মরুর শহরে ক্রিকেট। সেখানেও দর্শক আবেগসিক্ত হবেন ক্রিকেট ঘিরে- এটি স্বাভাবিক। কিন্তু মাঝে মধ্যে আবেগ পাশে সরিয়ে রেখে ক্রিকেটকে একটু দেখা দরকার। না হলে বিপদ। আমাদের ক্রিকেট দর্শক থেকে ক্রিকেটকর্তা- সবাই আবেগে বুঁদ। তাই স্কটল্যান্ডের কাছে কেন হারল বাংলাদেশ, তা নিয়ে কত আলোচনা-সমালোচনা! আমরা সবাই ভুলে গিয়েছিলাম, ক্রিকেট খেলার আগে টস করার কয়েনেরও দুটি পিঠ থাকে। খেলাটায় জয়-পরাজয় থাকে। ক্রিকেট এমন কোনো খেলা নয় যে, সেখানে শুধু একটি দলই জিতবে। আর ওই দলটির নাম হবে ‘বাংলাদেশ’!
আবেগ দিয়ে চিন্তা করলে মন বলবে, বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দাবিদার। আর মস্তিষ্ক বলবে, ওই সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে এর অর্থ এই নয় যে, বাংলাদেশের কোনো সম্ভাবনাই নেই। ক্রিকেট পরিসংখ্যানবিদরা বলছেন, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ এ পর্যন্ত যত ম্যাচ জিতেছে, এর চেয়ে অনেক অ-নে-ক বেশি ম্যাচ হেরেছে! তাই পরিসংখ্যানবিদদের ভুল প্রমাণ করার জন্য বাংলাদেশকে শুধু ভালো ক্রিকেট খেলা নয়, অন্য রকম ব্র্যান্ডের ক্রিকেট খেলতে হবে। সেটি সুপার টুয়েলভের প্রথম ম্যাচ থেকেইÑ যাতে অন্যদের কাছ থেকে সম্ভ্রম আদায় করে নেওয়া যায়। অন্য দলগুলো বিশ্বাস করতে শুরু করে, বাংলাদেশের স্কটল্যান্ডের কাছে হার ‘অঘটন’ ছিল। আর এই বিশ্বকাপে তারা বড় ‘অঘটন’ই ঘটাতে পারে। ওই সামার্থ্য তাদের আছে। এ জন্য বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারদের বিশ্বাস করতে হবে, মরুর শহরগুলোয় তারা বেড়াতে আসেননি! সেটি প্রতিটি ম্যাচে নিজেদের পারফরম্যান্স দিয়েই বোঝাতে হবে। তবে তাদের ওই বিশ্বাসে ফাটল ধরানোর জন্য অনেক ক্রিকেট পর্যটককে পাবেন তারা। ড্রেসিংরুমে না পেলেও আশপাশে পাবেন। জুম মিটিংয়ে পাবেন। প্রতিপক্ষকে সামলানোর পাশাপাশি এই ক্রিকেট পর্যটকদেরও সামলাতে হবে তাদের। ওই কাজটা আরও কঠিন। প্রতিপক্ষের জন্য হাতের বল-ব্যাট তাদের বড় অস্ত্র। আর এই পর্যটকদের জন্য মুখ খোলা যাবে না। দরকার হবে শুধু পারফরম্যান্স নামক বাউন্সার।
পাপুয়া নিউগিনির বিপক্ষে ম্যাচ জিতে সুপার টুয়েলভে পৌঁছানোর পর বাংলাদেশের অধিনায়ক যা বলেছেন, এতে রাগ-ক্ষোভ-হতাশা অনেক কিছু আছে। আর আছে একটা চাহিদা। নিজেদের ড্রেসিংরুমের পরিবেশটা। ড্রেসিংরুম ও হোটেলটা শুধুই ক্রিকেটারদের থাকুক। টিমের ভেতরের পরিবেশটা খুব খোলামেলা থাকুক। রিল্যাক্সড মুডেই থাকতে চাইবেন তারা। প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতে উঠে এসে জোহানেসবার্গে ভারতের অধিনায়ক মাহেন্দ্র সিং ধোনি সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বলেছিলেন, ‘আমাদের টিমে খুব বেশি প্র্যাকটিস সেশন হয় না। মিটিং সেশন হয়। সেখানে আমরা একে অন্যের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলি। ওয়ান-টু-ওয়ান। আমার মনে হয়, ওই পদ্ধতিটা তুলনায় ভালো। ক্রিকেটারদের মিটিংরুমের ভেতরে বসিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে এত কাটাকাটির কথা দিয়ে স্ট্র্যাট্রেজি ঠিক করার কিছু নেই। ওটা করলে ক্রিকেটারদের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে।’ ধোনির এই ক্রিকেট দর্শন অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। কিন্তু লোকটা তার থিওরিতে সফল। অনেক সফল। তবে ধোনি বা অন্য কারও পরামর্শ শোনার কী আছে? বাংলাদেশে কি পরামর্শদাতার অভাব আছে! প্রতিটি ম্যাচ শেষেই তো কত পরামর্শ শুনতে পাওয়া যায় সংবাদমাধ্যমের সুবাদে।
হয়তো সাকিব আল হাসান দারুণ একটা কথা বলেছেন বিসিবি সভাপতির পরামর্শ নিয়ে- ‘পাপন ভাইয়ের কিছু সময় কাজে দেয়!’ কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, সাকিব আল হাসান পারফর্ম করলেই বাংলাদেশ জিতছে। ম্যান অব দ্য ম্যাচও তিনি হচ্ছেন। তাই প্রতিটি ম্যাচই বাংলাদেশের কাছে স্পেশাল। ক্রিকেটারদের কাছে স্পেশাল পারফরম্যান্স আশা করবেন দর্শক। টিম স্পোর্ট অনেক সময় ইন্ডিভিজুয়াল স্পোর্ট হয়ে যায়। সেখানে কারও একটা ১০ মিনিটের পারফরম্যান্সও খেলা ঘুরিয়ে দিতে পারে। ক্রিকেট টিম গেম তো বটেই। তবে ব্যক্তির পারফরম্যান্সও জরুরি। অভিজ্ঞতা আর তারুণ্যের মিশ্রণে গড়া বাংলাদেশ দল। এ দলের যে কেউ ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দিতে পারেন। হতে পারেন তিনি সাকিব আল হাসান, মাহমুদউল্লাহ, মুস্তাফিজুর রহমান, নাঈম শেখ কিংবা আফিফ হোসেনের মতো কোনো তরুণ। তবে এটা নিশ্চত, কোনো পরামর্শদাতা মাঠের ২২ গজে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিতে পারবেন না।
সাকিব আল হাসান বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডার। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ড। আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় ফেরিওয়ালা। কিন্তু তার ট্রফি ক্যাবিনেটে একটাও আইসিসি ট্রফি নেই। নিজেকে মোটিভেটেড করার জন্য এই দুঃখ আর আক্ষেপটাই বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াতে পারে। তিনিই এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার। অন্তত পারফরম্যান্স সেটিই বলছে। তার ক্যারিয়ার যদি কোনো ট্রফি ছাড়া শেষ হয়, তা হলে সময়ের ধুলায় চাপা পড়ে যাবে তার নামটাও! নিশ্চয়ই তার মতো বড় ক্রিকেটার তা চাইবেন না।
সাকিব প্রতিভাবান, সাহসী, আগ্রাসী ক্রিকেটার। আবার এই দলে ধীরস্থির অধিনায়কও আছেন। দলকে কেউ ছোট করতে চাইলে তিনি নিজের পারফরম্যান্স দিয়েই তার জবাব দিয়েছেন বারবার। তিনি গ্যালারি শো, অতিনাটকীয়তা বা আরোপিত অতিআগ্রাসনে বিশ্বাসী নন। তিনি লাফ-ঝাঁপ করেন না, ফালতু অনেক কিছুই দেখান না। তিনি নিজের পেশাকে অনাবশ্যক গ্লোরিফাই করায় বিশ্বাসী নন। তিনি নিজেকে অতিমানবীয় অভিধায় ভূষিত করতে তীব্র অনিচ্ছুক। তিনি স্থিতধী, ধ্যানমগ্ন। তিনি প্রবল একমুখিতা নিয়ে পাখির চোখটুকু দেখেন ২২ গজে তার ব্যাটের অগ্রভাগে। পেশাদার ‘ক্লিনিক্যাল’ দক্ষতায় দলকে জিতিয়েছেন বহু ম্যাচ। একটা অস্তিত্ব নিয়ে হঠাৎ করে টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দিতে পারেন। আবার নিজের ভেতরে প্রাণবায়ু পুরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে। তিনি এক ব্যতিক্রম চরিত্র। কিন্তু যোদ্ধা। তার জন্য দলটা ঘুরে দাঁড়িয়ে ক্রিকেট বিশ্বকে দেখিয়ে দেয়। দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড আর বিদেশের মাটিতে জিম্বাবুয়েকে হারানো কোনো অঘটন ছিল না। আসলে মাহমুদউল্লাহ একটা ক্ষত্রীয় চরিত্র। তিনি জানেন, হারলে দর্শকরা হতাশ হন। তিনি বেদনাবিদ্ধ ভক্তদের কথাটা ভাবেন। হয়তো মনে মনে বলেন, ‘পরের ম্যাচে হতাশ করব না।’
হতাশ হতে হয়, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের অনেকের কথায়। তাদের হাব-ভাব- তারা সব ম্যাচ কেন জিততে পারেন না! নিশ্চয়ই দলে গলদ আছে। এ কারণে তারা দলবেঁধে ওড়াল দেন ক্রিকেট দল বিদেশ গেলেই। যান ভালো কথা। কিন্তু দলটাকে তাদের মতো চলতে দিন। জিতলে কৃতিত্বটা আগে তাদের দিন। পরে নিজেরা নিন। প্রধানমন্ত্রীকে দিন, কোনো অসুবিধা নেই। তবে আমাদের ক্রিকেটারদের আপনার শ্রমিক স্তরে নামিয়ে ফেলবেন না নিজেদের কথাবার্তায়। ক্রিকেটাররা ব্যর্থ হবেন না, তেমন গ্যারান্টি কেউ দিতে পারেন না। স্যার ডন ব্র্যাডম্যানও ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংসে কোনো রান করতে পারেননি। এর অর্থ তিনি ব্যর্থ, কোনো মূর্খও এ কথা বলবেন না। তাই একটা-দুটো ম্যাচ হারলেই সব গেল, সব গেল কোরাস গাইবেন না।
ব্যর্থতার দায় শুধু ক্রিকেটারদের কাঁধে দেওয়ার একটা বদঅভ্যাস আছে আমাদের। আমরা ভুলে যাই এই দলে হেড কোচ আছেন। ব্যাটিং কোচ আছেন। স্পিন বোলিং কোচ আছেন। ফিল্ডিং কোচ আছেন। পেস বোলিং কোচ আছেন। ফুলটাইম ফিজিওথেরাপিস্ট আছেন। ফুলটাইম ম্যানেজারও আছেন। আবার আজকাল সব দলের সঙ্গে থাকা স্ট্রেন্থ ও কন্ডিশনিং কোচও আছেন। দায় তাদেরও আছে।
ভারত-শ্রীলংকা দলের মতো বাংলাদেশ দলে একজন মেন্টর রাখলে রাখা যেত। শ্রীলংকা দলে কাজ করছেন মাহেলা জয়াবর্ধনে আর ভারতীয় দলে মাহেন্দ্র সিং ধোনি। বাংলাদেশ দলের সঙ্গে কি থাকতে পারতেন না মাশরাফি বিন মতুর্জার মতো একজন সফল অধিনায়ক! তার থেকে ভালো মেন্টর বাংলাদেশ দলে আর কে হতে পারতেন? অবশ্য এতে একটা অসুবিধা হয়তো হতো। অন্য অনেক সাবেকের মতো তিনি সব কথায় মাথা নেড়ে সায় দিতেন না! তা ছাড়া ২০ ওভারের খেলায় মাশরাফির মতো একজন বাংলাদেশ দলের ড্রেসিংরুমে থাকলে এতে ক্ষতি কী হতো জানি না। লাভ বাংলাদেশ দলেরই হতো।
অঘোর মন্ডল : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম লেখক