শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারী ২০২৫, ০৩:০৪ অপরাহ্ন

শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলার পেছনে ‘পীর সিন্ডিকেট’

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২১
  • ১৭৮ বার

রাজারবাগ দরবার শরীফের পীর দিল্লুর রহমানের ‘মামলা সিন্ডিকেটের’ হয়রানির শিকার ব্যক্তিরা মুখ খুলতে শুরু করেছেন। সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী, শিক্ষক; এমনকি সাংবাদিকরাও তাদের খপ্পরে পড়েছেন। ভুক্তভোগীরা জানান, সারাদেশে অসংখ্য মানুষকে মামলার ফাঁদে ফেলে নিঃস্ব করেছে সিন্ডিকেটের সদস্যরা। সুযোগ বুঝে ভাগিয়ে নিয়েছে শত শত একর জমি। ইতোমধ্যে এসব সম্পদের উৎস খুঁজতে দুদককে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। শিগগিরই পীর ও তার প্রতিষ্ঠানের অবৈধ সম্পদের খোঁজে দুদক মাঠে নামছে বলে জানা গেছে।

বেশিরভাগ ভুক্তভোগীরই অভিযোগ, জমিজমা সংক্রান্ত লেনদেনে সিন্ডিকেট সদস্যদের কথামতো রাজি না হলেই ঠুকে দেওয়া হয় মিথ্যা মামলা। হয়রানি করা হয় সাধারণ মানুষকে। একটি কলেজ ফান্ডের টাকা লুটপাটকারী সিন্ডিকেটের সঙ্গেও ছিল তাদের যোগসাজশ। এ বিষয়ে অনুসন্ধনে জানা গেছে, রাজধানীর বোরহানুদ্দিন পোস্টগ্রাজুয়েট কলেজের নামে ২০১৯ সালে কেরানীগঞ্জে প্রায় ছয় একর বা ৬০০ একর জমি কেনার চুক্তি হয় পীর সিন্ডিকেটের সদস্য মো. শাহ আলমের সঙ্গে। সারা রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড ডেভেলপার কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তিনি। জমি ক্রয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক শিক্ষক আবু নাঈম মো. রাফি মূলত তার প্রতিবেশী ও ব্যবসায়িক পার্টনার। তাই খুব সহজেই জমি কেনার নামে তৎকালীন গভর্নিং বডির সভাপতি ও কয়েকজন শিক্ষক লুটপাটের আয়োজন করেন বলে অভিযোগ। দেখানো হয় বাজার দরের চেয়ে বেশি দাম। এদিকে জমি কেনা-বেচাসহ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নামে নানা কৌশলে কলেজ ফান্ডের টাকা লুটপাটের অভিযোগে গত বছর আন্দোলনে নামেন কলেজটির শিক্ষক ও কর্মচারীরা। একপর্যায়ে বিদায় নিতে হয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি অধ্যাপক হারুন-অর রশিদ খানকে। পরবর্তী সময় শিক্ষা অধিদপ্তর তদন্ত করেও কলেজের দুর্নীতি-অনিয়মের প্রমাণ পায়।

বসে নেই সিন্ডিকেটের সদস্যরাও। জমি কেনার নামে লুটপাটের প্রতিবাদে ডাকা আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকা কলেজটির সহযোগী অধ্যাপক মোহা. বদরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ঠুকে দেওয়া হয় ‘মিথ্যা’ মামলা। গত বছরের ২০ আগস্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ১-এ মানবপাচার আইনে করা ওই মামলার প্রধান আসামি মো. বদরুল ইসলাম। অপর চার আসামির কাউকেই চেনেন না ওই শিক্ষক। আবার মামলা দায়েরের পর থেকে বাদী কুলছুমা আকতারকে আর ‘খুঁজে’ পাওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যেই হঠাৎ একদিন রাতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে সহযোগী অধ্যাপক বদরুলের বাসায় হাজির হয় পুলিশ।

মামলার রহস্য অনুসন্ধানে গিয়ে শিক্ষক বদরুল ইসলাম জানতে পারেন, কলেজের জমি কেনার সঙ্গে যে শাহ আলমের চুক্তি হয়েছে, তিনি রাজারবাগ দরবার শরীফের পীরের মামলা সিন্ডিকেটের একজন সক্রিয় সদস্য। ৪৯টি মিথ্যা মামলার আসামি একরামুল আহসান কাঞ্চনের বিরুদ্ধে করা কয়েকটি মামলারও হোতা এ শাহ আলম। ইতোমধ্যে কাঞ্চনের বিরুদ্ধে করা মিথ্যা মামলার পেছনে পীর সিন্ডিকেট জড়িত রয়েছে বলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি হাইকোর্টে প্রতিবেদন দাখিল করেছে। এ ছাড়া মানবপাচার আইনে করা এই মামলার চার নম্বর আসামি আলতাফ হোসেনের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানাধীন কুতুবপুর এলাকায়। যিনি আবার কাঞ্চনের ডাইং ফ্যাক্টরির ভাড়াটিয়া।

জানতে চাইলে একরামুল আহসান কাঞ্চন বলেন, ‘জনৈক শাকেরুল কবির ভাড়াটিয়া আলতাফ হোসেনকে কৌশলে হাতে নিয়ে তার ফ্যাক্টরির সব মালামাল নারায়ণগঞ্জের জনৈক শাহ আলমের ফ্যাক্টরিতে সরিয়েছেন। এ চক্রটি আমাকে ঘায়েল করতে বেশ কিছু মিথ্যা ও ভুয়া মামলা দিয়েছে।’ কাঞ্চন বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের এই শাহ আলমই রাজারবাগ দরবার শরীফের পীরের প্রতিনিধি ও অর্থের জোগানদাতা। সে মূলত জমি কেনা-বেচা করে এবং তার চাহিদামতো না হলেই মামলা ঠুকে দেয়। ফতুল্লায় অন্তত ৫০ জনের বিরুদ্ধে এ রকম মিথ্যা মামলা হয়েছে। কিন্তু কেউ ভয়ে মুখ খোলেন না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার পৈত্রিক সম্পত্তি যেগুলো আমার মা ও ভাই-বোনদের কাছ থেকে সাব-কবলা দলিল ও বায়না দলিলের মাধ্যমে দরবার শরীফ হাতিয়ে নিয়েছে, সেগুলো এই শাহ আলম সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই করা হয়েছে। দলিলগুলোতে সাক্ষী ও বায়নাকারী হিসেবে যারা রয়েছেন, তারা সবাই ওই দরবারের লোক। আর জমিগুলোর কেনা-বেচার মধ্যস্থতাকারী হলেন শাহ আলম। আমরা দুই ভাই জমি না দেওয়ায় আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে ঢোকায়। পরে জমির মূল্যের চেয়ে কম টাকা নিয়ে মধ্যস্থতা করতে চাপ দেয়।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মো. শাহ আলম তা অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি কোনো পীরের মুরিদ নয়। পীর সিন্ডিকেটের সঙ্গে আমার কোনো যোগসাজশ নেই। তবে একরামুল আহসান কাঞ্চনকে আমি চিনি। তার মায়ের সব সম্পত্তি কেনার জন্য আমি বায়না করি। কিন্তু কাঞ্চন সব সম্পত্তি নিয়ে একটি জাল দলিল করেন। সে জন্য তার মা একটি মামলা করেন, যে মামলায় প্রথম কাঞ্চন জেলে যান। পরে জাল দলিল বাতিল করা হয়। কিন্তু পুরো সম্পত্তি নিয়ে কাঞ্চনের মায়ের সঙ্গে বায়না হলেও পরে গ্যাঞ্জামের কারণে বায়না প্রত্যাহার করে নিই। আমার নামে কাঞ্চন মূলত বদনাম রটাচ্ছেন।’ তবে কলেজের শিক্ষক রাফির বাড়ি তার এলাকায় বলে স্বীকার করলেও তিনি তার ব্যবসায়িক পার্টনার নন বলে দাবি করেন শাহ আলম।

এদিকে মিথ্যা মামলার শিকার সহযোগী অধ্যাপক মোহা. বদরুল ইসলাম পুলিশ সদর দপ্তরে একটি আবেদন করেন। এর ভিত্তিতে তদন্ত করে ইন্সপেক্টর আকুলচন্দ্র বিশ্বাস প্রতিবেদন দাখিল করেন। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়Ñ মামলাটি মিথ্যা ও হয়রানিমূলক। মামলার সাক্ষীরাও টাকার বিনিময়ে সাক্ষী দেওয়ায় চুক্তিবদ্ধ। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মামলার সাক্ষী জরু মিয়া, শাহ আলম ও জামাল মিয়াকে ২০ হাজার করে টাকা দেওয়ার লোভ দেখিয়ে আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ানো হয়। পরে তাদের দেওয়া হয় ৪ হাজার করে টাকা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি চক্র সত্য গোপন করে আদালতে মামলাটি দাখিল করেছে বলে প্রতীয়মান হয়। এটি এখনো বিচারাধীন।

জানতে চাইলে সহযোগী অধ্যাপক বদরুল ইসলাম বলেন, ‘শিক্ষকতা ও গবেষণা ছাড়া আমার অন্য কোনো পেশা নেই। কলেজের ১০০ কোটি টাকার ফান্ড সিস্টেমেটিক লুটপাট শুরু করেন কলেজের কতিপয় শিক্ষক নামধারী সন্ত্রাসী এবং সাবেক গভর্নিং বডির কতিপয় কর্তাব্যক্তি। এই লুটপাটে বাধা দেওয়ায় তারা একটি মামলাবাজ সিন্ডিকেটকে দিয়ে সাজানো মামলায় আমাকে ফাঁসিয়েছে।’ সম্প্রতি আলোচনায় আসা রাজারবাগ দরবার শরীফের পীরের মামলা সিন্ডিকেটের প্রতি ইঙ্গিত করে এই শিক্ষক আরও বলেন, ‘এই সিন্ডিকেটটি যেন একটি বৈধ রাষ্ট্রের মধ্যে একটি অবৈধ রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। বিভিন্ন পেশাজীবী তাদের অপকর্ম ঢাকার জন্য বা কোনো নিরীহ মানুষের সম্পদ হাতিয়ে নেওয়ার জন্য ওই অবৈধ রাষ্ট্রকে ব্যবহার করছে। আর এই সিন্ডিকেটকে রক্ষা করার জন্য বৈধ রাষ্ট্রেরই বিভিন্ন উইংস কাজ করে যাচ্ছে।’

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com