রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৫৫ অপরাহ্ন

উগ্রবাদবিরোধী কর্মসূচির ৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৯
  • ২৯৭ বার

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (ইফা) উগ্রবাদ ও সন্ত্রাস বিরোধী কর্মসূচির ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে অনিয়ম ধরা পড়েছে। এর সাড়ে ৫ কোটি টাকা কোনো কাজ ছাড়া তুলে নেয়া হয়েছে। কর্মসূচি পালন ছাড়াই পৌনে ২ কোটি টাকা, বই না ছাপিয়ে ৩ কোটি ২৯ লাখ টাকা এবং ইফা প্রেসে স্থানান্তর করে ৫১ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া ইমাম সম্মেলনে ব্যয়ের নামে ১৮ লাখ টাকা, এক বছরের বরাদ্দ টাকা ফেরত না দিয়ে পরের বছর ব্যয় দেখিয়ে ৫৮ লাখ টাকা, অর্থবছরের শেষ দিনে জেলাপর্যায়ে স্থানান্তর করে ৭৯ লাখ টাকার অনিয়ম করা হয়েছে।

সিভিল অডিট অধিদফতরের বিশেষ নিরীক্ষায় ইফার উগ্রবাদবিরোধী কর্মসূচির টাকা ব্যয়ের ক্ষেত্রে ৬টি ঘটনায় ৬ কোটি ৯৫ লাখ ৫ হাজার ৮৩২ টাকার অনিয়মের বিষয় উঠে আসে। অনিয়মের টাকা ফেরত দেয়ার পাশাপাশি দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে রিপোর্টে।

ইফার ২০০৯-২০১৮ অর্থবছরের ১০ বছরের নিরীক্ষায় ৯৬টি খাতে সর্বমোট ৭৯৬ কোটি ৭৮ লাখ টাকার অনিয়ম বেরিয়ে আসে। প্রাথমিক অভিযোগে অনিয়মের টাকার অংশ প্রায় হাজার কোটি ছিল।
প্রেষণে নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারিক কর্মকর্তা সামীম মোহাম্মদ আফজল ২০০৯ সাল থেকে ইফা ডিজির দায়িত্ব পালন করে আসছেন। আগামী ৩১ ডিসেম্বর তার সর্বশেষ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ শেষ হবে।

গত ৯ জুলাই থেকে ১০ অক্টোবর পরিচালিত এই নিরীক্ষার খসড়া রিপোর্টটি গত ২৪ নভেম্বর ধর্ম মন্ত্রণালয়ে অ্যাগ্রিড মিটিংয়ের মাধ্যমে চূড়ান্ত হয়। ধর্ম মন্ত্রণালয়, ইসলামিক ফাউন্ডেশন এবং অডিট সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
সিভিল অডিট অধিদফতরের উপ-পরিচালক এম এম নিয়ামুল পারভেজের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের টিম এই নিরীক্ষা পরিচালনা করে। এতে ইফার ১২টি কার্যালয়ের ২০০৯-১৮ সালের বরাদ্দ ও ব্যয় খতিয়ে দেখা হয়।

জানতে চাওয়া হলে অডিট টিমের একজন সদস্যসহ ধর্ম মন্ত্রণালয় ও ইফার একাধিক কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে জানান, ইফার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহের জবাবে নিরীক্ষা দল সন্তুষ্ট হয়নি। তবে ফেরত দেয়া অর্থ সমন্বয় করা হয়েছে। আরো কিছু ফেরত দেয়ার ডকুমেন্ট পেলে সমন্বয় করা হবে। ইতোমধ্যেই অ্যাগ্রিড মিটিং হয়ে গেছে। ওখানে খসড়া রিপোর্টটি চূড়ান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ছোটখাটো কিছু পরিবর্তন করে চূড়ান্ত রিপোর্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া প্রক্রিয়াধীন। এর আগে নিরীক্ষার প্রাথমিক প্রতিবেদনে ইফার ১৩৪টি খাতে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার অনিয়মের অভিযোগের ব্যাপারে ইফার জবাব চাওয়া হয়। এরপর ইফা ডিজির পক্ষ থেকে কয়েক দফায় প্রায় ৮২ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দেয়াসহ জবাব দেয়া হয়। জবাবগুলো আবার খতিয়ে দেখে চূড়ান্ত খসড়া নিয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয় ও ইফা কর্মকর্তাদের সাথে গত মাসে বৈঠকে বসে অডিট টিম এবং সেখানেই রিপোর্টটি চূড়ান্ত করা হয়।

সেমিনারের অস্তিত্ব নেই অথচ ব্যয় পৌনে ২ কোটি টাকা : ২০১১-১২ অর্থবছরে উগ্রবাদ, সন্ত্রাস প্রতিরোধ ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে ইসলাম কর্মসূচির আওতায় সেমিনার সম্মেলনসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালনের নামে ১ কোটি ৭৯ লাখ ২২ হাজার ৩০৮ টাকা পরিশোধ করা হয়। কিন্তু এমন অনুষ্ঠান পালনের কোনো প্রমাণ বা বিল ভাউচার দেখাতে পারেনি ইফা। এই টাকা ইফার জেলা অফিসগুলোতে পাঠানোর হিসাব দেখানো হয়। টাকা ডিডি মারফত পাঠানোর কথা বলা হলেও ডিডি পাঠানোর কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি তারা। প্রকল্প কার্যালয়ে রিপোর্ট আকারেও এমন অনুষ্ঠানা পালনের কোনো তথ্য বা অব্যয়িত অর্থের হিসাব জেলা অফিস থেকে পাঠানো হয়নি। এ ব্যাপারে ইফার পক্ষ থেকে অডিট আপত্তির কোনো জবাবও দেয়া হয়নি। ফলে এই টাকা আত্মসাৎ হয়েছে বলে সাব্যস্ত করে নিরীক্ষা দল। সে অনুযায়ী দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে টাকা আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে বলা হয়।

উগ্রবাদবিরোধী বই না ছাপিয়ে ৩ কোটি ২৯ লাখ টাকার বিল উত্তোলন : সন্ত্রাস প্রতিরোধ ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে ইসলাম শীর্ষক কর্মসূচির পুস্তক মুদ্রণ ও বাঁধাই বাবদ ৩ কোটি ২৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করা হলেও পুস্তক মুদ্রণের কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি ইফা।

‘সামাজিক সমস্যা সমাধানে ইসলাম’ নামের একটি বই ছাপার জন্য ২০১০-১১ অর্থবছরে ২ লাখ ২০ হাজার কপি এবং ২০১১-১২ অর্থবছরে ২ লাখ ৮০ হাজার কপির কার্যাদেশ হয়। এই কার্যাদেশ অনুযায়ী বিল গ্রহণের নথিপত্র পাওয়া গেলেও বই ছাপানো বা কোথাও পাঠানোর কোনো রেকর্ড দেখাতে পারেনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন। এই অভিযোগের জবাবও দেয়নি ইফা। ফলে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাসহ ওই টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে বলা হয়েছে নিরীক্ষায়।

উগ্রবাদবিরোধী কর্মসূচির ৩১ লাখ টাকা প্রেসে স্থানান্তর করে লোপাট : উগ্রবাদ ও সন্ত্রাস প্রতিরোধ কর্মসূচির বরাদ্দ থেকে ইফা প্রেসে প্রদানের নামে ৩০ লাখ ৫৩ হাজার ৭২৯ টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে এই টাকা স্থানান্তরের বিষয়টি পাওয়া গেলেও এই টাকার কোনো হিসাব দেখাতে পারেনি ইফা। এ ছাড়া উগ্রবাদবিরোধী প্রচারণার টাকা ইফা প্রেস খাতে কেনো স্থানান্তর করা হয়েছে সেই বিষয়েও কোনো জবাব পায়নি অডিট টিম। এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগেরও কোনো জবাব দেয়নি ইফা। ফলে অভিযোগটি সরাসরি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জানিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দিতে বলা হয়েছে।

উগ্রবাদবিরোধী বরাদ্দের ১৮ লাখ টাকা ইমাম সম্মেলনে ব্যয় দেখিয়ে নয়ছয় : জাতীয় ইমাম সম্মেলন ২০১১ এর অনুষ্ঠানে ব্যয় দেখিয়ে উগ্রবাদ, সন্ত্রাস প্রতিরোধ ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে ইসলাম প্রকল্পের ১৮ লাখ ২০ হাজার টাকা ইমাম প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে দেয়া হয়। কিন্তু ২০১১-১২ অর্থবছরে ইমাম প্রশিক্ষণ অ্যাকাডেমির সম্মেলন খাতে নিয়মিত বরাদ্দ রয়েছে এবং যথারীতি ব্যয়ও দেখানো হয়েছে। এই অভিযোগের জবাবে ইফার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ইমাম সম্মেলনের বাজেট বরাদ্দ সীমিত থাকায় এই টাকা কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু নিরীক্ষায় এই জবাব নাকচ করে দিয়ে বলা হয়েছে উগ্রবাদ প্রতিরোধ কর্মসূচির টাকা ইমাম সম্মেলনে ব্যয় করা যাবে এমন কোনো প্রমাণপত্র জবাবের সাথে ইফা দিতে পারেনি। ফলে অনিয়মের অর্থ সরকারি কোষাগারে ফেরত দিতে বলা হয়েছে।

সন্ত্রাস উগ্রবাদ খাতের অব্যয়িত ৫৮ লাখ টাকা ফেরত না দেয়া : ২০১৬-১৮ দুই অর্থবছরে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ খাতে অব্যয়িত ৫৮ লাখ ৩৭ হাজার ৭৯৫ টাকা জমা না দিয়ে বেআইনিভাবে পরবর্তী বছর খরচ দেখানো হয়েছে। অথচ কোন অর্থবছরে অব্যয়িত টাকা অর্থবছরের শেষ কর্মদিবস ৩০ জুনের মধ্যে সরকারি কোষাগারে সুদসহ জমা দেয়া বাধ্যতামূলক।
এই অনিয়মের ব্যাপারে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের জবাবে বলা হয়েছে, ৩ লক্ষাধিক মসজিদের ইমাম, খতিব ও বিশিষ্ট আলেম এবং মউশিক প্রকল্পের অধীনে সম্মানী ভিত্তিতে কর্মরত ৭৪ হাজার শিক্ষককে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ করতে এই টাকা খরচ করা হয়েছে। দেশের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা এবং কর্তৃপক্ষের অনুমোদন মোতাবেক এই ব্যয় করা হয়েছে। তবে নিরীক্ষায় এই জবাবকে স্বীকৃতিমূলক আখ্যায়িত করা হলেও জবাব সন্তোষজনক নয় উল্লেখ করে টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে বলা হয়েছে।

অর্থবছরের শেষ দিনে উগ্রবাদ ফান্ডের ৭৯ লাখ টাকা স্থানান্তর : ২০১৬-১৭ অর্থবছরের শেষ দিন অর্থাৎ ৩০ জুন সন্ত্রাস ও উগ্রবাদ কর্মসূচির বরাদ্দ থেকে ৬৪টি জেলা কার্যালয়ে ৭৯ লাখ ২২ হাজার টাকা ছাড় করা হয়। অথচ ওই তারিখে এই ধরনের টাকা ছাড় করার অবকাশ নেই। বরং আইন অনুযায়ী এই তারিখে বরাদ্দের অব্যয়িত টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ ছাড়াও এই টাকা ব্যয়ের স্বপক্ষে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত কোনো পরিকল্পনা নেই।
এই অভিযোগের ব্যাপারে ইফার জবাবে কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে সন্ত্রাস ও উগ্রবাদ বিরোধী প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য এই টাকা স্থানান্তরের কথা জানানো হলেও নিরীক্ষায় তা প্রত্যাখ্যান করে টাকা সরকারি কোষাধারে জমা দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com