রোজা জীবন বদলানোর মাস। বিনয়ী সহনশীল হয়ে ওঠার মাস। মানুষে-মানুষে সৌহার্দ রচনার মাস। এ সময় বদলে যায় জীবনের রঙ। দূর হয়ে যায় সব অশুভ আচরণ। জীবননদীর কোনো বাঁকেই থাকবে না- ঝগড়া-প্রতারণা, বিশৃঙ্খলা, অধর্য, অসহিষ্ণুতা। হজরত আবু হুরায়রা (র) থেকে বর্ণিত- রাসুল (স) এরশাদ করেন, তোমাদের কেউ যখন রোজা রাখে সে যেন অশ্লীলতা ও অসরতা থেকে বেঁচে থাকে। আর কেউ যদি তার সঙ্গে ঝগড়া করতে আসে বা তাকে গালি দেয়; তখন সে যেন বলে দেয় আমি রোজাদার (মুসনাদে আহমদ : ৭৩৩৬)।
এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, তোমরা পিতা-মাতার সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করবে, নিকট আত্মীয়দের, এতিম-মিসকিনদের, নিকটস্থ প্রতিবেশী ও দূরবর্তী প্রতিবেশীদের, বন্ধুবান্ধব ও পথিকদের প্রতিও সুন্দর ব্যবহার করবে (সূরা বাকারাহ : ৮৩)।
রমজান ১১ মাসের জীবনচিত্রের মতো নয়; রোজায় চলনে-বলনে আসবে শালীনতা। অন্য সময়ের মতো, বাসে ওঠা যাত্রীদের লাইন ভেঙে বিশৃঙ্খল পরিবেশের জন্ম দেব না। বাসে-ট্রেনে নির্ধারিত ভাড়ার বেশি ভ্রমণ করব না। দর কষাকষির অজুহাতে, ঝগড়ায় মেতে উঠব না। বাসের হেলপার, হোটেলের বয়, খেটে খাওয়া রিকশা চালকের সঙ্গে খারাপ আচরণ করব না।
রোজায় চোখে পড়ে ‘রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করুন’ ধরনের ব্যানার, ফেস্টুন, লিফলেট ও পোস্টার। গতানুগতিক ধারায় ‘রোজার পবিত্রতা রক্ষা করুন’ বলে লিখে গেলে সিগারেটের গায়ে ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’ লেখাটির মতোই গুরুত্ব পাবে। সমাজের সর্বত্র ইফতারের নামে প্রচুর অপচয় হয়। এ অপচয় রোধ করতে হবে। কোরআনে অপচয় সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, তোমরা অপচয় করবে না। অপচয়কারী শয়তানের ভাই। শয়তান আল্লাহর সঙ্গে অকৃজ্ঞতা করেছে (সূরা ইসরা : ২৬)।
এ ছাড়া রোজার পবিত্রতা রক্ষার দাবিদার অনেক প্রতিষ্ঠান মিথ্যা ও প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপণ প্রচার করে। লোভনীয় বিজ্ঞাপনের সুবাদে প্রচার পাওয়া সামগ্রীতে বিজ্ঞাপনে প্রচারিত তথ্যের সঙ্গে মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। রোজার পবিত্রতা রক্ষা করতে হলে এ মাসে বিজ্ঞাপন প্রচারে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভোক্তের সঙ্গে কোনোও রূপ প্রতারণা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। রোজায় রেস্টুরেন্ট অবাধে খোলা না রেখে বিধিনিষেধ আরোপ করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে অসুস্থ ও শিশুদের খাদ্যপ্রাপ্তির বিষয়টি খেয়াল রাখা উচিত। কোনো মতেই ঢালাওভাবে রেস্টুরেন্ট বন্ধ রাখার প্রস্তাব দেওয়ার মতো নির্বুদ্ধিতার পরিচয় আমরা যেন না দিই। দেশে মুসলিমদের পাশাপাশি ভিন্ন ধর্মের লোকজনও আছে। তাদের আছে সহজ লভ্যে খাবার পাওয়ার অধিকার। আছে অসুস্থ নারী, শিশু কিংবা মুসাফির। তাদের জন্যও বিকল্প ব্যবস্থা রাখা উচিত।
রোজার পবিত্রতা রক্ষার প্রধান শর্ত হলো, আমাদের আচার-আচরণে শৃঙ্খলা বজায় রাখা। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বন্ধ করা। সিনেমা হল ও টিভি চ্যানেলগুলোতে অশ্লীল ছবি প্রদর্শন করা থেকে বিরত থাকা। শিল্পপতি, কারখানার মালিক ও ব্যবসায়ীরা সব সময় অধিক লাভের আশায় চিন্তিত থাকেন। সে লক্ষ্যে প্রতারণামূলক বিজ্ঞাপন প্রচারের আশ্রয়ও গ্রহণ করেন। প্রচারপটুতার এ চিন্তা ত্যাগ করে, সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক বজায় রাখা উচিত। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন- হে বিশ্বাসীরা, তোমরা ধৈর্য ধারণ কর, সহিষ্ণু ও সুপ্রতিষ্ঠিত হও, আল্লাহকে ভয় কর, যাতে সাফল্যলাভ করতে পার।
প্রবাদ আছে- সোনা পুড়ে পুড়ে খাঁটি হয়। রোজাদারও ক্ষুধা-তৃষ্ণার আগুনে পুড়ে সংযমী হয়ে উঠবে। এভাবে নিজেকে পুড়িয়ে ক্রমাগত আত্মশুদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবে। রাসুল (স) বলেন, যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা কথা ও কাজ পরিত্যাগ করেনি, তার দিনভর উপোস কোনো উপকারে আসবে না (বুখারি : ১৮০৪)।
নবীজি (স) আরও বলেছেন, পারস্পরিক স্নেহ-মমতা, ভালোবাসা ও সহমর্মিতার দিক থেকে ইমানদারদের উদাহরণ হলো একটি দেহের মতো। এর একটি অঙ্গ যদি ব্যথাপ্রাপ্ত হয়, তা হলে সারা দেহ অনিদ্রা ও জ্বরে কাতর হয়ে পড়বে (সহিহ ইবনে হিব্বান)।
আমাদের জীবনচিত্র দুঃখজনক। আমরা কোর্ট-অফিসে মিথ্যাচার করি। কলমের কালি, মিডিয়ার পর্দায় মিথ্যাচার হয়। হাটে-বাজারে ঘরে বাইরে মিথ্যার ছড়াছড়ি। আসুন রোজাকে কেন্দ্র করে হলেও আমাদের এ অসদাচরণগুলো ত্যাগ করি। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
লেখক : সম্পাদক, আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম