রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:১০ পূর্বাহ্ন

ভ্যাকসিন নিয়ে নানা প্রশ্ন

ড. শফিকুর রহমান
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২১
  • ১৯৬ বার

করোনা ভাইরাসের বিশ্বব্যাপী বিস্তার সত্ত্বেও বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ যদিও এখন পর্যন্ত সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে, তবুও ইমিউনিটির (রোগ প্রতিরোধ) অভাব রয়েছে এমন ব্যক্তিরা যে কোনো সময় কোভিড-২ সংক্রমণ থেকে সুরক্ষিত নয়- এমনটি ভাবতে হবে।

সাধারণত ভ্যাকসিনগুলো জনসংখ্যার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, গুরুতর রোগ প্রতিরোধ ও চলমান স্বাস্থ্য সংকট হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে। এ কারণেই কোভিড-২ এর বিরুদ্ধে ভ্যাকসিনগুলোর বিকাশ ও পরীক্ষার দ্রুত গ্লোবাল প্রচেষ্টার ফলে ২০২০ সালের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভ্যাকসিন ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করেছিল। বিশ্বব্যাপী এ ভ্যাকসিনই মানুষকে করোনা থেকে সুরক্ষার একমাত্র স্বপ্ন দেখাচ্ছে।

গত ২৭ জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশের মানুষও করোনার মৃত্যুঝুঁকি থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার জন্য অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনটি নেওয়া শুরু করেছে। অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনটি যেমন আমাদের করোনা মহামারী থেকে মুক্তির আশা জাগাচ্ছে, তেমনি আবার বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের ভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যেও করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে নতুন নতুন বিতর্কসহ কিছু অপপ্রচার ও অবিশ্বাস রয়েছে।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের ৮৪ শতাংশ মানুষ করোনা ভ্যাকসিন নিতে আগ্রহী হলেও নেতিবাচক প্রচারের কারণে কিছুটা ভয় সৃষ্টি হওয়ায় এখনই ভ্যাকসিন নিতে চাইছে না দেশের ৫২ শতাংশ মানুষ। তারা করোনা ভ্যাকসিনটির আসলেই ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া আছে কিনা, তা যাচাই করতে সময় নিতে চাচ্ছেন। অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের সুরক্ষা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসহ মানবদেহে প্রয়োগের জন্য নিরাপদের বিষয়টি নিয়ে জনগণের মধ্যে যেসব প্রশ্ন, নেতিবাচক প্রচার ও শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে- তা কতটুকু সত্যি?

জার্মানির দুটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে ৮-১০ শতাংশ দাবি করা হয়েছে। এ রিপোর্ট দুটি দেখে মনে হচ্ছে, রিপোর্টে দুটি বিষয় বিভ্রান্তিকর। অ্যাস্ট্রাজেনেকা তাদের ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা গবেষণায় ৮ শতাংশের বয়স ৫৬ থেকে ৬৯ বছরের মধ্যে এবং ৩-৪ শতাংশের বয়স ৭০ বছরের বেশি ছিল। তবে এ থেকে বয়স্কদের মধ্যে মাত্র ৮ শতাংশের কার্যকারিতা পাওয়া যায় না। এ রিপোর্টটি হয়তো একটি বিতর্কিত রিপোর্ট।

কারণ এর পক্ষে কোনো গবেষণালব্ধ ডেটা নেই। অ্যাস্ট্রাজেনেকাও এর প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছে, তাদের ভ্যাকসিন নিরাপদ ও কার্যকর এবং দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার পর বয়স্কদের দেহেও একই হারে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। যেহেতু ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের ওপর এ ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতার ব্যাপারে পর্যাপ্ত তথ্য নেই, সেহেতু জার্মানি সরকার তাদের দেশের ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের এ ভ্যাকসিন না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন ৬৫ বছরের বেশি বয়স্কদের মধ্যে দারুণ কাজ করছে বলে জার্মানির বক্তব্যকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীও প্রত্যাখ্যান করেছেন।

গত ৮ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক জার্নাল লেনসেটে প্রকাশিত অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ও সুরক্ষাবিষয়ক রিপোর্টে দেখা গেছে, ভ্যাকসিনটির ট্রায়ালের সময় যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকার সাদা, কালো ও এশিয়ানসহ মিশ্র গ্রুপের ১৮-৫৫, ৫৬-৫৯ ও ৭০ বছর থেকে তদূর্ধ্ব বয়সী ৩টি গ্রুপের মানুষ অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ ছাড়া ডায়াবেটিস, হার্ট ও ফুসফুসসহ শ্বাসতন্ত্রের রোগীরা এসব ট্রায়ালের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং নিরাপদ বলে প্রমাণিত হওয়ায় তারাও অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনটি নিতে পারেন। যেহেতু গর্ভবতী ও শিশুদের বুকের দুধ খাওয়ান- এমন নারীরা এবং ১৮ বছরের কম বয়সীরা ভ্যাকসিনটির ট্রায়ালে অন্তর্ভুক্ত ছিল না, সেহেতু তাদের ওপর ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা ও সুরক্ষার ব্যাপারটি জানা যায়নি।

ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও অনেকেই করোনা ছড়াতে পারেন বা আক্রান্ত হয়েছেন বলে সংবাদ প্রচারিত হয়েছে। অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা ৬২.১ থেকে ৯০ শতাংশ। কাজেই বাকি ১০ থেকে ৩৮ শতাংশ ভ্যাকসিন গ্রহীতার শরীরে কার্যকর অ্যান্টিবডি বা প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি না হওয়ার কারণে ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও করোনা আক্রান্ত ও সংক্রমণ ছড়ানো সম্ভব। তা ছাড়া বয়স্ক লোক ও অন্যান্য রোগের কারণে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের শরীরে ভ্যাকসিনের মাধ্যমে করোনা সংক্রমণ প্রতিহত করতে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি সৃষ্টি হতে ৩ সপ্তাহ পর্যন্ত লেগে যেতে পারে।

ভ্যাকসিন নেওয়ার পর মানবদেহ করোনার স্পাইক প্রোটিন অ্যান্টিজেনের জেনেটিক উপাদানগুলো সঞ্চয় করতে ও অ্যান্টিবডি তৈরি করতে বেশ খানিকটা সময় নেয়। এ ছাড়া সংক্রমণ প্রতিরোধে ভ্যাকসিনের পুরোপুরি কার্যকারিতা সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ নিশ্চিত নন এবং কোনো ভ্যাকসিনই শতভাগ কার্যকর নয়। তাই ভ্যাকসিন দেওয়া হোক আর না হোক, সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বিজ্ঞানীরা উপদেশ দিচ্ছেন।

করোনা ভ্যাকসিন হালালের প্রসঙ্গটিও সামনে এসেছে। মানুষের শরীরে বংশবৃদ্ধি বা সংক্রমণ সৃষ্টি করতে পারে না- এমন একটি জেনেটিক্যাল মোডিফাইড ও নিষ্ক্রিয় এডিনোভাইরাসকে করোনার স্পাইক জিনের ভ্যাক্টর (বাহক) হিসেবে ব্যবহার করে মূলত অক্সফোর্ডের করোনা ভ্যাকসিনটি তৈরি। এতে স্পাইক প্রোটিন ছাড়াও চিনি, খাদ্য লবণ, ইথানল (০.০০৩ মিলিগ্রাম/ডোজ), এল-হিস্টিডিন, পলিসরবেট-৮০, ডাইসোডিয়াম ইডিটেট, ম্যাগনেসিয়াম ক্লোরাইড ও পানি রয়েছে। এ ভ্যাকসিনটিতে কোনো ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী ও হারাম বা প্রাণিজ উপাদান নেই। আবার ভ্যাকসিন সরবরাহ ব্যবস্থাপনা, সঠিক ডোজ ও উৎপাদনকারী দেশ নিয়ে কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করছেন।

ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা ঠিক রাখার জন্য সরবরাহ চেইনসহ সংরক্ষণাগারের সর্বত্রই নিম্ন তাপমাত্রা বজায় রাখার ব্যাপারটি সরকারি মনিটরিং ব্যবস্থার অধীন রাখতে হবে। সরকারিভাবে আমদানি করা ভ্যাকসিনটির সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনটির বেসরকারিভাবে আমদানি ও বিক্রি বন্ধ রাখলে নকল এবং ভেজাল হওয়ার বিষয়ে মানুষের মধ্যে সন্দেহের মাত্রা কিছুটা দূর হবে। অক্সফোর্ডের কোভিশিল্ড ভ্যাকসিনটির উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউট ভারতে অবস্থিত হলেও এটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি প্রতিষ্ঠান এবং ভ্যাকসিনটি অক্সফোর্ডের ফর্মুলায় তৈরি হচ্ছে।

উল্লেখ্য, সেরাম ইনস্টিটিউটের অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনটির একটি পূর্ণ ডোজ হচ্ছে ০.৫ মিলি এবং এর প্রতি ডোজে প্রায় ৫ হাজার কোটি ভাইরাস কোষ রয়েছে।

যদিও করোনা ভ্যাকসিনগুলো এত অল্প সময়ের মধ্যে মানবদেহে প্রয়োগের জন্য নিরাপদের বিষয়টি নিশ্চিত করতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে ট্রায়াল শেষ করছে এবং ১৬ বা ১৮ বছরের কম ও বৃদ্ধ বয়সীদের মধ্যে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা বা সুরক্ষা নিয়ে ট্রায়াল চলছে, তবুও ভ্যাকসিনগুলো দ্বারা সৃষ্ট প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা হার্ড ইমিউনিটি করোনা সংক্রমণ থেকে কতদিন পর্যন্ত সুরক্ষা দেবে সেটি নিশ্চিত নয়।

দীর্ঘ সময়ের জন্য সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে অন্যান্য ভ্যাকসিনের মতো হয়তো অনেক বছর লেগে যাবে। তবে করোনার এ মহামারী থেকে দ্রুত রক্ষা পাওয়ার আর কোনো পথ নেই বলেই যতটুকু সুরক্ষা যত সময়ের জন্যই দিক, তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ ও বিতর্কে না গিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যেই ভ্যাকসিনের মাধ্যমে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করে করোনার বিরুদ্ধে আমাদের সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, নয়তো অধিক সংক্রমণশীল ও মারাত্মকভাবে প্রাণঘাতী নতুন নতুন মিউট্যান্ট ধরন বা স্ট্রেইনগুলো আমাদের দেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে আমরা আর রক্ষা পাব না।

এজন্যই যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে তাদের শতভাগ নাগরিককে ভ্যাকসিনের আওতায় আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। বাংলাদেশেরও উচিত হবে অন্তত ৭০ শতাংশ মানুষকে শিগগিরই ভ্যাকসিনের আওতায় এনে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি করা, যাতে করোনার প্রাণঘাতী নতুন ধরনগুলো এসে সংক্রমণ ছড়াতে না পারে। এজন্য বাংলাদেশ কেবল ভারতের সেরামের ওপর নির্ভর না করে অন্যান্য দেশ থেকে ভ্যাকসিন আমদানি এখনই শুরু করা দরকার।

যাহোক সেরামের কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন বিষয়ের পজিটিভ-নেগেটিভ ভাবনা যতই থাকুক না কেন, রোগজীবাণুর মরণব্যাধি থেকে পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের গবেষণার প্রতি বিশ্বাস রাখতেই হবে।

ড. শফিকুর রহমান : অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com