রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১১:২২ অপরাহ্ন

উপেক্ষিত দেশের শিক্ষকসমাজ

এ বি এম ফজলুল করীম
  • আপডেট টাইম : মঙ্গলবার, ৫ অক্টোবর, ২০২১
  • ১৭৬ বার

আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস। শিক্ষকদের মর্যাদা ও অধিকার রক্ষার প্রত্যয় নিয়ে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হয়। এ উপলক্ষে আমাদের দেশেও প্রতি বছর বিভিন্ন সংগঠন কর্মসূচি পালন করে। শিক্ষকদের কাছে দিবসটি তাদের যুক্তিসঙ্গত দাবি আদায়ের দিন। ১৯৬৬ সালে ৫ অক্টোবর প্যারিসে আন্তঃসরকার সম্মেলনে ইউনেস্কো এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আএলও) শিক্ষকদের অধিকার, দায়িত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কিত একটি যৌথ সুপারিশমালা প্রণয়ন করে। এতে শিক্ষকদের দায়িত্ব, অধিকার, নিয়োগ, পদোন্নতি, চাকরির নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা বিধানের প্রক্রিয়া, পেশাগত স্বাধীনতা, প্রশিক্ষণ, মূল্যায়ন, শিক্ষাসংক্রান্ত নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ, কার্যকর শিক্ষাদান-শেখানোর পরিবেশ এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। প্যারিস সম্মেলনকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৯৯৪ সালে ৫ অক্টোবরকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস ঘোষণা করা হয়। করোনাকালে শিক্ষকদের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘টিচারস অ্যাট দ্য হার্ট অব এডুকেশন রিকভারি’। এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের মূল দাবি শিক্ষকদের স্বার্থ সংরক্ষণের পাশাপাশি মানসম্মত নৈতিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় আদর্শের আলোকে শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে, যাতে করে মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন নৈতিক চরিত্রের অধিকারী আলোকিত মানুষ তৈরি হতে পারে। সব স্তরে আদর্শ শিক্ষক হিসেবে নিজেদের তৈরি করতে হবে। জবাবদিহি নিশ্চিতের বিষয়েও গুরুত্বারোপ করতে হবে।

শিক্ষকরা আদর্শ ও মানবতাবাদী জাতি গঠনের কারিগর হলেও আমাদের দেশে তাদের অধিকার ও মর্যাদা বিষয়ে শিক্ষকসমাজ হতাশায় নিমজ্জিত। অথচ জাতি গঠনে তাদের অবদান অসামান্য। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সৎ যোগ্য-দক্ষ, দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তুলতে ভূমিকা অগ্রগণ্য। এ কারণে শিক্ষকের মর্যাদা অতুলনীয়। ঐতিহ্যগতভাবে বিশ্বব্যাপী সব সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা সর্বাধিক। তারাই সমাজের সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষকদের অবস্থা তেমন নয়। দেশে শিক্ষকরা সমাজে উপেক্ষিত ও বঞ্চিত। বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকরা। আর্থিক দৈন্যদশা ও সামাজিক বঞ্চনা দেশের বেসরকারি শিক্ষকসমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তাদের বঞ্চনা-দুঃখ-যাতনার বেশির ভাগই অব্যক্ত। করোনাকালে ১৮ মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় নন-এমপিওসহ সর্বস্তরের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। মাঝে মধ্যে সংবাদমাধ্যমে শিক্ষকদের আর্তনাদের দু-একটি চিত্র জানা যায়। এতেই বোঝা যায় বেসরকারি শিক্ষকরা কেমন আছেন।

বাংলাদেশে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিতদের চেয়ে অনেক কম সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন শিক্ষকরা। একই সিলেবাস ও প্রশ্নের পরীক্ষায় পাস করেও বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের সুযোগ-সুবিধা অন্য ক্যাডারের চেয়ে কম। অপেক্ষাকৃত কনিষ্ঠ প্রশাসনিক কর্মকর্তার দিকনির্দেশনা পদবিতে জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের মেনে চলতে হয়। স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের ¯œাতক পাস মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার নির্দেশনা মানতে হয়।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্নাতক পাস শিক্ষকদের বেতনকাঠামো এসএসসি/অষ্টম শ্রেণী পাস সরকারি কর্মচারীদের মতো বিবেচনা করা হয়। অধিকন্তু সর্বস্তরের শিক্ষকদের পদোন্নতি এবং সুযোগ-সুবিধার অপ্রাপ্তি তাদের পেশাগত হতাশা বাড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া শিক্ষকদের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি বৈষম্য তো আছেই। শিক্ষাগত যোগ্যতায় সমান এবং একই পাঠ্যক্রমে ও একই নিয়মে পাঠদান সত্ত্বেও সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের বৈষম্য লক্ষ করার মতো। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাড়িভাড়া, চিকিৎসা-উৎসব ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়। নিয়োগের বিভিন্ন শর্তের বেড়াজালে এবং এমপিওর অজুহাতে মাসের পর মাস এমনকি বছরের পর বছর বেতনভাতা বঞ্চিত ও হয়রানি করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল ও মাদরাসা শিক্ষকদের পদোন্নতির অব্যবস্থাপনা-বঞ্চনা শিক্ষকসমাজকে হতাশ করছে। বেসরকারি কলেজ-শিক্ষকদের মেধা-যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতির ব্যবস্থা নেই। জেষ্ঠ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতির অব্যবস্থাপনা, প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপকের আনুপাতিক হারের বেড়াজালে অপেক্ষাকৃত মেধাবী প্রভাষকদের সহকারী অধ্যাপকের পদ লাভে বঞ্চিত করা হচ্ছে। অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপকের কোনো পদ না রেখে তাদের বঞ্চনা আরো বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এমফিল, পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন এবং উচ্চতর গবেষণায় পদোন্নতি ও সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা না করে বেসরকারি শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া বেশির ভাগ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি/সদস্য স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাদের অনেকেই অল্পশিক্ষিত। অথচ তারাই খবরদারি করেন শিক্ষকদের ওপর। প্রচলিত বিধানে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ ও বরখাস্তের ক্ষমতা থাকায় অনেকসময় তাদের অন্যায় দিকনির্দেশনা মানতে হয় শিক্ষকদের। এতে তাদের মর্যাদা ও ব্যক্তিত্ব ভূলুণ্ঠিত হয়।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ-স্কুল-মাদরাসা-কিন্ডারগার্টেন, স্কুল, ইবতেদায়ি মাদরাসা ও মক্তবসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের চাকরির ক্ষেত্রে সরকারি সুনির্দিষ্ট কোনো বিধিবিধান না থাকায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করতে হয়। কর্তৃপক্ষের ব্যবসায়িক লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে এবং ইচ্ছা-অনিচ্ছায় এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের নিয়োগ ও চাকরিচ্যুত করা হয়। তাই চাকরি রক্ষার্থে অনেক সময় আত্মমর্যাদা ভুলে শিক্ষকদের তোষামোদ করতে দেখা যায়। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেতনভাতার সুনির্দিষ্ট কোনো বিধি না থাকায় শিক্ষকদের চরমভাবে বঞ্চিত করা হয়। করোনাকালে এসব শিক্ষকের বঞ্চনা আরো বেড়ে যায়। অনেক শিক্ষকের বেতনভাতা কমিয়ে দেয়া হয়। অনেককে বিনাবেতনে ছুটি দেয়া হয়। আবার অনেককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।

নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ না হওয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসা ও কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকরা দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। দীর্ঘ দিন ধরে বেতনভাতা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। সরকারি আশ্বাস ও দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে এমপিওভুক্ত না হওয়ায় এসব শিক্ষক বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তাদের পারিবারিক জীবন দুদর্শাগ্রস্ত। করোনাকালে তাদের জনপ্রতি মাত্র পাঁচ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। তা-ও অনেকে পাননি।

শিক্ষকদের বেতনভাতা ও সুযোগ-সুবিধার জন্য সভা-সমাবেশ ও রাজপথে আন্দোলন করতে হয়। আন্দোলন করতে গিয়ে শিক্ষকরা নির্যাতন-লাঞ্ছনার শিকার হন। এমনকি পুলিশি নির্যাতনে শিক্ষক নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এমন বঞ্চনা-অবহেলায় বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুলসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষক শিক্ষার্থীদের হাতেও লাঞ্ছিত হয়েছেন। শিক্ষকসমাজের করুণ দশা জাতিকে লজ্জিত করে। তাদের বঞ্চনা সামাজিক বিবেকবোধকে দংশন করে।

তবে অনেক শিক্ষকনেতা রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে প্রভাব-কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। কেউ সাময়িক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করলেও স্থায়ীভাবে সব শিক্ষকই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। অনেক শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের পরিবর্তে প্রাইভেট বা কোচিং করে অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত। তবে অত্মমর্যাদাসম্পন্ন কোনো শিক্ষকই প্রাইভেট পড়াতে চান না। কিন্তু অর্থনৈতিক দৈন্য ঘোচাতে কাউকে এ কাজ করতে হয়। ক্ষেত্রবিশেষে নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ফল ভালো করাতেও অনেক শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের প্রাইভেট পড়িয়ে থাকেন। তবে শিক্ষকদের দায়িত্ব পালনে কর্তব্যনিষ্ঠ ও নৈতিকতাসম্পন্ন হওয়া শিক্ষার উন্নয়নের অন্যতম শর্ত। পাশাপাশি তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে সুষ্ঠু পদোন্নতির ব্যবস্থা থাকাও আবশ্যক। এসব ব্যবস্থায় শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বা বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন।

দেশের শিক্ষাব্যবস্থার এমন প্রেক্ষাপটে এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবসে প্রত্যাশা- শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো, সবার চাকরি জাতীয়করণ ও শিক্ষকদের সব বঞ্চনা-বৈষম্য দূর করার পদক্ষেপ নেবে সরকার।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক ও সাবেক সিনেট সদস্য,

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com