দেশে যে আন্তঃআঞ্চলিক বা আন্তঃবিভাগীয় বৈষম্য বিরাজ করছে, তা নিয়ে দ্বিমত নেই বললেই চলে। এ বৈষম্য মূলত অর্থনৈতিক হলেও সব ক্ষেত্রেই এর প্রভাব পরিলক্ষিত।
আন্তঃআঞ্চলিক বা আন্তঃবিভাগীয় অর্থনৈতিক বৈষম্য দেশে উচ্চ দারিদ্র্যহারের অন্যতম একটি কারণ বলে মনে করা হয়। দেশের পূর্বাঞ্চলগুলোতে যখন দারিদ্র্য হার ১৬ থেকে ১৮ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ, তখন উত্তর-দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলগুলোতে দারিদ্র্যহার ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৪৭ দশমিক ২ শতাংশ (হাউসহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে ২০১৬)।
সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (জুন ২০১৫-জুন ২০২০) দেশের আঞ্চলিক বৈষম্য সমস্যা সমাধানের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয় এবং এজন্য কিছু কৌশল নির্ধারণ করা হয়। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও (জুন ২০২০-জুন ২০২৫) বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে এবং আন্তঃআঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাসে কিছু কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে। আন্তঃআঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাসে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার কৌশলগুলো কতটা সফলতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে তা পর্যালোচনা এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উল্লিখিত কৌশলাদি বাস্তবায়নে কী করণীয় তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বলা হয়, বিগত দশক থেকে গড়ে প্রায় ৬ শতাংশ হারে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হলেও যে প্রশ্নটি উঠে এসেছে তা হলো-সব জেলা সমভাবে লাভবান হয়েছে কিনা। বলা হয়, কেন্দ্রচ্যুতি বনাম সমকেন্দ্রিকতার বিশ্লেষণ থেকে এ ধারণা পাওয়া যায়-দীর্ঘসময় নিয়ে আঞ্চলিক বৈষম্য বেড়েছে। এ পরিকল্পনায় পশ্চাৎপদ অঞ্চলের বৈষম্য সমস্যার সমাধানে যেসব কৌশল নির্ধারণ করা হয়, সেগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো- ক. পশ্চাৎপদ অঞ্চল তহবিল গঠন, খ. অবকাঠামো ব্যবধান হ্রাস, গ. পশ্চাৎপদ জেলাগুলোতে ম্যানুফ্যাকচারিং সুবিধাবলি বৃদ্ধি, ঘ. কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণ এবং ঙ. আন্তর্জাতিক অভিবাসনের সুযোগ বৃদ্ধি।
সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বলা হয়, আঞ্চলিক বৈষম্য সমস্যার সমাধানমূলক বৃহত্তর অর্থনীতিতে পশ্চাৎপদ অঞ্চলগুলোর অধিকতর সুবিধাদান এবং কারিগরি শিক্ষায় গুরুত্বদানসহ অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) একটি পৃথক তহবিল সংরক্ষণ করতে হবে। এ তহবিল থেকে রংপুর, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশালের মতো এলাকাগুলো এ ধরনের বিনিয়োগের জন্য উপযুক্ত বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু সপ্তম পরিকল্পনা মেয়াদের এডিপিগুলোতে এমন পৃথক তহবিল সংরক্ষণ করা হয়েছে বলে জানা যায়নি। আঞ্চলিক বৈষম্য নিরসনে অগ্রগতি নিয়ে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা রয়েছে। এতেও পশ্চাৎপদ অঞ্চলগুলোর উন্নয়নে এডিপিতে পৃথক তহবিল সংরক্ষণের ব্যাপারে কোনো বক্তব্য নেই। উল্লেখ্য, দেশের পশ্চাৎপদ অঞ্চল বা বিভাগগুলোর মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে বৃহত্তর দিনাজপুর ও রংপুর নিয়ে গঠিত রংপুর বিভাগ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হাউসহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (হায়েস)-২০১৬ অনুযায়ী, সেখানে দারিদ্র্যের হার ৪৭ দশমিক ২ শতাংশ। ২০১০ সালের হায়েসেও সেখানে দারিদ্র্যের হার ছিল সবচেয়ে বেশি (৪২ দশমিক ৩ শতাংশ)। দেশের সবচেয়ে বেশি দরিদ্র ১০টি জেলার মধ্যে ছয়টি রংপুর বিভাগে অবস্থিত। সরকারি নীতিনির্ধারকরা অনেক সময় রংপুর অঞ্চল থেকে ‘মঙ্গা’ দূর করতে পেরে আত্মতৃপ্তি অনুভব করেন। কিন্তু রংপুর বিভাগ এখনো দেশের আট বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে দরিদ্র, আর এ বিভাগের আওতাধীন কুড়িগ্রাম দেশের দরিদ্রতম জেলা। হায়েস-২০১৬ অনুযায়ী, দারিদ্র্যের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ময়মনসিংহ বিভাগ। এখানে দারিদ্র্যের হার ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ। ২৮ দশমিক ৯ এবং ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ দারিদ্র্যহার নিয়ে যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে রাজশাহী বিভাগ ও খুলনা বিভাগ। ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ দারিদ্র্যহার নিয়ে বরিশাল বিভাগ রয়েছে পঞ্চম অবস্থানে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার নির্দেশনা মোতাবেক, এডিপিতে পৃথক তহবিল সংরক্ষণ করা হলে তা এসব পশ্চাৎপদ অঞ্চলের উন্নয়নে অধিকতর গতি সঞ্চার করত। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় স্বীকার করা হয়েছে, দারিদ্র্য নিরসনের অগ্রগতিতে আঞ্চলিক বৈষম্য রয়ে গেছে।
অবকাঠামো সুবিধার উন্নয়ন পশ্চাৎপদ অঞ্চল ও জেলাগুলোর অর্থনৈতিক সুযোগের দরজা খুলে দিতে পারে বলে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়। অবকাঠামো সুবিধার উন্নয়নে যেসব বিষয়ের ওপর এ পরিকল্পনায় জোর দেওয়া হয়, সেগুলো হলো-পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়নে অন্যতম প্রধান পরিবহণ প্রকল্প পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ ২০১৮ সালের গোড়ার দিকে সম্পূর্ণ করা, আন্তঃজেলা ও আন্তঃজেলা সড়ক পরিবহণ ব্যবস্থা উন্নত করা, মোংলা বন্দরের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা, বিদ্যুৎ সরবরাহ বৃদ্ধি করা এবং কৃষি ও মৎস্যপণ্য গুদামজাত করার সুযোগ বৃদ্ধি করা; যাতে কৃষক এ থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে পারেন।
সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নির্ধারিত মেয়াদে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ সম্পন্ন না হলেও এর কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক, মোংলা বন্দরের সর্বোচ্চ ব্যবহার এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অবকাঠামো ব্যবধান কমিয়ে আনার নির্দেশনা থাকলেও তা অনুসরণ করা হয়নি। ১২ বছর ধরে একটানা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ১০টি বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্প দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত করেছে। এগুলো মূলত সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলোতে অবস্থিত। এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন সামষ্টিক অর্থনীতির উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখলেও আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়াবে বৈ কমাবে না।
পশ্চাৎপদ জেলাগুলোয় ম্যানুফ্যাকচারিং সুবিধাবলি বৃদ্ধির নির্দেশনা ছিল সপ্তম পরিকল্পনায়। নির্দেশনায় বলা হয়, যেহেতু বেসরকারি উদ্যোক্তারা পশ্চাৎপদ জেলাগুলোতে বিনিয়োগে তেমন উৎসাহ বোধ করেন না, তাই অন্তত প্রাথমিক স্তরে এ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে সরকারকেই সহায়তার হাত প্রসারিত করে এগিয়ে আসতে হবে। নির্দেশনাগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো-কর সুবিধাদান, সুদের নিু হার ও অনুরূপ অন্যান্য নীতি হস্তক্ষেপের দ্বারা পশ্চাৎপদ জেলাগুলোয় বিনিয়োগে উৎসাহিত করা, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনে পশ্চাৎপদ অঞ্চলগুলোয় অগ্রাধিকার দেওয়া এবং স্বল্পব্যয়ে অর্থায়ন সুবিধাসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা মেয়াদে সরকার কর্তৃক প্রণীত একাধিক মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি-বিবৃতিতে (নীতি-বিবৃতি ২০১৬-১৭ থেকে ২০১৮-১৯ এবং ২০১৭-১৮ থেকে ২০১৯-২০) উপর্যুক্ত নির্দেশনাবলি বাস্তবায়নে তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণের উল্লেখ নেই। এসব বিষয়ে অগ্রগতির তথ্য অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও নেই।
পশ্চাৎপদ জেলাগুলোয় কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণের নির্দেশনা ছিল সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়। পরিকল্পনা মেয়াদকালে যেসব পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-পশ্চাৎপদ জেলাগুলোর গ্রামাঞ্চলে কৃষিঋণ বিতরণ ও কৃষি ভর্তুকি কর্মসূচিতে বিশেষ অগ্রাধিকার দান, দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকাগুলোয় ক্ষুদ্র অর্থায়ন সংস্থার কার্যাবলি পরিচালনায় উৎসাহ প্রদান, পরিবেশগতভাবে অরক্ষিত এলাকাগুলোয় ক্ষুদ্র অর্থায়নকে আকৃষ্ট করতে নীতিগত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং প্রশিক্ষণ ও অর্থায়ন সুবিধাদানের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া জেলাগুলোয় খামারবহির্ভূত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধিকরণ। পরিকল্পনা মেয়াদে সার্বিকভাবে কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণে গুরুত্ব প্রদান করা হলেও পশ্চাৎপদ অঞ্চল বা জেলাগুলোর জন্য উপর্যুক্ত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নে তেমন বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা নেই। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও এসব বিষয়ের অগ্রগতি সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি।
পশ্চাৎপদ জেলাগুলোর শ্রমিকদের অধিক হারে প্রবাসে কাজের জন্য প্রেরণ এবং সম্ভাব্য অভিবাসীদের অনুকূলে সুবিধা দিতে বিশেষ অর্থায়ন স্কিম বাস্তবায়নের যে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বলা হয়েছিল, তা বাস্তবায়নে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়েছে বলে জানা নেই।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বৈষম্যকে অঞ্চল ভিত্তিতে না দেখে জেলা ভিত্তিতে দেখা হয়েছে। দরিদ্রতম জেলাগুলোতে ‘দারিদ্র্য নির্মূল’ করতে যেসব কর্মকাণ্ডের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- ক. পিছিয়ে পড়া জেলাগুলোর স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অবকাঠামোগত চাহিদার উন্নতি বিধানে এডিপি ব্যয়ের ওপর আলোকপাত করা; খ. পিছিয়ে পড়া জেলাগুলোতে সামাজিক কর্মসূচিতে অগ্রাধিকার দেওয়া; গ. সেচ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলাবদ্ধতা এবং পিছিয়ে পড়া জেলাগুলোতে লবণাক্ততা চিহ্নিত করার জন্য বাংলাদেশ ডেল্টাপ্ল্যান ২০২১-এর প্রকল্প সম্পাদন পরিকল্পনাকে অগ্রাধিকার দেওয়া; ঘ. চর এলাকায় ঝুঁকি চিহ্নিতকরণে চর উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠা করা; ঙ. পিছিয়ে পড়া জেলাগুলোতে কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা; চ. পিছিয়ে পড়া জেলাগুলোতে ঋণগত, প্রযুক্তিগত ও বাজারজাতকরণ সেবাসহ সহযোগিতা কর্মসূচির মাধ্যমে গ্রামীণ অকৃষি খাতের প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করা; ছ. বৈদেশিক কর্মসংস্থানের খরচ মেটাতে নির্ভুল তথ্য, প্রশিক্ষণ ও ঋণ সরবরাহের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অভিবাসনে পিছিয়ে পড়া জেলাগুলোর অবস্থান উন্নতি করা; জ. পিছিয়ে পড়া জেলাগুলোতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুদান বৃদ্ধি এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শক্তিশালী করা।
তবে উপর্যুক্ত কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের সঙ্গে পিছিয়ে পড়া অঞ্চল বা জেলাগুলোতে টেকসই শিল্পায়নে গুরুত্ব দিতে হবে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় পশ্চাৎপদ অঞ্চল তহবিল গঠনের ওপর যে গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল, তা বাস্তবায়নে এগিয়ে আসতে হবে। দেশে উচ্চ দারিদ্র্যহার হ্রাসে আন্তঃআঞ্চলিক অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। দেশের সব অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মোটামুটি সমতা আনা গেলে তা জাতীয় ঐক্য বজায় রাখতেও সহায়ক হবে।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক