রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৩১ অপরাহ্ন

কাবুলের পতন, এরপর কী

অজয় দাশগুপ্ত
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ১৯ আগস্ট, ২০২১
  • ১৪৬ বার

ইতিহাস বলছে প্রায় একশ বছর আগে আফগানিস্তানের রানি সুরাইয়া ছিলেন প্রথম আধুনিক মুসলিম নারীর প্রতীক। যিনি সিরিয়ায় পড়াশোনা করেছিলেন। আমীর হাবিবুল্লাহ খানের ছেলের সঙ্গে ভালোবাসা হয়েছিল তার। তখন তিনি কিশোরী। কিশোরী বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়া সুরাইয়ার মাথায় মুকুট ওঠে ১৯১৯ সালে। যখন তার পতি আফগান রাজার সিংহাসনে বসেন। মনে করা হয় তিনিই প্রথম মুসলিম নারী, যিনি তার স্বামীর সঙ্গে প্রকাশ্যে বেরোনোর সাহস দেখিয়েছিলেন। ১৯২৭ ও ১৯২৮ সালে ইউরোপ ভ্রমণের সময় তাকে দেখার জন্য রাস্তায় মানুষের ঢল নামত। টাইম ম্যাগাজিনের প্রভাবশালী নারীদের নামের তালিকায় ঠাঁই পেয়েছিলেন সুরাইয়া।

আফগানিস্তানে আমেরিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ‘মরিয়া’ চেষ্টাও এই সরকার বিরোধিতার পেছনে কাজ করে থাকতে পারে। আফগানিস্তানের একটিও সরকার সঠিকভাবে নির্বাচিত নয়। ঘানি সরকারও নয়। আমেরিকা বাইরে থেকে শক্তি প্রয়োগ করে ঘানিকে প্রেসিডেন্টের আসনে বসিয়েছিল। এ নিয়ে আমেরিকার প্রতি বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়েছিল আফগানবাসীর। প্রশাসনের শীর্ষস্তরের মানুষরা তালেবানকে চাইতেন না ঠিকই। কিন্তু পাশাপাশি আমেরিকাকেও পছন্দ করতেন না। তার কারণ, আফগানিস্তানজুড়ে আমেরিকার ক্রমাগত অত্যাচার। রেড ক্রসের হাসপাতালও ধ্বংস হয়েছে আমেরিকার হামলায়। অনেক সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে আমেরিকার যুদ্ধংদেহি মনোভাবের কারণে। যে ঘটনাগুলো কখনই সামনে আসেনি। এমনকি আফগানিস্তানে ক্ষমতায় বসে থাকা সরকারও এই সমস্যাগুলোকে কখনো সমাধানের চেষ্টা করেনি। করবেই বা কী করে! কারণ ওদের হাত-পা বাঁধা। আমেরিকার টাকায় ওরা ক্ষমতায় বসে আছে। সেই ক্ষমতায় থেকে আমেরিকার বিরুদ্ধে যাওয়া তো সম্ভব নয়। হামিদ কারজাই তার শাসনকালের শেষের দিকে বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। উল্টো তাকেই সরে যেতে হয়েছে।

আমেরিকার হাতে তৈরি পরিস্থিতিই ধীরে ধীরে তালেবানের দিকে হাওয়া ঘুরিয়ে দেয়। খুব ধীরে হলেও তা ক্রমে আমেরিকার বিরুদ্ধে গোটা আফগানিস্তানকে তাতিয়ে তোলে। তালেবানের মধ্যে একটা ‘বিপ্লবী’সুলভ ভাবভঙ্গি আছে, আমেরিকার অত্যাচারে অতিষ্ঠ মানুষ সেটা আরও বেশি করে মেনে নিতে শুরু করে। কিন্তু মেনে নিলেই তো হলো না। এত বড় একটা যুদ্ধ চালাতে গেলে তো রসদ দরকার। অস্ত্র আর রসদ না থাকলে এই লড়াই সম্ভব নয়।

এখন শুরু হয়েছে কঠিন সময়। এই দুঃসময়ে কে কার পাশে দাঁড়াবে? সে সময় নেই কারও। কথা হচ্ছে কী হবে সেসব মানুষের যারা দুনিয়ার সঙ্গে চলার জন্য ঝুঁকি নিয়েছিলেন? সে দেশের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন একজন নারী। তিনি টিভিতে বলছেন জগতের ভালো করা নিজেদের মানিয়ে নিতে গিয়ে আজ তাকে চরম মূল্য দিতে হতে পারে? কি এই চরম মূল্য?

তার জবাব তালেবানদের নতুন কাজেই স্পষ্ট। তারা ইতোমধ্যে পনেরো বছরের ওপর তরুণীদের তালিকা করার আদেশ দিয়েছে। এসব তরুণী হবেন তাজা ও নরম। শুরু হয়ে গেছে দেয়াল থেকে নারী ছবি থাকা যে কোনো পোস্টার বা বিলবোর্ড মোছার কাজ। ধীরে ধীরে দেশের রাজনীতি কেমন হবে তা জানা যাবে।

এই দেশটির ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলায় অনেক শক্তিশালী দেশের হাত ছিল। আশির দশকে নূর মোহাম্মদ তারাকী ও বারবাক কারমাল ছিলেন আধুনিক কাবুলিওয়ালা। তাদের নিয়ন্ত্রণে সে দেশে সমাজতন্ত্র জাতীয় কিছু একটা হয়েই গিয়েছিল। তখন আমেরিকার তা সহ্য হয়নি। তারা এই তালেবান বানিয়ে তাদের হটায় এবং দিবালোকে তাদের ফাঁসিতে ঝোলায়। ইতিহাসের সে পাপ এখন সাপ হয়ে ফণা তুলছে।

আমেরিকার আন্তর্জাতিক ইতিহাস এমনই। তারা কম্বোডিয়া ভিয়েতনাম ইরান এমনকি বাংলাদেশের বেলায়ও নিজ মিত্রকে ফেলে পালাতে বা সরে আসতে বিলম্ব করেনি। পাকিস্তান যখন বঙ্গোপসাগরে আমেরিকার সপ্তম নৌবহরের আগমন ও তাদের জয় নিয়ে উত্তেজিত তখন তারা নীরবে জায়গা ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। হাস্যকর হলেও সত্য, তখন বলেছিল তারা নাকি মাছ ধরতে এসেছিল এতদূরে।

আজ কাবুলের পতন ও সেখানকার পরিস্থিতি দেখে যারা উল্লসিত কিংবা জোশে ভুগছেন তাদের বলি ঘর সামলান। যে দুটো রক্ষাকবচ বাংলা ও বাঙালিকে বাঁচিয়ে রেখেছে তার একটি সংস্কতি, অন্যটি নারীশক্তি। এখন এ দুটোর প্রথমটা নির্জীব, পরেরটি নানা আক্রমণে দুর্বল। বাংলাদেশে নারীদের ওপর আক্রোশ নতুন কিছু নয়। তার পরও সব ষড়যন্ত্র ও দুশমনির মুখে ছাই দিয়ে দেশ এগিয়ে চলেছে নারী নেতৃত্বে। এ জায়গাটা সুরক্ষিত রাখতে না পারলে সময় ছেড়ে কথা বলবে না।

হয়তো জেনেছেন চীন একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ হওয়ার পরও বলেছে তারা তালেবানদের সঙ্গে বন্ধুতা রেখে চলবে। বিস্ময়ের কিছু নেই। এর নাম রাজনীতি। পাকিস্তান-চীন মৈত্রী বলয় তালেবানদের পক্ষ নেবে। উল্টোদিকে ভারত, আমেরিকাসহ ইউরোপ। চীন চাইবে না তালেবান হটুক। কারণ এখানে ধর্ম মৌলবাদ বিষয় নয়। বিষয় স্বার্থ।

দেশে সমাজে যেসব তালেবান ছুপা বা লুকিয়ে তাদের কথা সরকারি মহলও স্বীকার করেন। এরা আছে। এদের সবাই চেনে। এদের চিহ্নিত করা ও আলাদা করা না হলে আমরা নিরাপদ থাকব না।

একদা আব্দুর রহমান নামে সরল ভোলাভালা এক কাবুলির দেশ এখন আতঙ্ক ও ভয়ের ভেতর ঢুকেছে। এই ভয়ভীতি সব দেশের সব নারীর মনে। তাই মা-বোনদের জন্যই এর থেকে মুক্ত থাকতে হবে।

আধুনিকতা, সুফিবাদ, মরমিবাদ, নারীর সম্মান ও শিক্ষার জন্য সতর্ক থাকা আমাদের দায়িত্ব। এর সঙ্গে জোশ-উন্মাদনার কোনো সম্পর্ক না থাকাই হবে মঙ্গলের। যদিও সরকারি দল, বিরোধী দল জনগণের ভেতর তার উল্টো ধারাই দেখতে পাই আমরা।

 

অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক, সিডনি

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com