহের বিচারে ব্যাপক পার্থক্য মেলে না। অনেকে চেয়েছেন, শুরুটা হতে হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে। ভাবনাটিই ঠিক নয়। শুরুটা করতে হতো একেবারে শেষ থেকে। তার পর আর যারা আসতে চায় তাদের অন্তর্ভুক্ত করা। তা হলেই কাজটি অনেকটা সহজ হয়ে যেত।
এবার উনিশটি বিশ্ববিদ্যালয় সম্মত হয়েছে, এটি ভালো সংবাদ। তবে আমি মনে করি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয় তা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। কারণ একই ডিসিপ্লিনে তারা কয়েকবারে পরীক্ষা নেয়। এতে ভিন্ন প্রশ্নে পরীক্ষার্থীদের যাচাই করা হয়ে থাকে। ক্যাম্পাসে একবারে স্থান সংকুলান না হওয়ায় একই ডিসিপ্লিনের পরীক্ষা তাদের কয়েক ভাগে নিতে হয়। তাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে সহজেই গুচ্ছ পদ্ধতির পরীক্ষাভুক্ত করা যায়। এতে দুটো কাজ হবে : প্রথমত, একই প্রশ্নে ভর্তিচ্ছুদের যাচাই করা যাবে; দ্বিতীয়ত, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও বিরাট আয়োজনের শ্রম থেকে মুক্তি পাবেন। এবার হলো না; আশা করি আগামীবার তাদের যুক্ত করা সম্ভব হবে।
গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা কীভাবে নেওয়া হবে তা উপাচার্যদের সমন্বয়ে গঠিত একটি কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা কমিটির মাধ্যমে নির্ধারিত হবে। এই কমিটি ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে একটি নির্দিষ্ট স্কোর দেবে। এর পর যারা সম্মত হয়েছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজ নিজ শর্ত ও চাহিদা উল্লেখ করে শিক্ষার্থীদের ভর্তি বিষয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশ করবে। সেই চাহিদা ও স্কোরের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থী ভর্তি করবে। এজন্য আলাদা করে কোনো ধরনের ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হবে না। খুবই ভালো এই উদ্যোগ। সততা ও নিষ্ঠার শতভাগ থাকলে এর চেয়ে সুন্দর আর পরীক্ষা হয় না। এ পদ্ধতির সাফল্য নির্ভর করবে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, পরীক্ষা গ্রহণ ও মূল্যায়নের ওপর। আমাদের দেশে দুষ্টচক্র সদাজাগ্রত। ভালো কিছুকে নষ্ট করার জন্য এবং এর মধ্যে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য সব সময় একটি মহল সক্রিয় থাকে। দলের নাম ভাঙিয়েও তারা এসব করে। বিভিন্ন সময় এদের অনেকেই পুলিশের হাতে ধরাও পড়েছে। তা ছাড়া আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে উন্নত ডিভাইস নিয়ে অনেক পরীক্ষার্থী অসদুপায় অবলম্বনও করে।
বিশাল এই পরীক্ষা গ্রহণ করার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে পরীক্ষার্থীদের যে আসন-বিন্যাস করা হবে তা সম্পূর্ণভাবে প্রভাবমুক্ত রাখার একটি চ্যালেঞ্জও থাকবে। পরীক্ষার হলে যারা প্রত্যবেক্ষক হিসেবে কাজ করবেন তাদের ওপর সামাজিক-রাজনৈতিক-প্রশাসনিক চাপ থাকার ব্যাপারটি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সর্বোপরি পরীক্ষার কেন্দ্রগুলোতে প্রশ্নপত্র বিতরণের সমন্বয় সাধনের ব্যাপারটিও মাথায় রাখতে হবে। কোনো কারণে প্রশ্নপত্র দশ মিনিট আগে-পরে প্রদান করা হলে মুহূর্তেই তা প্রকাশ্যে চলে আসবে এবং একপক্ষ তাতে লাভবান হতে পারে। সব মিলিয়ে বলা যায়, গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ একটি বড় কাজ; একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এটি সফল করতে হলে সবার প্রতিজ্ঞা, একাগ্রতা, শুভচিন্তার সমন্বয় জরুরি।
ড. সৌমিত্র শেখর : নজরুল-অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়