ইসলামিক ফাউন্ডেশনে (ইফা) গত ১০ বছরে ১ হাজার ৭৫৫ জনবল নিয়োগে অনিয়ম ও জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেছে সরকারি নিরীক্ষায়। এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি ৭৯ কোটি টাকা।
জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের পেশ ইমাম নিয়োগে জালিয়াতি ও ভুয়া মাদরাসার নামধারী শিক্ষক, সার্টিফিকেট, বয়স জালিয়াতি মৌখিক পরীক্ষায় নম্বর পরিবর্তন, নম্বর বেশি দেখানো শিক্ষাগত যোগ্যতার জাল সনদ এবং অর্গানোগ্রাম বহির্ভূত পদে নিয়োগের মতো অনিয়মের ৩৫টি ঘটনা ধরা পড়েছে। প্রায় সবটিতেই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আদেশ, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা এবং ইফার নিয়োগবিধি লঙ্ঘন করা হয়েছে। এ জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে।
২০০৯-২০১৮ সাল পর্যন্ত ইফার ১০ বছরের কার্যক্রমের ওপর বিশেষ নিরীক্ষা চালায় সিভিল অডিট অধিদফতর। এতে ৯৬টি খাতে ৭৯৬ কোটি ৭৮ লাখ টাকার অনিয়ম বেরিয়ে আসে। নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রেই বেশি অনিয়মের ঘটনা দেখা যায়। বিচারিক কর্মকর্তা সামীম মোহাম্মদ আফজল ২০০৯ সাল থেকে ইফা মহাপরিচালকের (ডিজি) দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
গত ৯ জুলাই থেকে ১০ অক্টোবর পরিচালিত এই নিরীক্ষার খসড়া রিপোর্টটি গত ২৪ নভেম্বর ধর্ম মন্ত্রণালয়ে অ্যাগ্রিড মিটিংয়ের মাধ্যমে চূড়ান্ত হয়। ধর্ম মন্ত্রণালয়, ইফা ও অডিট সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এতে ইফার ১২টি কার্যালয়ের জন্য ২০০৯-১৮ সালের বরাদ্দ ও ব্যয় খতিয়ে দেখা হয়। নিরীক্ষার প্রাথমিক প্রতিবেদনে ইফার ১৩৪টি খাতে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার অনিয়মের অভিযোগের ব্যাপারে জবাব চাওয়া হয়। এরপর ইফা ডিজির পক্ষ থেকে কয়েক দফায় প্রায় ৮২ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত দেয়াসহ জবাব দেয়া হয়। তারপরই গত মাসে ধর্ম মন্ত্রণালয়ে সর্বশেষ বৈঠকে রিপোর্টটি চূড়ান্ত হয়।
বায়তুল মোকাররমের পেশ ইমাম নিয়োগে জালিয়াতি : নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা ও চাকরির বয়স না থাকা এবং কম যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে বায়তুল মোকাররমের পেশ ইমাম ও ভাষাশিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। একজন পেশ ইমাম নিয়োগের ক্ষেত্রে খতিব হিসেবে অভিজ্ঞতার প্রত্যয়নপত্র দেয়া হয়েছে ৫/০৩/২০০৩ সাল থেকে। অথচ তিনি দাওরায়ে হাদিস পাস করেছেন ২০০৫ সালে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে পেশ ইমাম পদের জন্য প্রথম শ্রেণীর কামিল সমমান দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রি চাওয়া হয়। কিন্তু তিনি দাওরায়ে হাদিস পাস করেছেন ২০০৫ সালে। তখন দাওরায়ে হাদিস কামিলের সমমান ছিল না। দাওরায়ে হাদিসকে কামিলের সমমান দেয়া হয়েছে ২০১৮ সালে। এই পদে নিয়োগের জন্য মুফাসসির পদে পাঁচ বছর চাকরি করার অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়।
কিন্তু এমন অভিজ্ঞতা সনদ নিয়োগপ্রাপ্ত ইমামের নেই। সিলেকশন কমিটির ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১২ তারিখের সভায় পেশ ইমাম পদটিকে টেকনিক্যাল কোটা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অথচ এটি টেকনিক্যাল পদ নয়। এটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের স্মারকের পরিপন্থী। পেশ ইমাম পদে আনোয়ারুল হকের নিয়োগের ক্ষেত্রে বয়স কম দেখানো হয়। তার বায়োডাটায় দাওরায়ে সনদপত্রে জন্মতারিখ ১৬/০৫/১৯৭৪, কিন্তু বিজ্ঞপ্তিতে দেয়া বয়স তিন বছর কমিয়ে ১৬/০৫/১৯৭৭ দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া তার প্রাপ্ত নম্বর ৫০.১১। একই পদে অন্য আবেদনকারী ইলিয়াস হোসেনের প্রাপ্ত নম্বর ৫০.৪৪। অথচ আনোয়ারুল হককে প্রথম স্থান অধিকার দেখিয়ে নিয়োগ দেয়া হয়। একজন ইমামকে খতিব হিসেবে পাঁচ বছর পূর্ণ করার জন্য ২০০৩ সাল থেকে অভিজ্ঞতা দেখানো হয়েছে এবং তার দাওরায়ে হাদিস পাস সনদের একটি ফটোকপি নথিতে পাওয়া যায়, মূল সার্টিফিকেটের কোনো নমুনা পাওয়া যায়নি।
ইফার চাকরি বিধিমালা-১৯৯৮ এর শর্ত পরিপালন না করেই এসব নিয়োগ দেয়া হয়। তবে ইফার পক্ষ থেকে বিধি অনুযায়ী নিয়োগের দাবি করা হয়। নিরীক্ষায় এই দাবি নাকচ করে দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং নিয়োগকৃতদের বেতনভাতা বাবদ প্রদত্ত টাকা ফেরৎ নেয়ার সুপারিশ করা হয়।
ডিজির বাড়িতে মাদরাসা দেখিয়ে শিক্ষকের বেতন পরিশোধ: মাদরাসার কোনো অস্তিত্ব নেই অথচ মাদরাসার দুই শিক্ষকের বেতন ভাতা পরিশোধ করা হয়। মাদরাসাটির জায়গার মালিক ইফার ডিজি সামীম মোহাম্মদ আফজল। মোহাম্মদ জোনের চাঁদ উদ্যান মাদরাসা নামে দুইজন শিক্ষকের বেতন বাবদ ৪৫ হাজার ২০০ টাকা পরিশোধ করা হয়। ওই বাড়িতে কোনো মাদরাসা নেই, অথচ মো: শাহাদাত ও মো: আলী নামে দুইজন মাদরাসা শিক্ষককে এপ্রিল-১৮ থেকে জুলাই ২০১৯ পর্যন্ত ১৬ মাস ঈদ বোনাসসহ ২০টি বেতন বোনাস অনিয়মিতভাবে পরিশোধ করা হয়। এ ব্যাপারে ইফার জবাবে উক্ত দুই শিক্ষক যথাযথ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পেয়ে নিয়মিত পাঠদান করে যাচ্ছেন বলে দাবি করা হয়। নিরীক্ষক দল জবাব সন্তোষজনক নয় জানিয়ে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা এবং প্রদত্ত টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার সুপারিশ করেছে।
বিধি লঙ্ঘন করে পরিচালক পদে ১৯ জনের পদোন্নতি : ২০১৭ সালে বিধি লঙ্ঘন করে পরিচালক পদে ১৯ জন এবং হিসাব নিয়ন্ত্রক পদে একজনকে পদোন্নতি দেয়া হয়। এক্ষেত্রেও অর্গানোগ্রামের বাইরে ৯ জন অতিরিক্ত পরিচালককে পদোন্নতি দেয়া হয। এই পদোন্নতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক গঠিত কমিটির মাধ্যমে হয়নি। ইফা বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই ডিজির স্বাক্ষরে ১১/১০১৭ পদোন্নতির আদেশটি জারি করা হয়। ইফার পক্ষ থেকে সিলেকশন কমিটির মাধ্যমে এই পদোন্নতি দেয়ার কথা বলা হয়। বিধি লঙ্ঘন করে এই পদোন্নতি দেয়ায় নিরীক্ষায় দায়ীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
অর্গানোগ্রামের বাইরে আইন উপদেষ্টা ও মহিলা কো-অর্ডিনেটর নিয়োগ : ইফার অর্গানোগ্রামে আইন উপদেষ্টা ও মহিলা কো-অর্ডিনেটর নামে কোনো পদের অস্তিত্ব নেই। কিন্তু আব্দুর রহমান মাছউদ (এ আর মাছউদ) চুক্তিভিত্তিক আইন উপদেষ্টা এবং কামরুন্নেছা মান্নানকে মহিলা কো-অর্ডিনেটর নিয়োগ দেয়া হয়। আইন উপদেষ্টাকে ১২ জুলাই ২০১৭ থেকে এপ্রিল ২০১৯ পর্যন্ত মাসিক এক লাখ ২১ হাজার ৩০০ টাকা এবং মহিলা কো- অর্ডিনেটরকে মাসিক ১৯ হাজার ৭৫০ টাকা সর্বসাকুল্য বেতন হিসেবে দেয়া হয়েছে। এই অনিয়মের জবাবে ইফার পক্ষ থেকে বলা হয়, বোর্ডের সিদ্ধান্তে মহিলা নামাজ কক্ষ ও সামগ্রিক মহিলা পরিচালনা ও মনিটরিং করার জন্য কো-অর্ডিনেটর নিয়োগ করা হয়। ইফার আইন অনুযায়ী আইন উপদেষ্টা নিয়োগ পাওয়ার পর এ আর মাছউদ সংস্থার সব মামলা পরিচালনা এবং ব্যক্তিনথির বিভিন্ন আইনগত বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করায় অনেক সমাধান হয়েছে। নিরীক্ষায় অর্গানোগ্রাম বহির্ভূত পদে লোক নিয়োগের কোনো সুযোগ নেই জানিয়ে প্রদত্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে ফেরত দিতে বলা হয়েছে।
পরীক্ষায় অকৃতকার্যকে জাল সনদে প্রথম শ্রেণীর পদে নিয়োগ : ২০১৫ সালে সহকারী সম্পাদক পদে মো: ফখরুল আলম নিয়োগ পান। এই পদের জন্য যোগ্যতা হিসেবে তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চার বছর মেয়াদি অনার্স, ঢাকা কলেজের ইংরেজি বিভাগ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হওয়ার সনদের সত্যায়িত কপি সংযুক্ত করেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে তার নাম অকৃতকার্য হিসেবে প্রদর্শিত হচ্ছে। জবাবে ইফার পক্ষ থেকে বলা হয়, তার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ করে জানা যায়, তার চতুর্থ বর্ষের ফলাফল অকৃতকার্য হিসেবে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে ফলাফল পুণঃনিরীক্ষণ করার পর দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়। তিনি ওয়েবসাইটে ফলাফল সংশোধনের জন্য দরখাস্ত করেছেন। নিরীক্ষায় জবাবে সন্তুুষ্ট না হয়ে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে।
দুই বার কার্য বিবরণী তৈরি করে নিয়োগ : ২০১৬ সালে ইফার ১১টি পদের নিয়োগে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ছিল ৩.৩০টি। প্রকাশনা ক্ষেত্রে তিন বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিভাগীয় ও মুক্তিযোদ্ধা কোটায় যোগ্য প্রার্থী নাসির উদ্দিন শেখ নিয়োগ পরীক্ষায় পাস করেন। কিন্তু তাকে নিয়োগ না দিয়ে রেযোয়ানুল আলমকে নিয়োগ দিতে দুইবার কার্যবিবরণী তৈরি করা হয়। প্রথমবার তার প্রাপ্ত নম্বর ৬২.৫০ এবং দ্বিতীয় কার্যবিবরণীতে ৬৫.৫০ দেখানো হয়। তখনকার বাছাই কমিটির সদস্য সচিব ড. মো: আলফাজ হোসেন (যুগ্ম সচিব) কার্যবিবরণী দু’টিতে স্বাক্ষর না করায় তাকে ছুটি দেখিয়ে তার জায়গায় ইফার পরিচালক মোহাম্মদ তাহের হোসেনকে সদস্য সচিব করে কার্যবিবরণীতে স্বাক্ষর নেয়া হয়। নিরীক্ষায় দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংরক্ষণ করার সুপারিশ করা হয়।