আবদুল মাকসুদ আবদুল গনী তার ফিল ফালসাফাতিল ইসলামিয়া গ্রন্থে লিখেন, ‘ইলমে কালাম’কে কেন্দ্র করে বড় বড় দার্শনিক মতবাদ জন্ম নিয়েছে। এর বিকাশের সময় মুসলমানরা বিশ্বজগতের ব্যাখ্যা এবং প্রাকৃতিক নিয়ম উদ্ভাবনে উজ্জ্বল ভূমিকা রাখেন। তারা নিরূপণ করেন অস্তিত্বের রহস্য, জীবন ও কার্যকারণ ইত্যাদির তাৎপর্য। এ ক্ষেত্রে তারা ইউরোপের আধুনিক চিন্তাবিদ ও দার্শনিকদের পথিকৃৎ হয়ে আছেন।’
ঠিকই বলেছেন আবদুল মকসুদ। মুসলিম প্রভাব নানামাত্রিক চ্যানেল তৈরি করে। প্রধান এক চ্যানেল ছিল ইহুদিদের মধ্যে। যার সূচনা ঘটে সাদিহা বেন ইউসুফের (৮৯২-৯৪২) হাত দিয়ে। তিনি প্রবর্তন করেন ইহুদি ইলমে কালাম, যা জিউইস কালাম নামে পরিচিত। হায় বেন সেরিরা (৯৩৯-১০৩৮), ডেভিড (আবু সুলায়মান বেন মেরওয়ান আল মুকাম্মাস (মৃত্যু-৯৩৮), স্যামুয়েল বেন হোফনি (মৃত্যু-১০৩৪) এর বিকাশ ত্বরান্বিত করেন। এ শাস্ত্রের অগ্রদূত ছিলেন ইহুদি দর্শনের মহাপুরুষ কর্ডোভার মনীষী ইবনে মায়মুন। তিনি মোশেহ মায়মুন বা মায়মুনাইডিস বলেও বিখ্যাত। কয়েক শতাব্দীর মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত ইহুদি চিকিৎসক ও দার্শনিক। ১১৩৫ সালে তিনি কর্ডোভায় জন্মগ্রহণ করেন; তার পরিবার ১১৬৫ সালে কায়রোতে চলে যায়। তিনি রীতিমতো একজন মুতাকাল্লিম বলে পরিচিত ছিলেন; ইহুদি মুতাকাল্লিম। পি কে হিট্টি (১৮৮৬-১৯৭৮) লিখেছেন, স্পেনে ইবনে মায়মুন প্রকাশ্যে নিজকে মুসলমান বলে পরিচয় দিতেন; যদিও নিজ গৃহে ইহুদি ধর্ম পালন করতেন। কায়রোতে তিনি সালাহউদ্দীন ইউসুফ বিন আইয়ুব (১১৩৭-১১৩৮-১১৯৩ সাল) ও তার ছেলের সরকারি চিকিৎসক নিযুক্ত হন। হিট্টি লিখেন, ১৯৭৭ সাল থেকে তিনি কায়রোর ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মযাজক ছিলেন। এখানে ১২০৪ সালে তার মৃত্যু হয়। তার ওসিয়ত মোতাবেক যে পথে একদা হজরত মূসা চলেছিলেন, সেই পথে তার লাশ হাতে বহন করে টাইবেরিয়াসে সমাহিত করা হয়। আজো সেখানে তার অনাড়ম্বর সমাধির পাশে হাজার হাজার তীর্থযাত্রী সমবেত হয়ে থাকে। কায়রোতে রাব্বি মোশে-বেন-মায়মুনের যে গির্জা (সিনাগগ) আছে, আর সংলগ্ন ভূগর্ভস্থ প্রকোষ্ঠে দূর-দূরান্ত থেকে দরিদ্র ইহুদি বিমারিরা এসে ভিড় করে এবং সেখানে রাত যাপন করে রোগমুক্তির জন্য প্রার্থনা করে। ইহুদি সমাজে যে তিনি কত বড় শ্রদ্ধার আসন অধিকার করে আসছেন, তা সে সমাজে প্রচলিত এই প্রবাদবাক্যটিতেই বোঝা যায়- মূসা থেকে মূসা পর্যন্ত মূসার মতো কেউ ছিল না?
ইবনে মায়মুন গ্রহ-বিজ্ঞানী, ধর্ম-বিজ্ঞানী, চিকিৎসক এবং সর্বোপরি দার্শনিক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ত্বকছেদন পদ্ধতির উন্নতি বিধান করেন, কোষ্ঠকাঠিন্যকে হেমোরাইডস ব্যারামের কারণ বলে রায় দেন এবং স্বাস্থ্যবিজ্ঞান সম্বন্ধে উন্নত ধারণা পোষণ করতেন। তার প্রধান দার্শনিক গ্রন্থের নাম ‘দালালাতুল হা-য়িরিন’ (বিভ্রান্তদের পথপ্রদর্শক)। এ পুস্তকে তিনি ইহুদি ধর্মশাস্ত্রের সাথে মুসলিম আরাস্তুবাদ অথবা ব্যাপক অর্থে বিশ্বাসের সাথে যুক্তির সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা করেন। এদিক থেকে অন্তত তিনি বাইবেলের স্বতঃসিদ্ধবাদের বিরুদ্ধে বৈজ্ঞানিক চিন্তার সাহসী সমর্থক ছিলেন। ফলে তিনি গোঁড়া শাস্ত্রবিদদের রোষ-ভাজন হন। এরা তার বইয়ের নাম দেয়, ‘দালালাহ’ (গোমরাহকরণ)। স্বাধীনভাবে গবেষণা করলেও তার দার্শনিক মতবাদের সাথে ইবনে রুশদের মতবাদের সাদৃশ্য দেখা যায়। ইবনে রুশদের মতো তিনিও গ্রিক ভাষায় অজ্ঞ ছিলেন এবং সম্পূর্ণভাবে আরবি অনুবাদের ওপর নির্ভর করতেন। সৃষ্টি সম্বন্ধে তিনি অনু-মতবাদ (আল্লাহ সমস্ত কিছুর সৃষ্টিকর্তা) আর নিও প্ল্যাটোনিক ও আরাস্তুর দার্শনিক মতবাদ। একটি ছাড়া ইবনে মায়মুনের সব বই আরবি ভাষায় লিখিত হয় এবং শিগগিরই সেসব বই হিব্রুতে ও পরে আংশিকভাবে ল্যাটিনে অনূদিত হয়। তার মতবাদের ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত তার গ্রন্থাবলিই ইন্দি চিন্তাকে জেন্টাইলদের কাছে পর্যন্ত পৌঁছানোর প্রধান মাধ্যম ছিল। আধুনিক সমালোচকরা তার প্রভাবের পরিচয় বহুজনের মধ্যে দেখতে পান, যেমন- ডমিনিকান, ডান স্কোটাস, স্পিনোজা, এমন কি ক্যান্ট।
ময়মনডিনাসকে কেন্দ্র করে যে মুতাকাল্লিম গোষ্ঠী তৈরি হয়, ইহুদি দর্শনকে তারা ষোড়শ শতক অবধি পৌঁছে দেন। জুইস কালাম চর্চায় নিবেদিত দার্শনিকদের মধ্যে ছিলেন স্যামুয়েল বিন আলী (মৃত্যু-১১৯৪), এভরেহাম মাইমুনি (১১৮৬-১২৩৭), ইউসুফ বেন ইয়াহুদা (১১৬০-১২২৬), জেকব বেন আব্বামারি বেন সিমসন (১১৯৪-১২৫৬), জুদা বেন সউল বেন তিব্বন (১১২০-১১৯০ পরবর্তী), স্যামুয়েল বিন জুদা বেন তিব্বন (১১৫০-১২৩০), মোসেজ বিন তিব্বন (মৃত্যু-১২৮৩), জেকব বেন মাচির বিন তিব্বন (মৃত্যু-১৩০৪), হিল্লেল বিন স্যামুয়েল (১২২০-১২৯৫) ও সামতুব বেন জুসেফ (১২২৫-১২৯০)।
পরবর্তী শতকের দার্শনিকতাও এই পথরেখায় এগিয়েছে। এ সময়ের জিউস দর্শনকর্ম কালামচর্চায় বিশেষ প্রসারণ নিয়ে আসে। আরবি গ্রন্থের অনুবাদ তখন প্রবল গতিতে চলমান। অনুবাদের পাশাপাশি বিচার-বিশ্লেষণে বিশেষভাবে মনোযোগী জিউস কালাম। এরিস্টটল, প্লেটো, গ্যালন, কিন্দি, ফারাবি, ইবনে সিনা, ইমাম গাজ্জালি, ইবনে তুফায়েল প্রমুখের চর্চা চলছে ইবনে মায়মুনের আচ্ছন্নকারী বিশ্লেষণের ধারায়। কিন্তু সব কিছুর উপর ছিল এবেরুসিজম বা ইবনে রুশদবাদ। ইবনে রুশদকে মুসলিমদের চেয়ে ইহুদিরা তখন চর্চা করছেন বেশি। তারাই তাকে নিয়ে যান ইউরোপের গভীরে। মুসলিমদের মধ্যে ইলমে কালাম যখন স্থবির হয়ে আসছে, তখন ইহুদি ইলমে কালামের ভরা যৌবন।
তখনকার অগ্রবর্তীদের মধ্যে দেখা যাবে জুদিয়া বেন আবরাহাম বেদেরসি, (১২৭০-১৩৪০), জুসেফ বিন আব্বামেইর (১২৮০-১৩৪৫), লেভি বিন গেরসন (১২৮৮-১৩৪৪), নিসিম বিন রেউবেন (১৩২০-১৩৭৬), ইসাকা বেন শেসেন্ট পেরফেট (১৩২৬-১৪০৮), হাসদিয়া বেন আবরাহাম (১৩৪০-১৪১০/১১), প্রফিয়াট ডুরান্ট (১৩৫০-১৪১৫), সাইমন বেন যেমাহ ডুরান (১৩৬১-১৪৪৪), এলিয়া ডেল মেডিগো (১৪৫৮-১৪৯৩), ইসাকা বেন মোসেজ আরামা (১৪২০-১৪৪৯), জুসেফ আলবো (১৩৮০-১৪৪৪), হরটার বেন সলোমন (১৪০০-১৪৮০), জুদা বেন জেহেইল (১৪২০-১৪২৫-১৪৯৮), ইসাকা বেন জুদা আবারবানেল (১৪৩৭-১৫০৮), ডেভিড বেন জুদা মেসের লিওন (১৪৭০-১৫২৬), লিউ দ্য হেবরিউ (১৪৬০-১৫৩০), আবরাহাম বেন জুদা হা লেভি মিঞ্জ (১৪৪০-১৫৩০), ওভাদিয়া বেন জেকব সফোমো (মৃত্যু-১৫৫০), মেরি বেন ইসাকা (১৪৮২-১৫৬৫), আযারিয়া বেন মোসেজ (১৫১১-১৫৭৮), মোসেজ বেন বারুচ আলমোসনিনো (১৫১৫-১৫৮০), এলিজা বাল শেম (১৫৫০-১৫৮৩), এলিজের বেন এলিজা আসকেনাজি (১৫১২-১৬৮৫), জুদা মাসকাটো (১৫৩০-১৫৯৩), ইবনে খালদুন ও মায়মুন বিন মুসার কালাম দর্শন রাজত্ব করছিল, যে অবধি স্পিনোজা না এলেন। তিনিও মায়মুন দ্বারা ছিলেন বিপুলভাবে প্রভাবিত। রেনেসাঁ অবধি শক্তিশালী অন্যান্য ইহুদি দার্শনিকের ক্ষেত্রেও এটি সত্য। ফ্রান্সিসকো সানচেজ (১৫৫০-১৫২৩) মোসেজ বেন জেহিইল হাকোহেন (মৃত্যু-১৬২৪), উরিয়েল ডে কস্তা (১৫৮৫-১৬৪০), মিগুয়েল বারিউসের (১৬২৫-১৭০১) প্রত্যেকেই প্রধানত ইবনে মায়মুন এবং ইবনে রুশদের পদাঙ্ক অবলম্বন করে এগিয়ে গেছেন।
ওলন্দাজ দার্শনিক বারুখ স্পিনোজার জন্ম হলো ১৬৩২ সালে। তার হাত ধরে শুধু ইহুদি দর্শন নয়, দর্শনের ইতিহাসই বলতে গেলে নতুন যুগে প্রবেশ করল। স্পিনোজা গবেষকদের সবাই একমত, ইবনে মায়মুনের গভীর ছাপ ছিল তার চিন্তায়। কিন্তু তারপরও তিনি আধুনিক যুগের শুরুর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সবচেয়ে মৌলিক দার্শনিক। দার্শনিক হিসেবে তিনি মুক্ত ও স্বাধীন চিন্তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। যার প্রস্তাবনা ইউরোপে প্রসারিত হয়েছিল প্রধানত ইবনে রুশদের হাত ধরে! এ জন্য এবেরুশ বা ইবনে রুশদপন্থীদের করতে হয়েছিল বহু আন্দোলন। অনেককেই হতে হয়েছিল অগ্নিদগ্ধ। তাদের বিরুদ্ধে বহুবার অভিযান চালিয়েছে গির্জা। ইবনে রুশদের ব্যাখ্যাগুলোকে নিষিদ্ধ করেছে বারবার। কিন্তু এর মধ্যে চিন্তার মুক্তির যে শিখা প্রত্যক্ষ করেন পশ্চিমা দৃষ্টিবানরা, সেই শিখাকে প্রজ্বলিত করতে যাজকতন্ত্রের হাতে জীবন বিপন্ন করতে হয়েছিল প্যারিস, নেপলস, অক্সফোর্ডসহ বড় বড় জ্ঞানকেন্দ্রের অসংখ্য ইহুদি-খ্রিষ্টান
চিন্তাবিদকে।
লেখক : কবি, গবেষক