তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট কায়েস সাঈদ গত কয়েক বছরে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘প্লেবুক’ থেকে বেশ কয়েকটি পাতা ধার করেছেন। দায়িত্ব গ্রহণ করার পর থেকে এ পর্যন্ত তিনি সাংবিধানিক ব্যবস্থাকে আঘাত করেছেন, যে ব্যবস্থা তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। তিনি পার্লামেন্ট এবং এর সদস্যদেরকে অপমান করেছেন এবং সংসদীয় পদ্ধতিকে হেয় করেছেন। অথচ ‘জনগণের’ নামে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বা পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত আর এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তি হলো পার্লামেন্ট। তিনি এমনকি, সংবিধানের ওপরও আঘাত হেনেছেন। তিনি প্রেসিডেন্টকে অধিক ক্ষমতা দেয়ার জন্য সংবিধান পরিবর্তন করার দাবি জানিয়েছেন এবং একটি সাংবিধানিক আদালত গঠন বন্ধ করে দিয়েছেন।
কায়েস সাঈদ পার্লামেন্ট ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অপমানিত ও আহত করার জন্য ট্রাম্পের ‘প্রিয় স্বৈরশাসক’ প্রেসিডেন্ট আল সিসির সাথে সাক্ষাৎ করতে চাওয়ার পর গত এপ্রিলে মিসরের একনায়কতন্ত্রের প্রশংসা করেছেন।
সংক্ষেপে বলা যায়, তিউনিসিয়ায় চলতি সপ্তাহে যা ঘটেছে সেটি মোটেই বিস্মিত হওয়ার মতো কিছু নয়। প্রকৃত পক্ষে দীর্ঘ দিন ধরে এটা ঘটার অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু তিউনিসিয়ার মহাদুর্যোগ সৃষ্টি হওয়ার পেছনে রয়েছেন পরাবাস্তববাদী সাঈদ। তিনি ট্রাম্পের মতো কোনো ছায়া ব্যবসায়ী নন। তিনি আইনের একজন অধ্যাপক। কার বেশি জানা উচিত, সেটি তিনি ভালো জানেন, বোঝেন।
দেশের নিরাপত্তাবাহিনীর ওপর সম্পূর্ণ আধিপত্য দাবি করার জন্য তিনি সংবিধানের ৭৭ ধারার উদ্ধৃতি দিয়েছেন এবং তার অভ্যুত্থানকে যৌক্তিক প্রমাণ করার জন্য ৮০ ধারার দোহাই দিয়েছেন। কিন্তু সংবিধানের উভয় ধারার যে ব্যাখ্যা তিনি দিচ্ছেন তা যে অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং সম্পূর্ণ ভুল তা দেখার জন্য সাংবিধানিক আইনজীবীর কোনো ব্যাখ্যার তিনি তোয়াক্কা করেননি।
তার ঘোষণা করা ‘জরুরি’ পদক্ষেপ নিয়ে সরকার প্রধান এবং পার্লামেন্টের সাথে সমন্বয় সাধন করার পরিবর্তে সাঈদ নতুন ব্যবস্থাকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছেন এবং এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশের ক্ষমতার সাংবিধানিক বিভাজনকে ‘জনগণের’ নাম ভাঙিয়ে হেয় প্রতিপন্ন করেছেন। তবে পুনরায় বলছি, জনতুষ্টিবাদ কোনো একটি নির্দিষ্ট পেশা, জাতীয়তা বা ধর্মে সীমাবদ্ধ নয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমরা দেখছি, বিশ্বব্যাপী পুরনো গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে হেয় করে জনতুষ্টিবাদী নেতারা বিদ্যমান সরকাররের প্রতি জনগণের হতাশা ও অসন্তোষকে পুঁজি করে তাদের হাতে অধিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার জন্য ক্ষমতার সাংবিধানিক বিভাজনকে হেয় করছেন। হায়! তিউনিসিয়ায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এক দশক আগে শান্তিপূর্ণ সফল বিপ্লবের পর থেকে এ পর্যন্ত তিউনিসিয়ার জনগণ গভীর অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং রাজনৈতিক অচলাবস্থার কারণে ক্রমবর্ধমানভাবে হতাশাগ্রস্ত। এক কোটি ১০ লাখ মানুষের তুলনামূলকভাবে ছোট্ট এই দেশটিতে মহামারীতে এ পর্যন্ত ১৭ হাজারের বেশি মৃত্যুর ঘটনায় সাম্প্রতিক দিনগুলোতে হতাশাগ্রস্ত মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। কিন্তু পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে প্রেসিডেন্টসহ তিউনিসিয়ার রাজনীতিবিদরা তাদের মতপার্থক্য পরিহার করে জনগণের মৌলিক প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিয়ে দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছেন। তিউনিসিয়ার রাজনীতিবিদরা জনগণের স্বার্থকে গুরুত্ব দেয়ার পরিবর্তে ব্যক্তিগত ইগোকে নিয়ে ক্ষমতার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। তাই হ্যাঁ, তিউনিসিয়ানদের বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠার অধিকার আছে।
কিন্তু আমার জীবনে আমি দশকের পর দশক ধরে স্বৈরশাসকের নির্যাতন নিপীড়নের পর দেশের মানুষ কিভাবে এক ব্যক্তির শাসনে ফিরে যাচ্ছে তা আর দেখিনি। কোনো স্বৈরশাসক দেশের সমস্যার সমাধান অথবা জনগণের স্বার্থের জন্য দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করে যেতে পারবেন? এটা হওয়ার নয়। আমি অন্ধকার সময়ে তাদেরকে দেশের ‘উদ্ধারকারী’ হিসেবে এগিয়ে আসতে দেখিনি। এ ক্ষেত্রে তাদের কোনো আকর্ষণ লক্ষ করিনি। তবে ইতোমধ্যে সে ধরনের চেষ্টা করা হয়েছে এবং তা ব্যর্থ হয়েছে। এটা একটা উদ্ভট স্বপ্ন।
জনতুষ্টিবাদী নেতারা নিন্দা, মূলোৎপাটন এবং ধ্বংস সাধনের জন্য ভালো; এমনকি এসব ক্ষেত্রে তারা চমৎকার ভূমিকা রাখতে পারেন। কিন্তু তারা সহযোগিতা, সমন্বয় এবং কোনো কিছু সৃষ্টি বা তৈরি করার ব্যাপারে প্রায়ই অদক্ষ ও অযোগ্য বলে প্রমাণিত হয়ে আসছেন।
কায়েস সাঈদও সেই পথেই গেছেন। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এই পর্যন্ত অভিযোগ করাটা বন্ধ করেননি, অথচ তিউনিসিয়ায় যেসব সঙ্কট চলছে তার একটিরও সমাধান করার জন্য কোনো একটি প্রস্তাবও তিনি দেননি। তিউনিসিয়ার ব্যাপারে তার সমাধানও ট্রাম্পের মতো। তিনি তিউনিসিয়ার বিপ্লবের স্লোগানের মতো বললেন, ‘জনগণ সরকারের পতন চায়’। বেন আলির একনায়কতন্ত্রের মতোই একই দাবি করে ‘প্রেসিডেন্ট সরকারের পতন চেয়েছেন।’ অথচ এই গণতান্ত্রিক সরকার তাকে ক্ষমতাসীন করেছে। এসব কর্মকাণ্ড আমাদেরকে জনতুষ্টিবাদ এবং গণতন্ত্রের মধ্যকার উত্তেজনায় ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। আরো সুস্পষ্টভাবে বললে বলতে হয়, জনতুষ্টিবাদ এবং উদার গণতন্ত্র। সেখানে সাবেক সুযোগসন্ধানীরা গণ-অসন্তোষ পুঁজি করে সংবিধান, গণমাধ্যম এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে হেয় করেছে। সেভাবে এবং ট্রাম্পের মতো অন্যান্য জনতুষ্টিবাদী নেতাদের মতোই প্রেসিডেন্ট সাঈদ তার ক্ষমতার বিরুদ্ধে যেকোনো প্রতিবন্ধকতা নির্মূল করতে দৃঢ়সঙ্কল্পবদ্ধ বলেই মনে হচ্ছে যদিও তিনি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন কি না তা এখনো বলা যাচ্ছে না। তবে তার অসাংবিধানিক পদক্ষেপ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করতে তিউনিসিয়ানদের খুব দেরি করা উচিত হবে না। তিউনিসিয়ার গণতন্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের মতো পুরনো ও স্থিতিশীল নয়। তবে তিউনিসিয়ার জনগণ ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাতে যে সক্ষম তা তারা আগেই প্রমাণ করেছেন। তারা শান্তিপূর্ণভাবে পুনরায় তা করতে পারেন।
লেখক : আলজাজিরার সিনিয়র রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার