ভ্যাকসিন কারা কারা নিতে পারবেন- এ নিয়ে আমাদের মধ্যে যেমন প্রশ্ন আছে, তেমনি ভ্যাকসিন নিয়ে কিছু ভ্রান্ত ধারণাও আছে। সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে একটা পোস্ট ঘুরে বেড়াচ্ছে। তা বলছে- করোনা মূলত ভাইরাস নয়, ব্যাকটেরিয়া। একটা সংবাদপত্র এটা নিয়ে নিউজ তৈরি করেছে। এই সংবাদটা সম্পূর্ণ অসত্য ও গুজব। অনেকের মনে জিজ্ঞাসা- ভ্যাকসিন নেওয়ার পর করোনা হয়েছে, তা হলে নেব কেন? গবেষণায় দেখা গেছে, সব ভ্যাকসিনই আমাদের মৃত্যুঝুঁকি কমায়। আমাদের আশপাশে যারা দুটো ভ্যাকসিন নিয়েছেন, তাদের মধ্যে মৃত্যুহার অনেক কম। ল্যান্সেটে প্রকাশিত ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের একটা গবেষণা নিয়ে অনেক রিপোর্ট হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ফাইজার ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার দুই ডোজ কোভিড টিকা নেওয়ার পর ৫-৬ সপ্তাহের মাথায় কার্যকারিতা সবচেয়ে বেশি। এর পর থেকে কার্যকারিতা কমে যাচ্ছে আর ৫-৬ মাসের মাথায় কার্যকারিতা ব্যাপক হারে কমে যাচ্ছে। ১০ সপ্তাহ পর তা ৫০ শতাংশেরও বেশি কমে যেতে পারে। বেশিরভাগ তথ্য ফাইজারের ভ্যাকসিন নিয়ে। কারণ এ ভ্যাকসিনের প্রয়োগ সবার আগে শুরু হয়েছে। আবার অন্য গবেষণায় দেখা গেছে, এর সঙ্গে শরীরে ভ্যাকসিনের বিরুদ্ধে তৈরি অ্যান্টিবডিরও একটা সম্পর্ক রয়েছে। যাদের শরীরে সর্বোচ্চ অ্যান্টিবডির পরিমাণ অনেক বেশি, তারা ভ্যাকসিন থেকে বেশি সময় ধরে সুরক্ষা পাচ্ছেন। দেহে তৈরি হওয়া সামগ্রিক অ্যান্টিবডির মাত্রা কমতে শুরু করে ছয় সপ্তাহ পরই। এটা পড়ে অনেকেই দুশ্চিন্তায় আছেন, তা হলে কি টিকা এত দ্রুত অকার্যকর হয়ে যাবে? এটা নিয়েও দুশ্চিন্তা করবেন না। অ্যান্টিবডি কমে যাওয়া অপ্রত্যাশিত নয়। অ্যান্টিবডি কমে গেলেই টিকা অকার্যকর হয়ে যায় না। এটা জানা প্রয়োজন- ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা বলতে এসব ক্ষেত্রে সংক্রমণের বিরুদ্ধে কার্যকারিতা বলা হচ্ছে, রোগের বিরুদ্ধে নয়। অর্থাৎ প্রায় প্রতিটি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে- গুরুতর রোগ, হস্পিটালাইজেশন বা মৃত্যুর বিপরীতে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা এখনো শতকরা ৯০ ভাগ বা এর বেশি। টি-সেল, বি-সেলসহ রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার অন্যান্য অংশে কী হচ্ছে, সেটি জানাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এই গবেষণায় আংশিক তথ্য পেয়েছি আমরা। তার পরও সংক্রমণ ঠেকানোর প্রয়োজনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইতোমধ্যে বুস্টার ডোজ দেওয়া বা এ নিয়ে পরিকল্পনা চলছে। হাল ছাড়া যাবে না, ভ্যাকসিনের ওপর বিশ্বাস হারানো যাবে না।
অনেকে বলছেন, করোনার টিকা মানুষের ডিএনএ বদল ও মাইক্রোচিপ ঢোকানোর ষড়যন্ত্র। এটি কি আমাদের জিন পরিবর্তন করে ফেলবে? এর কোনো আশঙ্কা নেই। এমআরএন বা অন্যান্য ভ্যাকসিন আমাদের শরীরের নিজস্ব সুনির্দিষ্ট অ্যান্টিবডি তৈরি ও টি-সেলের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। কেউ বলেন হালাল কিনা? এর আগের অন্য রোগের জন্য ব্যবহৃত কিছু ভ্যাকসিনে স্ট্যাবিলাইজার হিসেবে শূকরের শরীরের কিছু অংশ দেওয়া হলেও বাংলাদেশে যে চারটি ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে, এগুলোর মধ্যে এসব নেই। তাই সম্পূর্ণভাবে হালাল। কেউ প্রশ্ন করেন ভ্যাকসিন বন্ধ্যত্বের কারণ হতে পারে কিনা? এমন কোনো তথ্যের বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। ভ্যাকসিন নারী বা পুরুষের প্রজননক্ষমতা কমায় না।
অনেকে আরেকটি প্রশ্ন করেন, করোনা টিকার দ্বিতীয় ডোজ কি একই ধরনের হতে হবে? মিশ্র ভ্যাকসিন নেওয়া যাবে কিনা? এ ব্যাপারে কয়েকটি স্বল্পপরিসরে গবেষণা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, প্রথম ডোজ অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার পর দ্বিতীয় ডোজ মর্ডানা ভ্যাকসিন নেওয়ার ফলে কার্যকরী ও যথেষ্ট অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। তবে বেশকিছু পার্শ¦পতিক্রিয়া দেখা গেছে। শুধু এক ডোজ ভ্যাকসিন আমাদের কিছুটা সুরক্ষা দিতে পারে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা কমতে থাকে। তাই দ্বিতীয় ডোজ টিকা নেওয়া জরুরি। ভালো খবর হলো, বাংলাদেশে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দেওয়া আবার শুরু হয়েছে। করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে সবাইকে প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজে একই ধরনের টিকা দেওয়া হচ্ছে। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ নেওয়ার পর দ্বিতীয় ডোজে বাদপড়া ব্যক্তিরা পাবেন এই ভ্যাকসিন। এ সময় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। আর আমরা মনে করি, একই টিকার দ্বিতীয় ডোজ নেওয়া ভালো হবে। দশ মাস পরও এই দ্বিতীয় ডোজ কার্যকর ও যথেষ্ট সুরক্ষা নিশ্চিত হবে। নতুন তথ্যের আলোকে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টকে থামানোর পথ একটাই- বেশি মানুষকে যত দ্রুত সম্ভব ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসা, দুই ডোজ সম্পূর্ণ করা আর পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা।
কোভিড-১৯ মহামারী বিজ্ঞানীদের আগের চেয়ে সচেতন করেছে। তারা ভাইরাস, অণুজীব নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছেন। নতুন কোনো করোনার ধরন আসার আগেই করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে বলে সতর্ক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে দ্রুত ও গণহারে ভ্যাকসিন দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে পৃথিবীর পরিসংখ্যান থেকে সহজেই অনুমেয় বেশি বেশি ভ্যাকসিন নেওয়া দেশগুলোয় রোগের প্রাদুর্ভাব কম এবং কম ভ্যাকসিন নেওয়া দেশগুলোয় রোগ ছড়াচ্ছে বেশি। তাই দ্রুত মানুষকে ভ্যাকসিনেশনের আওতায় আনতে হবে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকার জনগণকে অগ্রাধিকার প্রদান করে ভ্যাকসিনেশন করা উচিত। পল্লী চিকিৎসকদের করোনার প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। তা হলে চিকিৎসা ভালো হবে।
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত (২৫ আগস্ট) ২ কোটি ৪২ লাখ ১৮ হাজার ৭৯৬ জনকে করোনা টিকা দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে করোনার প্রথম ডোজ নিয়েছেন ১ কোটি ৭২ লাখ ৪২ হাজার ৪৭৯ এবং দুই ডোজই নিয়েছেন ৬৯ লাখ ৭৬ হাজার ৩১৭ জন। ভালো খবর হলো, বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর মানুষের ভ্যাকসিন নেওয়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। তবে বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে দুই ডোজ টিকা দিতে এখনো ২২-২৩ কোটির বেশি টিকা দরকার। যদি বুস্টার ডোজ দিতে হয়, তা হলে আরও ১৩ কোটি টিকা লাগবে। নতুন ভ্যারিয়েন্ট এলে আমাদের হয়তো আবারও পরিবর্তিত টিকার কথা ভাবতে হবে। তাই এখনই দেশে টিকার গবেষণা বাড়িয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে মানসম্মত, কার্যকর নিজেদের টিকা তৈরি করতে হবে।
এখন ভ্যাকসিন নিয়ে কিছু প্রশ্ন ও এ সংক্রান্ত ভ্রান্তি দূর করার ব্যাপারে কথা বলা যেতে পারে। প্রশ্ন আছে কারা কারা ভ্যাকসিন নিতে পারবেন? কোন ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কতটুকু? বিশেষ করে গর্ভবতী ও দুগ্ধ প্রদানকারীদের ব্যাপারে এ প্রশ্ন বেশি। গর্ভবতীরা কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন নিতে পারবেন। গর্ভের ১৪-৩৩ সপ্তাহের মধ্যে যে কোনো ধরনের কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন নিতে পারবেন। এতে গর্ভের শিশু অনেকটা সুরক্ষা পেতে পারে। ১৪-৩৩ সপ্তাহের মধ্যে ২ ডোজ ভ্যাকসিন গ্রহণ সম্পন্ন করতে পারলে মায়ের শরীরে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি রক্তের মাধ্যমে গর্ভের শিশুর শরীরে যাবে এবং শিশু করোনা ভাইরাস আক্রমণ থেকে সুরক্ষা পাবে। গবেষণায় দেখা গেছে- এখন পর্যন্ত যেসব দেশে গর্ভবতীরা টিকা পেয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন-পরবর্তী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (যেটা সবারই হতে পারে) ছাড়া অন্য কোনো সমস্যা হয়নি।
অনেকে জানতে চান যেসব মায়ের ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হাঁপানি, কিডনি রোগ আছে- তারা ভ্যাকসিন নিতে পারবেন কিনা। হ্যাঁ, তারাও নিতে পারবেন। তবে ভ্যাকসিন নেওয়ার আগে এসব রোগ থাকলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করে এর পর ভ্যাকসিন নিতে পারবেন। এ জন্য নিয়মিত চিকিৎসা নিতে হবে এবং ভ্যাকসিন নেওয়ার আগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
কারা কারা ভ্যাকসিন নিতে পারবেন না, এখন ওই প্রসঙ্গে কিছু কথা বলা দরকার। জ্বর, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, ক্যানসার আক্রান্ত রোগী- যিনি কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি পাচ্ছেন, ২ সপ্তাহের মধ্যে অন্য কোনো ভ্যাকসিন নিলে, যাদের প্রকট অ্যালার্জির সমস্যা এবং যাদের ভ্যাকসিনের কোনো একটি উপাদানে অ্যালার্জি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে (আগে যদি এমন হয়ে থাকে), তাদের ভ্যাকসিন নেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা বিশেষ প্রয়োজন। তাদের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনোভাবেই ভ্যাকসিন নেওয়া যাবে না।
ভ্যাকসিন নেওয়ার পর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। যেমন- জ্বর, মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা, ক্লান্তি লাগা, ভ্যাকসিন দেয়ার জায়গায় মাংসপেশিতে ব্যথা বা লাল হয়ে যাওয়া। এগুলো যে কারোরই হতে পারে। এতে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। এসব দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করে প্রাথমিক চিকিৎসা নেওয়া যেতে পারে। এর বেশি কিছু নয়।
সবাই ভ্যাকসিন নিন। সচেতন থাকুন, মাস্ক পরুন। বারবার হাত স্যানিটাইজ করুন বা সাবান-পানি দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলুন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করুন। নিজে সুরক্ষিত থাকুন, অন্যকেও সুরক্ষিত থাকতে সহায়তা করুন।
ড. আনোয়ার খসরু পারভেজ : অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় email.khasru73@juniv.edu