ভারতবর্ষ নামকরণ ও প্রাচীন বিভক্তি : সুবলচন্দ্র মিত্রের ‘সরল বাঙ্গালা অভিধানের’ ৯৮৬ পৃষ্ঠার আর্যমতে- পৃথিবী সপ্তদ্বীপে বিভক্ত, ‘যার এক একটি দ্বীপ আবার কতিপয় অংশে বিভক্ত; ওই সকল অংশকে বর্ষ বলে।’ ৯৭৯ পৃষ্ঠা মতে, ‘ঋষভ দেবের পুত্র রাজা ভরতের নামানুসারে এদেশের নাম ভারতবর্ষ হইয়াছে।’ লক্ষণীয় যে, এই ঋষভ দেবই হলেন জৈন ধর্মের প্রবর্তক। অবশ্য সুধীর চন্দ্র সরকারের ‘পৌরাণিক অভিধানের’ ৭৪ পৃষ্ঠায় ‘ঋষভ দেবকে পরমহংস ব্রতের (যোগসিদ্ধ সন্ন্যাসী) পথ-প্রদর্শক ও তার শতাধিক পুত্রের ৯ পুত্রকে ভারতের ৯টি দ্বীপের অধীশ্বর বলা হয়েছে। কিন্তু বইটির ৩৮৪ পৃষ্ঠায় ভারতবর্ষ নামকরণে পুরান থেকে উদ্ধৃত পাল্টা দাবিতে বলা হয়েছে, ‘চন্দ্রবংশীয় রাজা দুষ্মান্তের ঔরসে শকুন্তলার গর্ভের পুত্র ভরত প্রবল পরাক্রান্ত রাজা হইয়া সমগ্র ভারতবর্ষ আপনার শাসনাধীনে আনয়ন করায় তার নামানুসারে ভারতবর্ষের নামকরণ হইয়াছে।’ দৃশ্যত এমন দাবিটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও মনগড়া। কারণ গোটা ভারতবর্ষকে কখনোই ‘আর্যাবর্ত’ বলা হয় নাই। ভারতে উপনিবেশ স্থাপনের পরে প্রায় হাজার বছরব্যাপী আর্যদের আর্যাবর্ত নামীয় ভূ-ভাগের নির্ণীত সীমানার পূর্ব ও পশ্চিমে সমুদ্র; উত্তরে হিমালয় ও দক্ষিণে বিন্ধ্যাচল পর্বতের মধ্যবর্তী হলো ভূ-ভাগ, যা এক ঐতিহাসিক সত্য। উল্লেখ্য, ভারতবর্ষের ঠিক মধ্যস্থলে পূর্ব থেকে পশ্চিমাভিমুখে অবস্থিত বিন্ধ্যাচল পর্বতটির দক্ষিণের দ্রাবিড় ভাষাভাষী গোটা অঞ্চলকে ‘দক্ষিণাবর্ত’ বলা হয়।
প্রাচীনকালে জৈন ও বৌদ্ধ যুগে অন্তত : ২০-৩০টি মহাজনপদ (রাজ্য) ছিল। পরবর্তী মধ্যযুগের প্রারম্ভে ভারতবর্ষের কোথাও ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৌদ্ধ, নমঃশূদ্র, কৈবর্ত, আর কোথাও বা অনার্য প্রমুখের সাম্প্রদায়িক বিভাজ্যের শাসনাধীনে প্রায় ১৩৯টি রাজ্যের কারণে এটি একক স্বত্বাধিকারী দেশ ছিল না। ১৯৪৭ সালে এর শেষ ভাগটি প্রকারান্তরে ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি, যার মূল কারণ ছিল ‘হিন্দু মেলা’ নামীয় জাতীয় পুনরুত্থানে হিন্দির সাথে উর্দু ভাষার পৃষ্ঠপোষকতার প্রতিবাদে ১৮৬৭ সালেই স্যার সৈয়দ আহমদের সাথে সাম্প্রদায়িক আচরণের সর্বপ্রথম বহিঃপ্রকাশ।
সর্ব ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস
ভারতে রাজ প্রতিনিধি স্বরূপ ব্রিটিশ শাসক লর্ড ডাফরিনের (১৮৮৪-৮৮ খ্রি:) কিছুটা নেপথ্য ভ‚মিকায় দুই অবসরপ্রাপ্ত ইংরেজ আইসিএস কর্মকর্তা অ্যালান অকটোভিয়ান হিউম, উইলিয়াম ওয়েডারবার্ন এবং একজন ভারতীয় পারসি ব্যক্তিত্ব দাদাভাই নৌরোজিকে দিয়ে ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় জাতীয় কংগ্রেস রাজনৈতিক দল। বাঙালি ব্যারিস্টার উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে বম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই) এর প্রথম অধিবেশনে যোগ দেয়া মোট ৮৩ প্রতিনিধির মধ্যে মাত্র দু’জন উর্দুভাষী মুসলমান, কয়েকজন জৈন ও পার্সি ছাড়া অবশিষ্ট ৫৪ জনের সবাই ছিলেন ইংরেজি শিক্ষিত ব্রাহ্মণ। পরবর্তী সময়ে বিশিষ্ট মুসলিম ব্যক্তিদের দলভুক্তির মাধ্যমে কংগ্রেসই ভারতের একমাত্র প্রতিনিধিত্বকারী দল বলে উপস্থাপনের চেষ্টা শুরু হয়। কিন্তু স্যার সৈয়দ আহমদকে যোগদানের আমন্ত্রণপত্রের উত্তরে ১৮৮৮ সালেই তিনি সর্বপ্রথম দ্বিজাতিতত্তে¡র উল্লেখ করেন এবং তা প্রত্যাখ্যান করেন। তার অনুকরণে অনেকেই তখন কংগ্রেসে যোগদান থেকে বিরত থাকেন।
মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার নেপথ্য কারণ
ঐতিহাসিক তথ্য মতে, নদীমাতৃক ও যাতায়াতে কষ্টসাধ্য বাংলাকে শাসনের সুবিধার্থে অঞ্চলভেদে ভাগের প্রথা প্রথম শুরু হয় বল্লাল সেনের রাজত্বকাল (১১৫৯-৭৯ খ্রি:) হতে। এর ধারাবাহিকতার উল্লেখ আছে বাংলার ইতিহাসে। একই কারণে ১৯০৫ সালে ব্রিটিশের বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথমে উত্থিত বাঙালি জাতীয়তাবাদী বঙ্গভঙ্গ (ভাগ রদ) আন্দোলনে কংগ্রেস সমর্থন দেয় এবং পরের বছর ২৬ থেকে ২৯ ডিসেম্বর কলকাতায় এর প্রতিবাদী অধিবেশনের দিন স্থির করা হয়। কিন্তু ভাগ সমর্থনে মুসলিম কোনো রাজনৈতিক দল তখনো ভারতে না থাকায় এবং এর আশু প্রয়োজনে তখন পূর্ব বাংলায়ও (বাংলাদেশ) তা সমর্থন করার মতো শিক্ষিত বেকার তথা রাজনীতিতে সম্পৃক্ত সচ্ছল জনশক্তির নিদারুণ অভাবে তাও ছিল অসম্ভব। অগত্যা নবাব স্যার সলিমুল্লাহ আলীগড়কেন্দ্রিক মুসলিম শিক্ষা সমিতির অধিবেশন আহ্বান করেন ঢাকায়। ফলে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে কমপক্ষে ৪০ জন খ্যাতনামা অবাঙালি মুসলমান ‘সাম্প্রদায়িক’ স্বার্থ রক্ষার চেষ্টায় ঢাকায় সমবেত হন যখন কলকাতায় কংগ্রেস অধিবেশনে দাদাভাই নৌরোজী ও তার সেক্রেটারি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উপস্থিত।
এ দকে ঢাকার শাহবাগে উত্তর প্রদেশের মুরাদাবাদের নবাব ভিকার উল মুলক মুশতাক হুসেনের (১৮৪১-১৯১৭ খ্রি:) সভাপতিত্বে ৫৮ জন প্রতিনিধির অধিবেশন শেষে ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠা করা হয় সর্বভারতীয় মুসলমানের রাজনৈতিক কণ্ঠ মুসলিম লীগ। উল্লেখ্য, ওই অধিবেশনের আগে শেরেবাংলা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে চাকরিতে যোগ দেন। পরে পদত্যাগ করে ১৯১২ সালে আইন পেশায় কলকাতা বারে যোগ দেন এবং তার রাজনৈতিক অভিভাবকত্ব নিয়ে নবাব সলিমুল্লাহ তাকে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে মুসলিম শিক্ষা সমাবেশে প্রেরণ করেন। অতঃপর ১৯১৫ সালে এই নবাবের মৃত্যুর পরে তিনি প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সেক্রেটারির পদ প্রাপ্ত হন। জিন্নাহকে যোগ দেয়ানোর বেশ অনুরোধান্তে ১৯১৯ সালে তাকে সভাপতি মনোনীত করায় পরের বছর তিনি কংগ্রেসের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। (নরেশ কুমার জৈনের Muslims in India, A Biographlcal Dictionary, vol-1, P-162, 22g-vol-11, P-133 )
বাঙালি জাতীয়তাবাদ সমর্থনের যৌক্তিকতায় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে মুসলমানের সার্বিক সমর্থনের কথা আজ কেউ কেউ বলে থাকেন। অবশ্য উভয় বাংলায় এর সংখ্যা ছিল হাতে গোনা; ছিল বরং এর সার্বজনীন বিরোধিতা। বহু তথ্য ছাড়াও রবীন্দ্র রচনাবলী, চতুর্বিংশ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৪৪-৪৫৩-এর ‘হিন্দু মুসলমান’ প্রবন্ধে এর সত্যতা প্রসঙ্গে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের রয়েছে স্বীকারোক্তি। আন্দোলনটির স্লোগান ‘জয়বাংলা’ ছিল না, ছিল ‘বন্দেমাতরম’। সংখ্যালঘুদের উজ্জীবিত করে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনকে বেগবান করতে ১৯০৬ সালের ৪ জুন কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয় ‘শিবাজী মেলা’। মঞ্চস্থ করা হয় ক্ষীরোদ প্রসাদের ‘প্রতাপাদিত্য’, আন্দোলন উপলক্ষে সদ্য রচিত (১৯০৫) দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘রানা প্রতাপসিংহ’, (১৯০৬)-এ দুর্গাদাস এবং (১৯০৯)-এ ‘মেবার পতন’ প্রভৃতি নাটক। মুসলিম বিদ্বেষী এসব প্রচারণা তখন বহুলাংশে ব্রিটিশরা নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। তৎসত্ত্বেও ময়মনসিংহ, ঢাকা, কুমিল্লা ও ফরিদপুরে তীব্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে; অনেক স্থানে অনুরূপ ছোটখাটো ঘটনা ঘটেছে। ক্ষিপ্ত স্বজাতীয়রা ১৯০৬ সালের অক্টোবরে সিরাজগঞ্জের ইসমাইল হোসেন শিরাজীকে সে আন্দোলন সমর্থনের অভিযোগে প্রহার করেছেন বলে তথ্য রয়েছে পূর্বোল্লিখিত বই-এর VOL-I, P-220 তে। ব্যাপক সহিংস আন্দোলনের প্রভাবে শেষ পর্যন্ত বঙ্গ ভাগ রদের ঘোষণা দেয়া হয় ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর। তবে ১৯১২ সালের ১ এপ্রিল ব্রিটিশ-ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করায় জাতীয়তাবাদীরা বিস্ময়করভাবে ছিলেন প্রতিক্রিয়াহীন ও নীরব-আত্মবিস্মৃত। এর প্রায় মাস তিনেক পরে জুলাই মাসে বাংলার বিবিধ জেলার ৭৭ এবং পূর্ববাংলার ৭৬ জন মুসলিম শিক্ষার্থীর কলকাতাস্থ কলেজ ও হোস্টেলসমূহে ভর্তি প্রত্যাখ্যান করা হয়। (সূত্র : পশ্চিম বাংলায় বিদ্যাসাগর কলেজে ইতিহাসের প্রফেসর ড. চণ্ডীপ্রসাদ সরকারের The Bengali Muslims, 1912-1029, P-41।
ভারতবর্ষে প্রায় ৫৫০ বছরের মুসলিম শাসনের অবসান-পরবর্তী সময়ে প্রায় ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শাসনে মুসলমানের আর্থ-সামাজিক দুরবস্থার পাশাপাশি, অন্তত তিন হাজার বছরের পরধর্ম অসহিষ্ণুতার ইতিহাসের নিরিখে, ভারত ভাগে মুসলমানের জন্য পৃথক আবাসভূমি স্থাপনে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ সমর্থ হয়েছিল। এ জন্য দলটির বিরুদ্ধে ‘সা¤প্রদায়িকতা’র অভিযোগ তুলে অসচেতন মুসলিম জনগোষ্ঠীর মনে আজো অনেকে বিদ্বেষ সৃষ্টির কৌশলী সমালোচনা করে ‘নবাব, জমিদার আর উচ্চবিত্তের দল বলে’ থাকেন।