১৭৫৭ সালে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ উদ্দৌলার পরাজয়ের পর বেঙ্গল শাসন করা শুরু করে ব্রিটিশরা। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ হয়। সেই সিপাহী বিদ্রোহ ভারতবর্ষব্যাপী বিস্তৃত হয়ে পড়ে। তখনো ব্রিটিশ শাসকদের রাজধানী ছিল কলকাতায়।
সিপাহী বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেয় বাঙালিরা। এ সিপাহী বিদ্রোহ দমন করতে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীকে বেশ বেগ পেতে হয়। কারণ এ বিদ্রোহের রেশ টানতে ব্রিটিশদের ১৮৫৮ থেকে শুরু করে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত সময় ব্যয় করতে হয়েছিল। এ সময় তারা দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরকে রেঙ্গুনে পাঠায়। রেঙ্গুনে পাঠিয়ে তারা চিন্তা করল যে সেখানে তাদের শাসনকাজ পরিচালনার জন্য একটি বাহিনী দরকার।
সেই বাহিনীর জন্য তারা পিআরবি (পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল) নামে একটি বাহিনী গঠন করল। এর পরপরই এলো পেনাল কোড। পেনাল কোড এবং পিআরপি একসঙ্গে চলতে লাগল। এগুলো পরিচালনার জন্য ১৮৯৮-এর দিকে এলো সিআরপি নামে আরও একটি বিধান।
এ আইনগুলো তৈরি হয়েছিল ব্রিটিশদের শাসন-শোষণ দুটিই চালু রাখার জন্য এবং আইনগুলো সেভাবেই তৈরি করা হয়েছিল। অবশ্য ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীদের তৈরি করা আইনে ‘রিমান্ড’ শব্দটি ছিল না। তাহলে রিমান্ড এর ব্যবহার কেন? আমাদের বাংলাদেশে এ রিমান্ড নিয়ে একটা ট্র্যাডিশন চলে আসছে বহুকাল ধরে। ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ব্রিটিশদের করা আইনগুলো বহাল রাখে। কারণ পাকিস্তানিদেরও টার্গেট ছিল একটাই, শাসন ও শোষণ। ওই চিন্তাতেই তারা পুলিশদের ট্রেনিং দেওয়া শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় আজ অবধি চলছে দেশ।
সম্প্রতি পরীমনির রিমান্ড নিয়ে মিডিয়ায় বেশ আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। এ রিমান্ড নিয়ে কিছু বক্তব্য উপস্থাপন করতে চাই। কোনো অপরাধীকে পুলিশ গ্রেফতারের পর কী করে, অপরাধীকে তার অপরাধের দোষ স্বীকার করায়। অপরাধীর এ স্বীকারোক্তি বা জবানবন্দি যখন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে দেয়, তখন ওই ফর্মে একদম ছাপানো অক্ষরে লেখা আছে, স্বীকারোক্তি নির্ভয়ে দিচ্ছে কি না, সে বলবে যে হ্যাঁ, নির্ভয়ে দিচ্ছি।
আপনার কোনো অত্যাচারের ভয় নাই, এখানে কোনো পুলিশ নাই ইত্যাদি উল্লেখ রয়েছে। তার মানে দাঁড়ায় অত্যন্ত নির্বিঘ্নে নির্দ্বিধায় এ জবানবন্দি সে দিচ্ছে। আমার প্রশ্নটি হলো, যেখানে নির্বিঘ্নে নির্দ্বিধায় কোনো ভয়ভীতি ছাড়া একজন অপরাধীর জবানবন্দি দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে থানায় রিমান্ডে নেওয়ার কী দরকার? এ জবানবন্দি জেলগেটে নেওয়া যেতে পারে, তার বাসায়ও তাকে জিজ্ঞাসা করা যেতে পারে।
একজন অপরাধী যে জবানবন্দিই দিক, সেটা নির্বিঘ্নে নির্দ্বিধায় কোনো ধরনের ভয়ভীতি ছাড়া হতে হবে, স্বেচ্ছায় জবানবন্দি প্রদান, যেটাকে আমরা ১৬৪ সিআরপি বলি। স্বেচ্ছায় নির্বিঘ্নে নির্দ্বিধায় যদি জবানবন্দি পাওয়া যায়, তাহলে অপরাধীকে নির্যাতন করার কী দরকার। একজন অপরাধীকে নির্যাতন করার অধিকার তো কারোর নেই। সে যত বড় লাট সাহেবই হোক আর অপরাধী যত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যক্তিই হোক, তার গায়ে হাত দেওয়ার অধিকার, তাকে অপমান করার অধিকার কারোর নেই।
সে যদি অন্যায় করে, সেটার বিচার করবে আদালত। অন্য কেউ নয়। আমাদের দেশে দুর্ভাগ্যজনকভাবে একটা ট্র্যাডিশন চলে আসছে যে, অপরাধীকে ধরার পরই তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডের আবেদন করা হয় ১৬৭ সিআরপিসি ধারা অনুযায়ী। এ যেন এক স্বাভাবিক রীতি চালু হয়ে গেছে এখানে। মানবাধিকার পরিপন্থি এ ধরনের ট্র্যাডিশন ও রীতির বলয় থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
যুদ্ধাপরাধীদের বেলায় তাদের সেফ হোমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে ডাক্তার ছিল, আইনজীবী ছিল, তাদের আত্মীয়স্বজনও ছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বেলায় যদি এ ধরনের ব্যবস্থা থাকে তাহলে আমাদের দেশের অন্য সাধারণ নাগরিকদের জন্য কেন নয়। সাধারণ নাগরিকদের বেলায় এর ব্যতিক্রম হবে কেন। স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য কেন তাদের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেতে হবে।
কেন তাদের গায়ে হাত তুলতে হবে। গ্রেফতারের পর কেন তাদের আত্মীয়স্বজন, আইনজীবী পাশে থাকবে না। কেন তাদের আইসোলেশনে যেতে হবে। এ প্রশ্নগুলো খুবই যৌক্তিক। নিয়মানুযায়ী তাকে জেলখানায় রাখতে হবে। তাকে কোনো ধরনের টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়া যাবে না। তাকে বাধ্য করা যাবে না তার নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে। জোর জবরদস্তি করে, নির্যাতন করে তার নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা আইনের পরিপন্থি, এটা সংবিধানেরও পরিপন্থি।
এটা করা বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এরপরও এটা করা হচ্ছে। এ ধরনের কাজে ব্যবহৃত রিমান্ড নামক শব্দটি আমাদের প্রশাসন থেকে নির্মূল হওয়া প্রয়োজন। মাহামান্য আদালতের কাছে আমাদের প্রার্থনা, আলোচিত-সমালোচিত পরীমনির রিমান্ডটিই যেন শেষ রিমান্ড হয়।
আর কারও কোথাও যাতে রিমান্ডে যেতে না হয়। সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে বিস্তৃতভাবে এর বর্ণনা আছে। বিস্তৃত বর্ণনা থাকা সত্ত্বেও সংবিধান লঙ্ঘন করে তারা এটা কীভাবে করে! সংবিধানে থাক আর না থাক, পুলিশ কারও গায়ে হাত দিতে পারবে, এটা কোনো আইনে থাকতে পারে না।
পুলিশের স্বেচ্ছাচারিতা ও নির্মমতায় মেজর সিনহা হত্যার যথাযথ বিচার হওয়ায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অনেকটা বন্ধ হয়ে গেছে। আমার ধারণা, আমরা যদি সবাই এ ব্যাপারে সেচ্চার হই তাহলে রিমান্ড নামক বিভীষিকা থেকে আমরা রেহাই পাব। পাশাপাশি আমি মানবাধিকার কমিশন এবং বিচার বিভাগের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বলব যে তারা একটু থানা হাজত, কোর্ট হাজতগুলোয় সরেজমিনে গিয়ে দেখুক এবং দেখলেই তারা বুঝতে পারবে যে সেখানে শুধু মানুষ নয়, কোনো পশুর পক্ষেও থাকা সম্ভব নয়।
এটা একটা স্বাধীন দেশ। এ দেশটা অনেক ব্যতিক্রমী দেশ। এ দেশে নয় মাসে ৩০ লাখ মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে নেই এত অল্প সময়ে এত বেশি আত্মাহুতি। চার-পাঁচ বছরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ৬০ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছে। আর আমাদের দেশে মাত্র নয় মাসে ৩০ লাখ নিরস্ত্র মানুষ মারা গেছে। নিরস্ত্র বাঙালি গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক একটা দেশ গড়ার জন্যই এ আত্মাহুতি দিয়েছে।
এত আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এ দেশে কেন এ ধরনের নিপীড়ন-নির্যাতন থাকবে। আমাদের এ দেশ গণতান্ত্রিক একটি দেশ। আর গণতন্ত্র মানেই কিন্তু আইনের শাসন। অত্যাচারের বিরুদ্ধেই ছিল আমাদের লড়াই। আমাদের পুলিশবাহিনীও লড়াই করেছে। সব পুলিশ খারাপ সেটা আমি বলছি না। কিন্তু দু-চারজন পুলিশের কিছু কিছু কর্মকাণ্ডের কারণে পুরো ডিপার্টমেন্টেরই বদনাম হচ্ছে। এটা কাম্য হতে পারে না। তাদেরও তো বোঝা উচিত যে এ বদনামটা তাদের ঘাড়ে নেওয়া পুরো পুলিশ প্রশাসনের জন্যই অসম্মানের।
পরীমণিকে প্রথম ৪ দিন থাকতে হয়েছে র্যাবে, র্যাবে একজন মহিলাকে রাখার মতো কোথাও কোনো জায়গা আছে কি না আমার জানা নেই। এরপর ডিবিতে রাখা হয়েছে। আসামি রাখার মতো কার কোথায় জায়গা আছে, পুরুষ আসামি এবং মহিলা আসামি রাখার মতো পৃথক জায়গা আছে কি না, কতটুকু জায়গা আছে, সেখানে আসামিকে কীভাবে রাখা হয়, এ বিষয়গুলো সরেজমিনে দেখা উচিত। আমলাদের দিয়ে তো আর সবকিছু হয় না। এ বিষয়গুলো স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে দেখার মতো কেউ আছে বলে মনে হয় না। একবার সরেজমিনে ঘুরে দেখেছিলেন মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান। তিনি বিভিন্ন জেলখানা ঘুরে ঘুরে দেখেছিলেন। বর্তমানে যারা চেয়ারে আছেন, তাদের এ ধরনের কোনো প্রয়াস দেখছি না, বসে বসে বেতন নেওয়া ছাড়া।
রিমান্ডের বিরুদ্ধে আমরা প্রথম মামলাটি করি ২০০৩ সালে। মামলাটি অ্যাপিলেট ডিভিশনে এপ্রুভড হয়েছে। এপ্রুভড হওয়ার পর এটা রিভিউতে আছে। মামলাটির কোথাও ইনজাংশান নেই। তার মানে এটা ইনফোর্সে আছে। আমাদের সব আইনের ওপরে সংবিধান। আমাদের সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। রিমান্ডের ক্ষেত্রে আপিল বিভাগের রায় হলো, আসামিকে স্বচ্ছ কাচের ভেতরে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। বিবাদী পক্ষের আইনজীবীর উপস্থিতি থাকতে হবে। ওই নির্দেশনার কারণেই যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের সেফ হোমে নিয়ে চিকিৎসক, আইনজীবী, এমনকি স্বজনদের উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাহলে অন্যান্য ক্ষেত্রে এর ভিন্নতা হবে কেন? সুতরাং রিমান্ডের বিরুদ্ধে মামলাটি ভায়োলেট করার কোনো কারণ নেই। নিু আদালত কীভাবে কোন প্রেক্ষাপটে রিমান্ড দেয়, সেটা খুঁজে বের করতে হবে।
কোনো মহিলা অপরাধীর বেলায় আমাদের প্রশাসনের একটু যত্নবান হওয়া উচিত। বেশ কিছুদিন আগে ভিকারুননিসার এক শিক্ষিকার বিরুদ্ধে একটা মেয়েকে আত্মহত্যার প্ররোচনা দেওয়ার জন্য অভিযুক্ত করা হয়। সেজন্য পুলিশ তাকে সন্ধ্যার পর তার বাসভবন থেকে ধরে নিয়ে আসে। এই যে সন্ধ্যার পর অভিযান চালিয়ে আসামি ধরা, এটা বন্ধ করতে হবে। কেননা পুলিশ কোথাও গেলে একটা আতঙ্কের সৃষ্টি হয়, আর এ আতঙ্কের কারণে অনেকের অসুবিধা হতে পারে। যে বাসায় আসামি ধরতে যাবে, সে বাসায় একটা হার্টের রোগী থাকতে পারে, অপারেশনের রোগী থাকতে পারে, কোনো পরীক্ষার্থী থাকতে পারে।
সুতরাং এ জায়গাটাতে আমাদের সতর্ক হওয়া দরকার। কাউকে গ্রেফতার করতে হলে সকালবেলা তাকে গ্রেফতার করা হোক। ভিকারুননিসার যে শিক্ষিকা, সে কি দুর্ধর্ষ ছিল, আর পরীমনিই বা কি দুর্ধর্ষ? সব মহিলার ক্ষেত্রেই দেখা যায় পুলিশ বিকালের দিকে গিয়ে গ্রেফতার করে নিয়ে আসে। কারণ বিকাল বেলা তো কোর্টের কাজকর্ম বন্ধ থাকে। আর এ কারণেই কি আসামিকে গ্রেফতার করা হয় সন্ধ্যার পর?
সন্ধ্যার পর কেন হবে? নিয়মটা কী? আইনে স্পষ্টভাবে বলা আছে, গ্রেফতারের তিন ঘণ্টার মধ্যে আসামির আইনজীবী এবং আত্মীয়স্বজনকে জানাতে হবে। তাকে দেখাতে হবে কী গ্রাউন্ডে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এসব তো কিছুই তারা করে না। তাছাড়া আমরা জনগণও আইনের এ বিষয়গুলোর অনেকটাই জানি না। আর না জানার কারণে আমরা এসব মেনে নিচ্ছি। আমরা ধরেই নিয়েছি এখনো ব্রিটিশ আমলের পুলিশ দিয়েই দেশ চলছে। ওই ধারাই বহাল আছে এবং আমাদের এভাবেই চলতে হবে। কোনো বিশেষ কারণে ওয়ারেন্ট ছাড়া কাউকে পুলিশ ধরতে পারে। কিন্তু ধরলে যে তাকে থানায়ই নিতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ধরার পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তাকে কোর্টে হাজির করতে হবে।
৩ ঘণ্টার মধ্যেই তাকে বলতে হবে তার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ। রিমান্ডে নেওয়া ক্ষমতার অপব্যবহার। একজনকে রিমান্ডে নিয়ে গেলে একটা মানসিক চাপ বা যন্ত্রণা হয়। রিমান্ডে নিয়ে একটা চেয়ারে বা একটা টুলের মধ্যে বসিয়ে রাখা হয়। পরিবার পরিজনও সেই মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে থাকে। মানসিক যন্ত্রণা দৈহিক যন্ত্রণার চেয়েও বেশি। এ বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে। সবার অধিকার রয়েছে সঠিক আইনে বিচার পাওয়ার।
জেড আই খান পান্না : অ্যাডভোকেট, সুপ্রিমকোর্ট; সাবেক সভাপতি, আইন ও সালিশ কেন্দ্র