আগামী ২০২১-২০২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে করোনার সময় দরিদ্র হওয়া মানুষদের সহায়তা দেয়ার একটি রূপরেখা প্রদান করার আহ্বান জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেছেন, এখন একদিকে দরিদ্র মানুষের মোট সংখ্যা চলমান করোনার আগের সময়ের তুলনায় কমপক্ষে দ্বিগুণ বেড়েছে, আর অন্য দিকে সৃষ্টি হয়েছে নতুন এক দরিদ্রগোষ্ঠী, যারা আগে দরিদ্র ছিলেন না, যাদের বলা যায় ‘নব্য দরিদ্র’ (নিউ পুওর)।
বাংলাদেশ এখন বিপজ্জনক আয়বৈষম্যের দেশে পরিণত হয়েছে। এই বৈষম্য কমার বিষয়ে বাজেটে রূপরেখা থাকতে হবে। তারা আরো বলেন, দেশে কর-জিডিপির অনুপাত এখন অনেক কম। তাই বাড়াতে হবে কর-জিডিপির অনুপাত। এ জন্য জেলা-উপজেলায় পর্যায়ে কর অফিস নিয়ে যেতে হবে।
অন্য দিকে, অর্থমন্ত্রী বলেছেন, যেসব খাত সরাসরি জনগণের স্বার্থের সাথে জড়িত আগামী বাজেটে সেসব খাতের ওপর জোর দেয়া হবে। বিশেষ করে গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ, কৃষি ও স্বাস্থ্য খাতে বিশেষ নজর থাকবে। তিনি দাবি করেন, দেশে কালো টাকা বলে কিছু নেই, যা আছে তা হচ্ছে অপ্রদর্শিত অর্থ।
রোববার দেশের অর্থনীতিবিদদের সাথে ২০২১-২০২২ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট এক ভার্চুয়াল আলোচনায় অর্থনীতিবিদরা এসব কথা বলেন বলে জানা গেছে। আলোচনা পরবর্তী এক সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।
এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, দেশে কালো টাকা বলে কিছু নেই, যা আছে তা অপ্রদর্শিত অর্থ। এটা ঘোষণা দিয়ে সাদা করার নিয়ম এখনো আছে। অপ্রদর্শিত অর্থ বিশেষত জায়গা-জমি বা এ ধরনের সম্পত্তি ক্রয়ে বিনিয়োগ করা হয়ে থাকে। জমি রেজিস্ট্রেশনে বেশি দামে কিনে কম দাম দেখিয়ে কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা রয়েছে। এটা বন্ধ করার জন্য ডিজিটাইলেশন করার কাজ চলছে। এটা পুরোপুরি হয়ে গেলে ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা বন্ধ হবে। অর্থমন্ত্রী জানান, প্রাক-বাজেট আলোচনায় অর্থনীতিবিদরা কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানো, জেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন, প্রণোদনা প্যাকেজ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি যেসব খাত প্রণোদনা সুবিধা পায়নি সেগুলোকে প্যাকেজের আওতায় আনার পরামর্শ দিয়েছেন।
অর্থনীতিবিদদের পরামর্শের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত অত্যন্ত কম। যেসব পণ্যের ওপর যে হারে ট্যাক্স আদায় করা উচিত, আমাদের এখানে সে হারে আদায় হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রেই ট্যাক্স মওকুফ করা হয়ে থাকে। যেমনÑ সরকারের বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে এ ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর জন্য।
অর্থমন্ত্রী আরো বলেন, যেসব খাত সরাসরি জনগণের স্বার্থের সাথে জড়িত আগামী বাজেটে সেসব খাতের ওপর জোর দেয়া হবে। বিশেষ করে গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ, কৃষি ও স্বাস্থ্য খাতে বিশেষ নজর থাকবে। যাতে জনগণের হাতে টাকা-পয়সা যেতে পারে। কারণ আমরা একটি ব্যতিক্রম সময়ে বাজেট প্রণয়ন করতে যাচ্ছি। অর্থনীতিবিদরা তাদের আলোচনায় এসব বিষয় তুলে ধরেছেন। তারা জেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নের ওপর বিশেষ নজর দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। আগামী বাজেটে এসব খাতে বরাদ্দ বাড়বে।
আগামী বাজেটের বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, আগামী বাজেট হবে জনকল্যাণমুখী। প্রধানমন্ত্রী সবসময় দেশের সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তার ওপর জোর দিয়ে আসছেন। তার নির্দেশে আমরা জনকল্যাণমুখী বাজেট প্রণয়নের চেষ্টা করছি। গত বছরও করোনাভাইরাসের মধ্যে বাজেট প্রণয়ন করতে হয়েছে। এ বছরও একই অবস্থা। করোনাভাইরাস একটা আন্তর্জাতিক সমস্যা। এ সময় শুধু দেশীয় বিবেচনায় কিছু করা সম্ভব নয়। কাজেই অত্যন্ত সতর্কতার সাথে আমাদের কাজ করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমান বৈশ্বিক বিপর্যয়ে দেশীয় শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা প্রয়োজন তার সবটাই করা হবে। পাশাপাশি করপোরেট করহার কমানোরও ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী বলেন, পর্যায়ক্রমে করপোরেট ট্যাক্স কমিয়ে আনা হচ্ছে। চলতি বাজেটে এটা কমানো হয়েছে, আগামী বাজেটেও বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।
সামনে কড়া লকডাউনে খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বার্তা আছে কিনাÑ জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী সব সময় সাধারণ মানুষের পাশে আছেন। আগেও তাদের জন্য ব্যবস্থা নিয়েছেন। এবারো হয়তো সেভাবে সাহায্য করবেন। প্রধানমন্ত্রী যেভাবে নির্দেশনা দেবেন, আমরা সেভাবেই কাজ করব।
সভায় বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান ড. রেহমান সোবহান, সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইদুজ্জামান, ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান, সাবেক সিনিয়র অর্থসচিব ড. মোহাম্মদ তারেক, গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান ড. জায়েদি সাত্তার, নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত, সাধারণ সম্পাদক ড. জামালউদ্দিন আহমদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে অধ্যাপক আবুল বারকাত বলেন, এ কথা অনস্বীকার্য এবং গবেষণায় প্রমাণিত যে, করোনার লকডাউনের প্রভাবে ‘নিরঙ্কুশ দরিদ্র’ (অ্যাবসুলুট পুওর) মানুষ ‘হতদরিদ্র-চরম দরিদ্র’ (আল্টা পুওর)) হয়েছেন; আর নিন্মবিত্ত মানুষের ব্যাপকাংশ দরিদ্র হয়েছেন এবং মধ্য-মধ্যবিত্তদের একাংশ বিত্তের মানদে নিম্নগামী হয়েছেন। ফলে এখন এক দিকে দরিদ্র মানুষের মোট সংখ্যা করোনাকালীন সময়ের আগের তুলনায় কমপক্ষে দ্বিগুণ বেড়েছে। কোভিড-১৯ বাংলাদেশকে উচ্চ আয় বৈষম্যের দেশ এবং বিপজ্জনক। এমতাবস্থায় বাজেটপ্রণেতাদের উদ্দেশে সুস্পষ্ট প্রস্তাব হলো, আয়-সম্পদ-স্বাস্থ্য-শিক্ষা বৈষম্য হ্রাসের যত পথ-পদ্ধতি আছে তার সবই যত দ্রুত সম্ভব সমাধানের চেষ্ট করা। এখন আয় বৈষম্যের দেশে রূপান্তরিত করে ছেড়েছে।