রাজনীতিবিজ্ঞানে ‘চিকেন গেম’ নামে একটি তত্ত্ব রয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি তথা অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে বিশ্লেষকরা এ তত্ত্ব ব্যবহার করে থাকেন।
যখন পরস্পরবিরোধী দুই পক্ষ সংঘর্ষের মতো একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, তখন এক ‘পক্ষ’ হাল ছেড়ে দেয়, আবার কখনো সংঘর্ষে উভয় পক্ষ ধ্বংস হয়ে যায়। এক পক্ষ যখন হাল ছেড়ে দেয় আর অন্য পক্ষ যখন কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়; তখন যে ‘পক্ষ’ হাল ছেড়ে দেয়, তাকে ‘চিকেন’ বলে। এখানে ‘চিকেন’ ভীরু বা কাপুরুষ অর্থে ব্যবহৃত হয়। ‘চিকেন গেম’ তত্ত্বে এক ‘পক্ষ’ হুমকি দিয়ে বিজয়ী হয়। অতি সাম্প্রতিককালে পারমাণবিক ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান দ্বন্দ্ব ‘চিকেন গেম’ তত্ত্ব দ্বারা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। মিয়ানমারের সংকটকেও আমরা ‘চিকেন গেম’ তত্ত্ব দ্বারা বিশ্লেষণ করতে পারি। এখানে ‘চিকেন’ কে? সেনাবাহিনী? নাকি নেতৃত্বহীন সাধারণ মানুষ?
প্রায় এক মাস হতে চলল মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। নভেম্বরের (২০২০) যে নির্বাচনে অং সান সু চির দল বিজয়ী হয়েছিল, সেনাবাহিনী তাকে আবার ক্ষমতায় যেতে দেয়নি; বরং নির্বাচন বাতিল করে দেশে সামরিক আইন জারি করেছে। প্রথম দিকে সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে একটি নমনীয় ভাব লক্ষ করা গেলেও গেল সপ্তাহে সেখানে বড় ধরনের বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। পুলিশের গুলিতে দু’জন বিক্ষোভকারীর মৃত্যুর খবরও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। মজার ব্যাপার, এ বিক্ষোভ সংঘটনের ডাক দেয়নি অং সান সু চির দল এনএলডি। এ বিক্ষোভ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং বিদেশি মিডিয়াগুলো আমাদের জানাচ্ছে- কোনো ধরনের নেতৃত্ব ছাড়াই সেখানে বিক্ষোভ সংঘটিত হচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে, বিক্ষোভকারী ও সেনাবাহিনী পরস্পরবিরোধী অবস্থানে রয়েছে। এ পরিস্থিতি মিয়ানমারকে কোথায় নিয়ে যাবে? সেনাবাহিনী ক্ষমতা সিভিলিয়ানদের কাছে ফিরিয়ে দেবে, নাকি সেনাবাহিনী আরও কঠোর হবে? মিয়ানমারের ইতিহাসে বিক্ষোভের মুখে সেনাবাহিনীর নতি স্বীকারের ইতিহাস আছে। পাঠক জাফরান বিপ্লব বা Saffron Revolution-এর কথা স্মরণ করতে পারেন। মিয়ানমারের দীর্ঘ ইতিহাসে যেখানে সেনাবাহিনী রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছে; সেখানে স্যাফরন রেভ্যুলিউশন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশে একটি বড় ভূমিকা পালন করেছিল।
মিয়ানমারের রাজনৈতিক উন্নয়নে স্যাফরন রেভ্যুলিউশন-এর একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। অন্যান্য দেশের কালার রেভ্যুলিউশন সঙ্গে এ বিপ্লবকে মেলানো যায়। ২০০৭ সালের আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মিয়ানমারে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে যে বিক্ষোভ পরিচালিত হয়েছিল, তা মিয়ানমারের ইতিহাসে স্যাফরন রেভ্যুলিউশন হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ওই বিপ্লবের পুরোভাগে ছিলেন বৌদ্ধধর্মের ভিক্ষুরা ও সেই সঙ্গে ছাত্ররা। সামরিক জান্তা জ্বালানির দাম বৃদ্ধি করলে ধর্মীয় নেতারা এর প্রতিবাদে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছিলেন। ধর্মীয় নেতারা শরীরে যে চাদর ব্যবহার করেন, তা হচ্ছে স্যাফরন বা জাফরানি রঙের, যা কিনা হলুদ ও লাল রঙের মিশ্রণে নতুন এক রং। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এ চাদর সব সময় ব্যবহার করেন।
সম্ভবত এ কারণেই সামরিক জান্তাবিরোধী ওই আন্দোলন চিহ্নিত হয়েছিল জাফরান রেভ্যুলিউশন হিসাবে। ওই রেভ্যুলিউশন বেশ কিছু পরিবর্তন সাধন করেছিল মিয়ানমারে। যেমন, ওই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছিল বৌদ্ধ ধর্মের ভিক্ষুরা মিয়ানমারে একটি শক্তি। শান্তিপূর্ণ ও অহিংস পদ্ধতিতে তারা পরিবর্তন আনতে চায়। ওই বিপ্লব সামরিক জান্তাকে সংস্কারে যেতে বাধ্য করেছিল এবং ওই বিপ্লবের রেশ ধরে সামরিক জান্তা শেষ অবধি ২০১৫ সালে নির্বাচন দেয়; যার মাধ্যমে অং সান সু চি ক্ষমতাসীন হন।
বৌদ্ধ ভিক্ষুদের গায়ের স্যাফরন রঙের চাদর বিপ্লবের প্রতীক হয়ে উঠেছিল মিয়ানমারে। অহিংস পদ্ধতিতে যে সরকারকে বাধ্য করা যায় সংস্কারে যেতে, মিয়ানমারের স্যাফরন রেভ্যুলিউশন ছিল তার বড় প্রমাণ। কিন্তু ২০২১ সালে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে যে বিক্ষোভ ঘনীভূত হচ্ছে, তার সঙ্গে স্যাফরন রেভ্যুলিউশনের মিল খুঁজে পাওয়া হয়তো যাবে না। কেননা, এখন অবধি বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তাদের বিখ্যাত জাফরানি রঙের চাদর গায়ে জড়িয়ে বিক্ষোভে অংশ নেননি। ফলে এটি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না, বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতারা সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণকে কতটুকু সমর্থন করছেন।
এটা ঠিক ‘স্যাফরন রেভ্যুলিউশন’ সফল হয়নি। তবে একটি আবেদন রেখে গেছে। অর্থাৎ বৌদ্ধরা যে শুধু শান্তির কথা, অহিংস নীতির কথা প্রচার করেন, তাই নয়; বরং রাজনৈতিকভাবেও তারা যে বড় একটি শক্তি, মিয়ানমারের প্রেক্ষাপটে তারা তা প্রমাণ করেছিলেন। সেনাবাহিনীর প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে এখানে যে, তারা অতীতে এ ভিক্ষুদের তাদের স্বার্থে ব্যবহার করেছিল। তবে বর্তমানে সেনাবাহিনীবিরোধী যে গণআন্দোলন গড়ে উঠছে, তার সঙ্গে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা নিজেদের সম্পর্কিত করেনি। সেনাবাহিনীর প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে এখানেই।
নেপিদো, মান্দালয়, রেঙ্গুন প্রভৃতি বড় বড় শহরে বিক্ষোভ হচ্ছে। কোথাও কোথাও সরকারি কর্মচারীরা সরকারের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ উপেক্ষা করে গণজমায়েতে যোগ দিয়েছেন। ডাক্তাররা কর্মবিরতিতে গেছেন। তাহলে কি মিয়ানমারে আবারও ক্ষমতার পালা বদলের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে? পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিই- ১৯৮৭-৮৮ সালে গণবিক্ষোভের সময় জেনারেল উসান ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন সিভিলিয়ান মংমং। ১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বরে জেনারেল সুমং তাকে উৎখাত করে। এরপর জেনারেল সুমং নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। ১৯৯০ সালের ২৭ মে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে অং সান সু চির দল বিজয়ী হলেও তাকে ক্ষমতা দেয়া হয়নি; বরং বন্দি করা হয়েছিল। এর অনেক পরে ১৯৯৭ সালে সেনাবাহিনী গঠন করেছিল ‘স্টেট পিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল’। এরাই পরে গঠন করে ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি। এ দলটি সেনাবাহিনী সমর্থিত।
এ দলটিকে সামনে রেখেই সেনাবাহিনী তাদের স্বার্থ আদায় করে। যদিও সর্বশেষ নির্বাচনে (২০২০) দলটি ভালো করেনি। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে জেনারেল মিন আউং হ্লাইং এখন এই দলটিকে সামনে রেখে নির্বাচন দিতে পারেন এবং দলটিকে ‘বিজয়ী’ করে নিজের ক্ষমতাকে আরও বাড়াতে পারেন। অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করতে সেনাবাহিনীর উদ্যোগে এখন অং সান সু চির বিচার হবে। তাতে ফৌজদারি অপরাধে তিনি দণ্ডিত হবেন (?) এবং আগামী নির্বাচনে তিনি অযোগ্য ঘোষিত হবেন- এ ধরনের একটি ‘গুজব’-এর জন্ম হয়েছে। মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য একটি খারাপ খবর হচ্ছে- সেখানে এনএলডি বাদে অন্য কোনো বড় দলের জন্ম হয়নি। সর্বশেষ পার্লামেন্টে বিরোধী দল ছিল সেনাবাহিনী সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি)।
২০২০ সালের নির্বাচনে এনএলডি পেয়েছিল ১৩৮ (হাউজ অব ন্যাশনালিটিজ) ও ২৫৮ (হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ)। অন্যদিকে ইউএসডিপির আসন ছিল মাত্র ৭ ও ২৬। ফলে বোঝাই যায়, কেন সেনাবাহিনী আতঙ্কিত ছিল। যদি ইউএসডিপির ফলাফল এনএলডির আসন সংখ্যার পাশাপাশি থাকত, তাহলে সেনাবাহিনী হয়তো ক্ষমতা গ্রহণ করত না। কেননা তাদের ভয় ছিল- এনএলডি সংবিধানে পরিবর্তন এনে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা সংকুচিত করতে পারে। ২০২০ সালের নভেম্বরের ফলাফল আমাদের বলে দেয়- সেখানে কেন্দ্রীয়ভাবে রাজনৈতিক দলগুলো সংগঠিত নয়; বরং তারা আঞ্চলিকভাবে সংগঠিত। যেমন আরাকান ন্যাশনাল পার্টির আসন মাত্র ৪, মন ইউনিটি পার্টি ৩, শান ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি ২ (মোট আসন ২২৪, হাউজ অব ন্যাশনালিটিজ) কিংবা হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ এ (মোট আসন ৪৪০, সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত ১১০) শান ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি ১৩, আরাকান ন্যাশনাল পার্টি ৪, মন ইউনিটি পার্টি ২ ইত্যাদি। এর অর্থ পরিষ্কার। মিয়ানমারে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকায় সেনাবাহিনীই উভয় কক্ষে (৫৬+১১০ আসন) এক রকম বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। যদিও শেষ অবধি সেনাবাহিনী নির্বাচনের ফলাফল মানতে অস্বীকৃতি জানায় এবং অং সান সু চিকে গৃহবন্দি করে।
মিয়ানমারে এ মুহূর্তে পক্ষ দুটি। একদিকে সেনাবাহিনী, অন্যদিকে অসংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি। এ দুই শক্তির মাঝে এখন সহাবস্থান কীভাবে সম্ভব? ‘চিকেন গেম’ তত্ত্ব অনুযায়ী এক পক্ষ হাল ছেড়ে দেবে, আরেক পক্ষ হুমকি দিয়ে ‘বিজয়ী’ হবে। তাহলে তত্ত্ব অনুযায়ী ‘চিকেন’ কে হবে? সেনাবাহিনী, নাকি অসংগঠিত রাজনৈতিক শক্তি? দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একজন শীর্ষস্থানীয় বিশ্লেষক বার্টিল লিন্টনার এশিয়া টাইমসে লিখেছেন, সেনাবাহিনী ব্যবসায়িক নেতাদের গ্রেফতার করতে শুরু করেছে। তার মন্তব্য- অর্থনীতি যদি সঠিক পথে না চলে, কোভিড-১৯ যদি সঠিকভাবে মোকাবিলা করা না যায়, তাহলে ব্যাপক গণগ্রেফতার সেনাবাহিনীর ভবিষ্যৎকে একটি প্রশ্নের মুখে রাখবে (২৫ ফেব্রুয়ারি)। অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন, অর্থনীতি যদি আগের জায়গায় ফিরে আসে, তাহলে তা সেনা নেতৃত্বকে সফলতা এনে দেবে। কিন্তু প্রশ্ন এখানেই। অর্থনীতি আগের জায়গায় আসবে কিনা? শুধু জাপানি কোনো কোনো কোম্পানি সেখানে তাদের কর্মকাণ্ড আপাতত স্থগিত করেছে। এর বাইরে চীন কিংবা ভারত তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করেছে- এমন তথ্য আমাদের কাছে নেই। অন্যদিকে আরেকজন বিশ্লেষক ডেভিড হাট লিখেছেন, With sanctions having little impact, some think the best hope for a peaceful resolution lies with ASEAN. আসিয়ানকেই বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। ইতোমধ্যে আমাদের কাছে তথ্য আছে, ইন্দোনেশিয়া একটি উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, উদ্যোগটি কী? ২০২০ সালের নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়া? একটি নয়া নির্বাচন? সেনাবাহিনীর কঠোর অবস্থান? জুন মাসে সেনাপ্রধানের অবসরে যাওয়া স্পষ্টতই একটি ইঙ্গিত দেয় যে, সেনাবাহিনী সহসা হাল ছেড়ে দেবে না। দ্বিতীয় ‘স্যাফরন রেভ্যুলিউশন’-এর সম্ভাবনাও ক্ষীণ। এ ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী নয়; বরং অসংগঠিত রাজনৈতিক শক্তিই কি শেষ পর্যন্ত ‘চিকেন’ এ পরিণত হতে যাচ্ছে? এটা দেখতে হলে আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক