সারা দেশের চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে কুষ্টিয়া জেলার ৪৬ অটো চালকল মালিক। প্রতি বছর এ সিন্ডিকেট নানা অজুহাতে দাম বাড়িয়ে দিয়ে লুটে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। দুর্বল মনিটরিং ব্যবস্থা আর নানা সুযোগে চালের বাজারকে অস্থির করে তুলছে এই সিন্ডিকেট। গত কয়েক দিনের ব্যবধানে কুষ্টিয়া মোকামে সব ধরনের চালে কেজিতে এক টাকা বেড়েছে। আড়তে চাল সঙ্কট দেখিয়ে অনেক মিল মালিক চালের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
অথচ কুষ্টিয়া মোকামে গত এক সপ্তাহে ১০ হাজার মেট্রিক টন চাল মজুদ আছে বলে তথ্য রয়েছে মিল মালিক ও জেলা প্রশাসনের কাছে। তারপরও দাম বাড়ানোর বিষয়টি পুরোপুরি অযৌক্তিক বলে জানান খুচরা ব্যবসায়ী ও ভোক্তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ধানের দাম বৃদ্ধি ও মোকামে চাল সঙ্কটের অজুহাতে নতুন করে সব ধরনের চালে কেজিতে এক টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে মিল মালিকেরা। অথচ ধানের দাম গত এক সপ্তাহে নতুন করে বাড়েনি বলে কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে। নতুন ধান ওঠায় কোনো কোনো জাতের ধানের দাম কমেছে।
এ ছাড়া গত এক সপ্তাহে অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘট চলায় কুষ্টিয়া মোকাম থেকে চাল সরবরাহ নিম্ন পর্যায়ে চলে আসে। এই কারণে অটো ও হাসকিং চালকলগুলোতে প্রচুর চাল জমে যায়। যার পরিমাণ ১০ হাজার টনের বেশি। এ চাল শুক্রবার থেকে সরবরাহ শুরু হয়েছে দেশের বড় বড় আড়তে। এই যখন অবস্থা ঠিক সেই সময় চালের দাম মোকামে অর্থাৎ মিল গেটে এক টাকা বেড়েছে। খুচরা পর্যায়ে পরিবহনসহ অন্যান্য খরচ যোগ করে ভোক্তাকে আরো তিন টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হবে।
কুষ্টিয়া পৌর বাজারের সব থেকে বড় খুচরা ও পাইকারি চালের ব্যবসায়ী শাপলা ট্রেডার্সের মালিক আশরাফুল ইসলাম বলেন, চালের বাজার কয়েক দিন ধরে স্থিতিশীল ছিল। নতুন করে গত শনিবার সকাল থেকে মিল গেটে ফের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে এক টাকা করে। তিনি বলেন, মিলের লোক এসেছিল। নতুন দাম নির্ধারণ করে লিখে দিয়ে গেছে। নতুন করে মিনিকেট ১ টাকা বেড়ে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা ২ হাজার ৩০০ টাকা, বাসমতি ১ টাকা বেড়ে ২ হাজার ৫০০ টাকা, কাজললতা ১ হাজার ৮৫০ টাকা, আটাশ ১ হাজার ৯৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
একই চাল গত কয়েক দিন ধরে মিনিকেট মিলগেটে ৪৫ টাকা, বাসমতি ৪৯ টাকা, কাজললতা ৩৬ টাকা ও আটাশ ৩৭ টাকা ৫০ পয়সা কেজিতে বিক্রি হচ্ছিল। কোনো কোনো চালে দেড় টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। জেলায় অটো চালকলের সংখ্যা বর্তমানে ৪৬টি। এর মধ্যে কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় ৪৩টি, দৌলতপুরে দুইটি ও কুমারখালীতে একটি। কুষ্টিয়ায় সদর উপজেলাতে দেশের বড় মোকামগুলোর অবস্থান। এ ছাড়া দৌলতপুরেও প্রচুর চাল উৎপাদন হয় দু’টি মিল থেকে।
হাসকিং মিল মালিকদের অভিযোগ, চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ অটো মিল মালিকদের হাতে। তারা দাম বাড়িয়ে দিলে বাজারে দাম বেড়ে যায়। নতুন ধান ওঠার এ সময় চালের দাম বাড়ার নজির সাধারণত নেই। তারপরও দাম বেড়ে যাচ্ছে কেন তা অটো মিল মালিকরা বলতে পারবেন।
লিয়াকত রাইস মিলের মালিক লিয়াকত হোসেন বলেন, ‘হাসকিং মিল মালিকদের হাতে চালের ব্যবসা নেই। অটো মিল মালিকরা সব চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা কোটি কোটি টাকা মুনাফা করছেন। অথচ হাসকিং মিল মালিকরা নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন, দেউলিয়া হয়ে অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। এখন নতুন ধান উঠছে, তাতে বাজার বাড়ার কথা না।’
কয়েক বছর আগে দেশের বাজারে চালের বাজার অনেক বেড়ে যায়। সে সময় চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করার অভিযোগ ওঠে কুষ্টিয়ার রশিদ অ্যাগ্রো ফুডসহ জেলার অটো চালকল মালিকদের বিরুদ্ধে। সে সময় অভিযান চালিয়ে রশিদের গোডাউনে প্রচুর ধান ও চালের মজুদ পাওয়া যায়। রশিদ এক সময় বিএনপি করলেও এখন আওয়ামী লীগের লোক। আ’লীগে যোগ দিয়েছেন। এ কারণে তার মিলে মনিটরিং চালাতে ভয় পান প্রশাসনের লোকজন।
রশিদ ছাড়াও আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতার কব্জায় রয়েছে চালের বাজার। তারা ইচ্ছামতো চালের বাজার বাড়িয়ে দেন। তবে দেশে রশিদ অ্যাগ্রো ফুড দাম বাড়িয়ে দিলে অন্যরা বাড়িয়ে দেন এমন নজির রয়েছে। অন্যদের তুলনায় রশিদের চালের দাম বেশি। তার চালের মান ভালো হওয়ায় অন্যদের তুলনায় সব সময় কয়েক টাকা বেশি দামে বিক্রি হয়। এবারো আমন মৌসুমে চালের দাম বাড়ার পর জেলা প্রশাসন ও বাজার নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তার পক্ষ থেকে জোরদার কোনো অভিযান দেখা যায়নি।
এর মাঝে জেলা প্রশাসন চালকল মালিকদের ডেকে চালের দাম না বাড়ানোর অনুরোধ করে। তবে মিল মালিকরা দাম না বাড়ানোর আশ্বাস দিলেও এর মাঝে অনেক মিল মালিক দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন অটো মিল মালিক বলেন, ‘সারা দেশে অটো মিল মালিকদের একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। তারা যোগাযোগ করে দাম বাড়িয়ে দেয়। এবার এ সময়ে ধানের দাম অল্প বেড়েছে। তবে যে দাম বেড়েছে তাতে চালের বাজার প্রতি কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা বাড়ার কথা নয়। জেলা প্রশাসকের সাথে বৈঠকের পর অনেকেই দাম বাড়াননি। তবে কেউ কেউ বাড়িয়ে দিয়েছেন।
বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, জেলার ৪৬টি অটো মিলের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে ৫ থেকে ১০ জন ব্যবসায়ী চালের বাজারে কারসাজি করেন। তারা সবার সাথে কথা বলে দাম বাড়িয়ে দেন। তাই ধান কেনা থেকে শুরু করে মিলে নিয়ে আসা ও চাল তৈরি পর্যন্ত খরচ ও বিক্রির বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন প্রধান বলেন, ‘পরিবহন এক সপ্তাহ বন্ধ থাকায় চাল সরবরাহ বন্ধ ছিল। শুক্রবার থেকে ফের পরিবহন শুরু হয়েছে। সারা দেশে চাল যাচ্ছে। মোকামে অনেক চাল রয়েছে। নতুন করে দাম বাড়ানো হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।’
জেলা প্রশাসনের পাশাপাশি পুলিশ সুপার নিজেও এবার চালের বাজারের ওপর নজরদারি শুরু করেছেন। সাদা পোশাকে পুলিশের লোকজন মোকামে মনিটরিং করছেন।
সদর উপজেলা কৃষি অফিস জানিয়েছে, নতুন ধান কাটা চলছে। ধান বাজারেও আসতে শুরু করেছে। ধানের বাজার কিছুটা বাড়লেও সহনীয় রয়েছে। আর কৃষকের ঘরে পর্যাপ্ত ধান নেই এখন। ফড়িয়াড়ের মজুদ করা ধান বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। আর ধানের দাম ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকার মধ্যে থাকলেও চালের বাজার সহনীয় পর্যায়ে থাকার কথা। সরকার এ বছর ৬ লাখ মেট্রিক টন ধান কিনবে। এতে কৃষক ন্যায্যমূল্য পাবে বলে আশা করছি।
জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেন জানান, মিল মালিকদের ডেকে চালের দাম না বাড়াতে অনুরোধ করা হয়েছি। যৌক্তিক কোনো কারণ না থাকলেও তারা দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। অটো মিল মালিকরা এ কাজটি করছেন। তাদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের অভিযান পরিচালন করা হবে। মোকামে ধান ও চালের মজুদের বিষয়টি নজরদারিতে আছে। এ ছাড়া তারা অন্য খানে গোডাউনে কোনো মুজদ করেছে কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’