জ্ঞান এমন একটি বিষয় যার সাথে মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া জড়িত থাকে যেখানে উপলব্ধি সংযোগ ও যুক্তির সমন্বয় থাকবে। অনেকে মনে করেন জ্ঞান হলো মানব মস্তিষ্কের কোনো কিছু বুঝতে পারার ক্ষমতা। দার্শনিক প্লেটো জ্ঞানের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে জ্ঞানের তিনটি স্তরের কথা বলেছেন। প্রথম স্তর : ইন্দ্রিয় দ্বারা আহৃত জ্ঞান। ইন্দ্রিয় দ্বারা আহৃত জ্ঞানকে প্লেটো জ্ঞানের সর্বনিম্ন স্তর বলে আখ্যায়িত করেছেন। তার মতে, এ স্তরের জ্ঞান প্রকৃত জ্ঞান নয়। যুক্তি হিসেবে প্লেটো বলেন, ইন্দ্রিয় প্রায় সময় আমাদের প্রতারিত করে। যদি শুধু একে ব্যক্তি মনের প্রত্যক্ষণ বলে ধরে নেয়া হয়, তা হলে জ্ঞানের সার্বজনীনতা ও গ্রহণযোগ্যতা ধ্বংস হয়। ফলে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য নষ্ট হয়। দ্বিতীয় স্তর : প্লেটো জ্ঞানের দ্বিতীয় স্তর বলতে মতামতের মাধ্যমে আহৃত জ্ঞানকে বুঝিয়েছেন। তার মতে, এ ধরনের জ্ঞানকেও সত্য বলে ধরে নেয়া যায় না। এর কারণ হিসেবে প্লেটো বলেন, ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির মতামত ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। মতামত হলো মূলত সামগ্রিক চিন্তার একটি অংশবিশেষ। প্লেটো তৃতীয় স্তরের জ্ঞানের প্রসঙ্গে বলেন, জ্ঞানের এমন কিছু উপকরণ রয়েছে যা মন দ্বারা সংযুক্ত ও সুসংহত হয়ে থাকে। এ সংযোগ ও সুসংহতির কাজটি করে প্রজ্ঞা বা যুক্তি। ফলে প্রজ্ঞা বা যুক্তির মাধ্যমেই প্রকৃত জ্ঞান লাভ করা যায়; যার ফলে দার্শনিক প্লেটো শিক্ষা দর্শনে বুদ্ধি ও যুক্তিকে সবার উপরে স্থান দিয়েছেন। তার মতে, বুদ্ধি ও যুক্তির মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞানই প্রকৃত জ্ঞান। প্লেটো যদিও জ্ঞানের একটি গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা দেন কিন্তু সব দার্শনিকের মধ্যে তার এ মতামত গ্রহণযোগ্য হয়নি। জ্ঞানের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে জ্ঞানতত্ত্ব নিয়ে যেসব দার্শনিক কাজ করেছেন তাদের মধ্যে এটি একটি দীর্ঘ দিনের বিতর্কের বিষয়। বলা হয় একটি বিবৃতি তখনই জ্ঞান বলে বিবেচিত হবে যখন এর তিনটি গুণ থাকবে। প্রথমত, এটি সমর্থনযোগ্য হতে হবে এবং সত্য ও বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। অনেক দার্শনিক মনে করেন এ তিনটি গুণ থাকলেই জ্ঞান স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে না। মার্কিন দার্শনিক রবার্ট নোজিক জ্ঞানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, জ্ঞান হলো তাই যা সত্য খুঁজে বের করে; অর্থাৎ এমন বিষয় জ্ঞান হিসেবে গণ্য হবে, যার ভেতর বাস্তব সত্যতা থাকবে। রিচার্ড কিরখাম বলেন, জ্ঞান হলো সত্য প্রকাশে বিশ্বাসের পক্ষে প্রমাণ থাকা। তার মতে, এমন একটি বিষয় জ্ঞান হিসেবে বিবেচিত হবে যেটি নিরেট সত্য হতে হবে এবং সেই সত্যের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনে যথেষ্ট যুক্তি থাকতে হবে। লুডউইগ উইটজেন্টেইন বলেন, জ্ঞান অনেকটা এ রকম, যেমন যখন কেউ বলতে পারেন ‘তিনি এটি বিশ্বাস করেন, কিন্তু এটি যাতে না হয়, তিনি তা জানেন।’ উইটজেন্টেইন যুক্তি হিসেবে বলেন, জ্ঞান মানসিক অবস্থার সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং এটি দৃঢ় অবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট। বক্তব্যের এ ভিন্নতা ব্যক্তির মানসিক অবস্থার সাথে সম্পর্কিত নয়, বরং ব্যক্তি যে কাজের সাথে যুক্ত তার সাথে সম্পর্কিত; অর্থাৎ এটি দৃঢ়বিশ্বাসের সাথে কথা বলার ধরন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষার স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, শিক্ষা মানুষের জীবনব্যাপী ক্রম-অবিচ্ছিন্ন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া যা জন্ম থেকে শুরু হয়, মৃত্যু পর্যন্ত চলতে থাকে। তিনি আরো বলেন, মনুষ্যত্বের শিক্ষাটাই চরম শিক্ষা আর সব তার অধীন। রবীন্দ্রনাথের উপরের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তিনিও শিক্ষা বলতে ইন্দ্রিয় গ্রাহ্যতাকে বুঝিয়েছেন; যার মাধ্যমে ব্যক্তির সৎ গুণাবলি বিকশিত হবে। প্লেটোর যোগ্য ছাত্র অ্যারিস্টটল বলেন, শিক্ষা হলো এমন একটি বিষয় যার শেকড়ের স্বাদ তেতো হলেও তার ফল মিষ্টি। এখানেও প্রজ্ঞা, যুক্তি ও ইন্দ্রিয় গ্রাহ্যতার মাধ্যমে আহৃত জ্ঞানকে বোঝানো হয়েছে; অর্থাৎ শিক্ষা অর্জন করতে হলে আগে একজন ব্যক্তির সব ইন্দ্রিয় সজাগ থাকতে হবে। ধর্মীয় দৃষ্টিতে জ্ঞানের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে জ্ঞানার্জন করতে হলে সত্যের অনুসন্ধান করতে হবে। ধর্মীয় দিক থেকে ইসলাম জ্ঞানবান ব্যক্তিদের বিশেষ সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছে। ইসলামী শরিয়াহর পণ্ডিতরাও সর্বদা লোকজনকে কুরআন ও হাদিসের বাইরেও জ্ঞানার্জনের প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে জ্ঞানের গুরুত্ব বোঝাতে বলা হয়েছে, ধর্ম ও নৈতিকতার শিক্ষা সন্তানের জন্য সবচেয়ে বড় সম্পদ। এতে স্পষ্ট বোঝা যায়, পবিত্র কুরআনেও জ্ঞান নিয়ে যা বলা হয়েছে তা হলো, ব্যক্তির মনুষ্যত্ব জাগ্রত করতে হবে। কারণ নীতি ও নৈতিকতার শিক্ষাই হলো সত্যিকারের জ্ঞান। পবিত্র কুরআনে জ্ঞান সম্পর্কে বলা হয়েছে। সূরা আলাকের ১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- ‘পাঠ করো, তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।’ ওই আয়াত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এখানেও জ্ঞানের অনুসন্ধানের কথা বলা হয়েছে। সৃষ্টিকর্তা একজন আছেন যিনি সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। তার নামে পাঠ করে তাকে স্মরণ করার কথা বলা হয়েছে। তার সৃষ্টিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করার কথা বলা হয়েছে। অন্য দিকে সূরা আন নাহলের ৪৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, যদি তোমরা না জানো তবে জ্ঞানীদের জিজ্ঞাসা করে জেনে নাও। ওই আয়াতের অর্থ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এখানেও জ্ঞানের অনুসন্ধান করে সত্যকে জানার কথা বলা হয়েছে। সেটি হতে হবে দৃঢ় আস্থা ও বিশ্বাসের সাথে। সূরা বাকারার ২৬৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হিকমত বা বিশেষ জ্ঞান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা (আল্লাহর পক্ষ থেকে) হিকমত দান করা হয়েছে, নিঃসন্দেহে তাকে প্রভূত কল্যাণ দেয়া হয়েছে।’ হজরত আলী রা: বলেন, ‘জ্ঞান’ অর্থ ও সম্পদের চেয়েও উত্তম। কেননা জ্ঞান তোমাকে পাহারা দেয়, অন্য দিকে অর্থ ও সম্পদকে উল্টো পাহারা দিতে হয়। জ্ঞান মানে হলো শাসক, অর্থ হলো শাসিত। অর্থ ব্যয় করলে নিঃশেষ হয়ে যায়। পক্ষান্তরে, জ্ঞান বিতরণ হলে আরো বৃদ্ধি পায়। (ইমাম গাজ্জালি, এহইয়াউ উলুম; ১/১৭৯৮) হজরত আবু দারদা রা: বলেন, জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে উপার্জিত হয়, যেমন ধৈর্যধারণের মাধ্যমে ধৈর্য অর্জিত হয়। যে ব্যক্তি কল্যাণের খোঁজে ব্যতিব্যস্ত হয় সে কল্যাণ লাভ করে। যে অকল্যাণ থেকে বাঁচার চেষ্টা করে সে অকল্যাণ থেকে রক্ষা পায় (কিতাবুল উলম;-২৮), প্লেটোর জ্ঞানতত্ত্ব যদি অন্যদের বক্তব্যের সাথে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয় তা হলে দেখা যাবে যে, ধর্মীয় দিক থেকে প্লেটোর জ্ঞানতত্ত্ব এক ও অভিন্ন। ধর্মীয়ভাবে জ্ঞান বলতে সত্যকে জানা ও তা গভীরভাবে উপলব্ধি করার কথা বলা হয়েছে। প্লেটোও একই মত দিয়েছেন। তিনি সত্যকে হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করার কথা বলেছেন।