‘পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে রাতারাতি ভ্রমণ করিয়েছেন (মক্কার) মাসজিদুল হারাম থেকে (ফিলিস্তিনের) মাসজিদুল আকসায়, যার পরিবেশকে আমি করেছি বরকতময়, যাতে আমি তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাই; নিশ্চয় তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা’ (সূরা বনি ইসরাইল-০১)।
রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘কুরাইশরা যখন আমাকে মিথ্যা মনে করল (এবং বলল, আপনার মেরাজে যাওয়ার দাবি সত্য হলে বাইতুল মাকদিসের একটি বর্ণনা দিন)। আমি হাজারে (হাতিমে) দাঁড়ালাম এবং আল্লাহ তায়ালা আমার সামনে বাইতুল মাকদিসের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরলেন। আমি তাদের সামনে এর নিদর্শনসমূহের বর্ণনা দিলাম। মনে হলো আমি যেন বাইতুল মাকদিসকেই দেখছি (তিরমিজি, ৩১৩৩)।
বলা বাহুল্য, এ ঘটনা মহান আল্লাহ (অলৌকিকভাবে) তাঁর পূর্ণ কুদরত দিয়ে ঘটিয়েছেন। এই মেরাজের দু’টি অংশ। প্রথম অংশকে ‘ইসরা’ বলা হয়; যার উল্লেøখ এখানে করা হয়েছে। আর তা হলোÑ মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত সফর করার নাম। এখানে পৌঁছে নবী সা: সমস্ত নবীদের ইমামতি করেন। বায়তুল মাকদিস থেকে তাঁকে আবার আসমানসমূহে নিয়ে যাওয়া হয়। আর এটি হলো এই সফরের দ্বিতীয় অংশ। যাকে ‘মেরাজ’ বলা হয়েছে। এর কিঞ্চিৎ আলোচনা সূরা নাজমে করা হয়েছে এবং বাকি বিস্তারিত আলোচনা হাদিসসমূহে বর্ণিত রয়েছে। সাধারণভাবে সম্পূর্ণ এই সফরকে ‘মেরাজ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। ‘মেরাজ’ সিঁড়ি বা সোপানকে বলা হয়। আর এটি রাসূল সা:-এর পবিত্র মুখ-নিঃসৃত শব্দ থেকে গৃহীত। এই দ্বিতীয় অংশটা প্রথম অংশের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও মাহাত্ম্যপূর্ণ ব্যাপার। আর এ কারণেই ‘মেরাজ’ শব্দটাই বেশি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।
মেরাজের সময়কাল নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তবে এ ব্যাপারে সবাই একমত যে, তা হিজরতের আগে সংঘটিত হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, এক বছর আগে। আবার কেউ বলেছেন, কয়েক বছর আগে এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। অনুরূপ মাস ও তার তারিখের ব্যাপারেও মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন, রবিউল আওয়াল মাসের ১৭ অথবা ২৭ তারিখে হয়েছে। কেউ বলেছেন, রজব মাসের ২৭ তারিখ এবং কেউ অন্য মাস ও অন্য তারিখের কথাও উল্লেøখ করেছেন (ফাতহুল কাদির)। মহানবী সা: ও তাঁর সাহাবি রা:দের কাছে এ দিনকে স্মরণ ও পালন করার প্রয়োজনীয়তা ছিল না বলেই, তা সংরক্ষিত হয়নি।
মেরাজ থেকে রাসূল সা: যা এনেছেন : হাদিসের আলোকে পাওয়া যায়, এই রাতে রাসূল সা: মুসলিমদের জন্য ফরজ সালাতের বিধান নিয়ে আসেন। মেরাজের রাতে নবী সা:-এর উপর ৫০ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করা হয়েছিল। অতঃপর কমাতে কমাতে পাঁচ ওয়াক্তে সীমাবদ্ধ করা হয়। অতঃপর ঘোষণা করা হলো, ‘হে মুহাম্মদ! আমার কাছে কথার কোনো অদল বদল নেই। তোমার জন্য এই পাঁচ ওয়াক্তের মধ্যে ৫০ ওয়াক্তের সওয়াব রয়েছে’ (তিরমিজি-২১৩)।
রাসূল সা: বলেছেন, ‘মেরাজের রাতে আমার সামনে দুটি পেয়ালা আনা হলো। একটিতে দুধ, অপরটিতে শরাব। আমাকে বলা হলো, আপনি যেটি ইচ্ছা গ্রহণ করতে পারেন। আমি দুধের বাটিটি গ্রহণ করলাম আর তা পান করলাম। তখন আমাকে বলা হলো, আপনি ফিৎরাত বা স্বভাবকেই গ্রহণ করে নিয়েছেন। দেখুন! আপনি যদি শরাব গ্রহণ করতেন, তাহলে আপনার উম্মত পথভ্রষ্ট হয়ে যেত’ (সহিহ বুখারি-৩৪৩৭)।
এই রাতের রাসূল সা:-এর দেখা জান্নাতের দৃশ্যসমূহের মধ্য থেকে তিনি নিয়ে এসেছেন কর্জে হাসানার গুরুত্বপূর্ণ দিক। সাদাকাহ থেকেও এই কর্জদানে বেশি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘মেরাজের রাতে আমি জান্নাতে একটি দরজায় লেখা দেখলাম, দান খয়রাতে ১০ গুণ সওয়াব এবং কর্জে ১৮ গুণ! আমি বললাম, হে জিবরাইল! কর্জ দান-খয়রাতের চেয়ে উত্তম হওয়ার কারণ কী? তিনি বললেন, ‘ভিক্ষুক নিজের কাছে (সম্পদ) থাকতেও ভিক্ষা চায়, কিন্তু কর্জগ্রহীতা প্রয়োজনের তাগিদেই কর্জ চায় (ইবনে মাজাহ-২৪৩১)।
এই রাতের শিক্ষায় যা করতে নিষেধ করা হয়েছে : রাসূল সা:-এর জাহান্নামের বর্ণনায় এক দৃশ্য থেকে জানা যায়, রাসূল সা: বলেছেন, ‘মেরাজের রাতে আমি একদল লোকের কাছ দিয়ে অতিক্রম করেছি। যাদের ঠোঁটগুলো আগুনের কেঁচি দিয়ে কাটা হচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করেছি এরা কারা হে জিবরাইল? তিনি বলেছেন, এরা আপনার উম্মতের বক্তা শ্রেণী। তারা এমন কথা বলত যা নিজেরা আমল করত না’ (বুখারি ও মুসলিম)। ‘তারা আল্লাহর কিতাব পাঠ করত কিন্তু তার প্রতি আমল করত না’ (তারগিব ওয়াত তাহরিব-১২৫)। গিবত ও পরনিন্দার ভয়াবহ পরিণতির কথা মহান আল্লাহ রাসূল সা:-এর মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন। যাতে ইসলামের ছায়াতলে থেকে সবাই এই কাজ থেকে বিরত থাকতে পারে। হাদিসে এসেছে, ‘তিনি জাহান্নামে একদল লোক দেখলেন, যারা তামার তৈরি নখ দিয়ে অনবরত নিজেদের মুখমণ্ডল ও বুকে আঁচড় মারছে। জিবরাইল আ: বললেন, এরা মানুষের গোশত খেতো’ (গিবত ও পরনিন্দা করত)’ (আবু দাউদ-৪৮৭৮)।
সঠিক সময়ে সালাত আদায়ের জোর আদেশ দিতে এই রাতের এক নিদর্শনের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হয়। সালাতে গাফিলতির শাস্তি অনেক ভয়াবহ এমন একটি হাদিস হচ্ছেÑ অতঃপর এমন এক সম্প্রদায়কে দেখলেন, পাথর দ্বারা যাদের মাথা চূর্ণবিচূর্ণ করা হচ্ছে। জিবরাইল আ: বলেন, তারা সালাতে অলসতা করত’ (ফাতহুল বারি : ৭/২০০)।