রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৪১ পূর্বাহ্ন

পবিত্র কোরআন নাজিলের মাস রমজান

মো: আবু নসর
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২১
  • ২১৫ বার

রমজান মানবজাতির জন্য বিশেষ এক তাৎপর্যপূর্ণ মাস। রোজা এক মাসের কিন্তু এর শিক্ষা ১২ মাসের। এটা রূহ তাজা করার সাধনার মাস। রমজান রহমতের ফল্গুধারা। রোজা ইবাদতের দরজা। একে মহান আল্লাহ তায়ালা বিস্ময়কর এবং অসাধারণ বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল করেছেন। মানবজাতির আত্মিক উন্নতি, কল্যাণ এবং আত্মশুদ্ধি ও আত্মসংশোধনের লক্ষ্যে আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে রমজান মাসেই আসমানি গ্রন্থ নাজিল করেছেন। মহাগ্রন্থ আল কুরআন রমজান মাসের কদরের রাতে নাজিল হয়েছে। পবিত্র কুরআনই মানবজাতির একমাত্র নির্ভুল জীবন দর্শন ও পথ-নির্দেশিকা। মহান আল্লাহ তায়ালা মুক্তির নির্দেশনাস্বরূপ মানবজাতির ও মানব কল্যাণের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিভাবক পবিত্র আল-কুরআন এই রমজান মাসেই নাজিল করেছেন। পাক কুরআনের বদৌলতে এই মাসটির ফজিলত ও হাকিকত অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

রোজা রাখার নিয়ম সর্বযুগেই ছিল। রোজা শুধু নবী করিম সা:-এর প্রতি ফরজ করা হয়নি, পূর্ববতী নবী রাসূলদের প্রতিও ফরজ করা হয়েছিল।

ইতিহাসে জানা যায় চীন, জাপান, কোরিয়া, মিসর ও গ্রিস প্রভৃতি দেশে রোজার প্রচলন ছিল। ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের জন্যও পবিত্র রোজা পালনের নিয়ম ছিল। ইহুদিদের ওপর প্রতি শনিবার এবং প্রতি বছরে ১০ মহররম আশুরার দিন ও অন্যান্য সময়েও রোজা আবশ্যক ছিল। খ্রিষ্টানরা মুসলমানদের মতো রোজা ফরজ ইবাদত হিসেবে পালন করত। বাইবেলে রোজাব্রত পালনের মাধ্যমেই আত্মশুদ্ধি ও কঠোর সংযম সাধনার নজির পাওয়া যায়। এমনকি, বেদের অনুসারী হিন্দুদের মধ্যেও ব্রত অর্থাৎ উপবাসের নিয়ম আছে। সুতরাং জাতি ধর্ম নির্বিশিষে সবার মধ্যে রোজা পালনের প্রমাণ পাওয়া যায়। নিয়ম-কানুন, ধারণা-প্রক্রিয়া ও সময়ের ভিন্নতা থাকলেও মানবজাতির আত্মশুদ্ধির জন্য আদি যুগ থেকেই অনেক গোত্র, বর্ণ, সম্প্রদায় এবং বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মধ্যে রোজা রাখার প্রথা প্রচলিত ছিল।

মুসলমানদের রোজার জন্য পবিত্র রমজান মাসই নির্ধারিত। রমজান মাস নারী-পুরুষদের সংযম ও আত্মশুদ্ধির প্রশিক্ষণ এবং নৈতিক মূল্যবোধকে শীর্ষস্থানে পৌঁছিয়ে দেয়। রোজা সংযমের মাধ্যমে নর-নারীদের নৈতিকতা, আদর্শ, স্বচ্ছতা ও নিষ্ঠা প্রোথিত করে। মানুষের আত্মার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, মিথ্যার ওপর সত্য, অন্যায়ের ওপর ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করে এবং পশুত্বকে অতিক্রম করে মনুষ্যত্বকে প্রতিষ্ঠা করে। রমজানের ঈমানদারদের বড় অর্জন হলো নিজের কাছে সৎ ও বিশ্বস্ত থাকা। এতে সহায়ক হলো আল্লাহর অস্তিত্বের উপস্থিতির অনুভূতি। এটা মাহে রমজানের শিক্ষা।

রমজানে রোজা রাখার প্রতিদান সব প্রতিদানের ঊর্ধ্বে। আল্লাহ তায়ালা এই মহান ইবাদতকে তার নিজের জন্য নিজস্ব ও একান্ত করে রেখেছেন। তাই তিনি রোজাদারদের রোজার প্রতিদান নিজেই দেবেন।

রমজান বা রামাদান শব্দের উৎপত্তি আরবি রমজ বা রামদ ধাতু থেকে। রমজ বা রামদ-এর আভিধানিক অর্থ হলো- দহন, জ্বালানো, পোড়ানো। মূলশব্দ হলো- ‘রামাজ’ অর্থাৎ জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া বা পুড়িয়ে ভস্ম করে দেয়া। ‘রোজা’ ফারসি শব্দ। আরবিতে বলা হয় ‘সাওম’। অর্থাৎ আত্মসংযম, সংযত রাখা ও বিরত থাকা প্রভৃতি। ব্যবহারিক অর্থে ও ইসলামী শরিয়াহর পরিভাষায় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ইবাদতের নিয়তে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যাবতীয় পানাহার আর ইন্দ্রিয় তৃপ্তি থেকে বিরত থাকার নাম রোজা বা সাওম। রোজা রাখার উদ্দেশ্য না খেয়ে শরীরকে নিছক দুর্বল ও অকর্মণ্য করা নয় বরং শরীরকে সামান্য কষ্ট দিয়ে অভ্যাসের পরিবর্তন ও বিরুদ্ধাচরণ করে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য ইত্যাদি রিপুকে বশ করে নফস বা প্রবৃত্তিকে শায়েস্তা করা। তাই রমজান মাস আত্মশুদ্ধির মাস।

রোজা রাখার মূল উদ্দেশ্য তাকওয়া বা আল্লাহভীতি অর্জন। তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ন্যায় নীতি, আদর্শ, নৈতিক মূল্যবোধ ও গভীর জীবনবোধ সৃষ্টি হয়। রমজান মাসে প্রত্যেক রোজাদার ব্যক্তিকে অবশ্যই তাকওয়ার গুণাবলি অর্জন করতে হয়। এ জন্য মাহে রমজান ও তাকওয়া ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আরবি ‘তাকওয়া’ শব্দের আভিধানিক অর্থ আল্লাহভীতি, পরহেজগারি, দ্বীনদারি, ভয় করা, বিরত থাকা, আত্মশুদ্ধি, নিজেকে কোনো বিপদ-আপদ বা অনিষ্ট থেকে রক্ষা করা প্রভৃতি। ইসলামী শরিয়াহর পরিভাষায় আল্লাহ তায়ালার ভয়ে সব ধরনের অন্যায়, অত্যাচার ও পাপাচার বর্জন করে পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশানুযায়ী জীবন পরিচালনা করার নামই তাকওয়া। ইসলামে তাকওয়ার চেয়ে অধিক মর্যাদা সম্পন্ন কোনো কাজ নেই। আল্লাহর দ্বীনের প্রাণশক্তিই হলো তাকওয়া।

মাহে রমজানে রোজার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও শিক্ষা হলো হৃদয়ের পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা। তাকওয়ার অধিকারী বা মুত্তাকির বৈশিষ্ট্য অর্জনের জন্য পবিত্র কুরআনে আল্লাহ ঘোষণা করেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর; যেন তোমরা মুত্তাকি বা আল্লাহভীরু হতে পারো।’ (সূরা আল বাকারা, আয়াত-১৮৩) রমজান মানুষকে প্রকৃত কল্যাণের পথে নিয়ে যায়। রোজায় তাকওয়া বা আল্লাহভীতি নিশ্চিত হয় এবং অত্যন্ত গভীরভাবে ধর্মীয় আদেশ নির্দেশ বা অনুশাসন সঞ্চারিত হয়। এতে আল্লাহর বান্দার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিও নিশ্চিত হয়। ঈমান ও আমলের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণের মাপকাঠি হলো তাকওয়া বা আল্লাহভীতি। সুতরাং ইহকালীন কল্যাণ ও পারলৌকিক মুক্তির জন্য মাহে রমজানে রোজা পালন করা অত্যাবশ্যক ও জরুরি।

রোজা আত্মিক নিয়মানুবর্তিতার একটি কার্যকর উপায়, যা মানুষকে নৈতিক শৃঙ্খলার প্রকৃত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেয়। এমনিভাবে মাহে রমজানের মূল্যবোধ সমগ্র মুসলিম বিশ্বে সাম্য, মৈত্রী, ঐক্য, সংযম, সহনশীলতা ও সহমর্মিতা প্রদর্শনের শিক্ষা দান করে। তাই রোজার কিন্তু শিক্ষা ১২ মাসের। রমজান মাসে রোজাদারদের মধ্যে যে মানবিক মূল্যবোধ, আত্মিক, নৈতিক, আদর্শিক ও চারিত্রিক গুণাবলি বিকশিত হয়, তা যদি সারা বছর অব্যাহত থাকে, তাহলে এ সমাজ শান্তির পাদপীঠে পরিণত হতে পারে।

লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, কলারোয়া সরকারি কলেজ, সাতক্ষীরা

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com