আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম সাম্প্রদায়িকতার পরিবেশমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য। সেই লক্ষ্যে আমরা বিজয়ী হয়েছি। আজ ৫০ বছর পর দেখতে পাচ্ছি, দেশের অভ্যন্তরে সম্প্রদায়গত কোনো বিরোধ না থাকলেও প্রায়ই সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ চলছে। ভেঙে দেয়া হচ্ছে তাদের বসতভিটা, লুটে নেয়া হচ্ছে সহায়-সম্পদ, লণ্ডভণ্ড করা হচ্ছে পূজার মণ্ডপ/মন্দির, ভেঙে ফেলা হচ্ছে দেবতা-মূর্তি। এ বছর এই অপকর্ম শুরু হয়েছে কুমিল্লা থেকে। পর্যায়ক্রমে তা ছড়িয়ে পড়েছে কয়েকটি জেলার বিভিন্ন এলাকায়, বেশ কয়েকদিন ধরেই চলেছে। এই নারকীয় তাণ্ডবের পর আমাদের সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধিরা আহাজারি করছেন, প্রতিবাদে মিছিলের পর সংগঠিত জমায়েতে বক্তব্য রেখেছেন, মানববন্ধন করেছেন। দেশের মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের পাশাপাশি হিন্দুদের বিভিন্ন সংগঠনও প্রতিবাদী সভা-সমাবেশ করেছে। মাওলানা-মাশায়েখগণ, মাওলানাদের সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে, পীরদের কেউ কেউ প্রতিবাদী বক্তব্য দিয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলো এসব সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের আগে-পরে বা পাশাপাশি তাদের প্রতিবাদ মিছিল-সমাবেশ, মানববন্ধন করেছেন। প্রতিবাদে তারা মুসলিম জনগোষ্ঠীকে এর জন্য দায়ী করেননি বটে, দায়ী করেছেন চিহ্নিত কিছু মানুষকে যারা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান নামের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর চড়াও হয়। তারা যে ওই পরিচয়ের লোকদের ব্যক্তিগতভাবে শত্রু তা নয়, তাদের ভিন্ন মতলবই প্রকাশ ওই হিংস্র্র আচরণে। আর তা হলো- তাদের সহায়-সম্পদ দখল করা। যেহেতু তারা ‘রাজনৈতিক-কথনে চিহ্নিত সংখ্যালঘু’ তাই তাদের পক্ষে লড়তে সংখ্যাগুরু মুসলিমরা দাঁড়াবে না। এর চেয়েও আরো একটি কারণ বিদ্যমান। তা হলো- ওই সব অপরাধের হিরোদের বিরুদ্ধে আইন তেমনভাবে কার্যকর ভ‚মিকা রাখে না। যাকে আমরা বলছি বিচার প্রলম্বিত করা বা না করার প্রবণতা। ফলে সন্ত্রাসীরা ভয় পায় না। তারা নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই সন্ত্রাসী কারা। এককথায় এরা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা সন্ত্রাসী। অতীতের সব সাম্প্রদায়িক ঘটনার অপরাধ ও বর্তমান ঘটমান সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটানোর মুরব্বি হচ্ছে রাজনীতি। তার মানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করছে দেশের রাজনীতি। দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ কেবল সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি লালন-পালন করে না, তারা মিলেমিশে বাস করতেই শিখেছে পরিবার-পরিজন, সম্প্রদায় ও সমাজে নেতাদের কাছে থেকে। আজো গ্রামের মানুষ, সেই ঐতিহ্যিক চেতনা ও কর্মধারাই লালন করে না, তারা এটি রক্ষাও করে আসছে।
তাহলে এই যে মন্দির ভাঙা হলো দেশের বিভিন্ন এলাকায়, কারা সেটা করেছে? আমি হলফ করে বলব, এরা রাজনৈতিক সম্প্রদায়, যারা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সামাজিক বিরোধ ও ঘৃণা উৎপাদন করতে চায় এবং সংখ্যালঘুদের মনে ভয়ের চাষ করে কিছু আয় করতে চায়।
আমরা জানি, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ জন্মভ‚মিতেও ইনসিকিউরড ফিল করে। কারণ এই ইনসিকিউরিটির বীজ বপন করে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতির মধ্যে সন্দেহের বিষ ঢেলেছিল। কারণ তাতে তাদেরই পলিটিক্যাল গেইন বেশি। সেই ঔপনিবেশিক সাম্প্রদায়িক বিষ আমরা লালন করছি। আমরা হিন্দুকে হিন্দু হিসেবে, মুসলমানকে মুসলমান হিসেবে, বৌদ্ধকে বুদ্ধিস্ট হিসেবে, খ্রিষ্টানকে খ্রিষ্টান হিসেবে দেখতে/বুঝতে ও চিনতে শিখেছি… একটি বারও আমরা এদের ‘মানুষ’ হিসেবে চিনতে/জানতে/ বুঝতে শিখিনি। কারণ আমাদের ইনহ্যারিট করা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ব্রিটিশদের সৃষ্টি করা কালচারাল আধিপত্যের ধোঁয়াশায় ডুবে আছে। আমাদের রাজনৈতিক কালচার যেমন ব্রিটিশবাহিত, তেমনি আমাদের শিক্ষায়ও ওই ধারাই উপজাত হওয়ায় আমরা মানুষকে মানুষ ভাবতে শিখিনি। ব্রিটিশরা যেমন আমাদের শিখিয়েছে, আমরা সেই পথই অনুকরণ, অনুসরণ করছি। একবারও বলছি না বা ভাবছি না যে পথটা ভুল।
আশ্চর্যের বিষয় হলো- ব্রিটিশ উপনিবেশবাহিত চিন্তা রাজনৈতিক চরিত্রে অনুপ্রবেশ করলেও স্থানীয় জনগণের মধ্যে তার অনুপ্রবেশ ঘটেনি। এ জন্য বাংলাদেশের জনগণ (রাজনৈতিক জনগণ বাদে) অসাম্প্রদায়িক। যুগের পর যুগ, শতাব্দীকাল ধরে এ দুটি সম্প্রদায় পাশাপাশি বাস করেছে। কখনোই কোনোরকম সাম্প্রদায়িক দুর্ঘটনাও ঘটেনি। বরং উল্টোটাই ঘটেছে।
একটি ব্যক্তিগত ঘটনা জানাই। আমার ক্লাসফ্রেন্ড সেই ঢাকা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সুশীল রায়ের বিয়েতে যোগ দিয়েছিলাম আমি ও আরেক বন্ধু ফিরোজ সারোয়ার। একেবারে বরের সাথে বসে আমরা সেই বিয়ে উপভোগ করেছি। সাতপাকে বাঁধা পড়ার দৃশ্যও আমরা পাশে বসে দেখেছি। সুশীল ও তার বাবা-মা, ভাইবোনেরা আমাদের খুব ভালোভাবে জানত/চিনত। ওই বিয়ের অনুষ্ঠান ৮৫/৮৬ সালের। খুব বেশি কি পুরোনো? তখনো রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা ছিল দেশে, কিন্তু জনমনে তার প্রভাব তখনো ছিল না। আজো বিশ্বাস করি, জনগণের মধ্যে সম্প্রদায়গত বিরোধ ও ঘৃণা নেই।
এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পূজামণ্ডপে পবিত্র কুরআন শরিফ রেখে সাধারণ মানুষকে হিন্দুর বিরুদ্ধে উসকে কিছু একটা করার অপপ্রয়াস নিয়েছিল কোনো দুর্বৃত্ত মহল। দেশের অসম্প্রদায়িক মানুষ কিন্তু তাতে মাতেনি। কিন্তু সুযোগটা যারা সৃষ্টি করেছিল তারাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে মুসলমানদের নামে। ওই হামলাকারীরা মুসলিম, কিন্তু কর্মে শয়তান। শয়তান যখন চড়াও হয় মনে, তখন তারাই এর গতিপথ নির্ধারণ করে। কুমিল্লার পূজামণ্ডপের ঘটনা তাই পীরগঞ্জ পর্যন্ত যেতে যে কয়দিনই লাগুক না কেন, তাতে লক্ষ্য অর্জনে তো তারা সফল হলো।
বিষয়টি সাম্প্রদায়িক নয়, আমি কোনোভাবেই একে সাম্প্রদায়িক বলব না। এই ঘটনা ‘রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িক’ বলেই জনগণ নয়, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থাগুলো সোচ্চার হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে এই বলে প্রচারণা চালাচ্ছে যে, অন্য প্রতিপক্ষের লোকেরা এই দুষ্কর্ম করেছে। আর সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলো ওই অপরাজনীতির বিরুদ্ধে ভূমিকা রাখতে আহ্বান জানাচ্ছে। যারা মিছিল করে সাম্প্রদায়িক ঘটনার বিচার দাবি করছেন, তারা রাজনৈতিক জনগণ। সাধারণ মানুষ এতে নেই। কারণ সাধারণ মানুষ জানে, তার পাশের বাড়ির বা পাশের পাড়ার হিন্দুরা জানে, তারা কেউ ওই অপরাধকর্ম করেনি। তাই তারা ওইসব মিছিলে যায়নি। যাদের নিজেদের অসম্প্রদায়িক দেখানোর প্রয়োজন, তারাই মিছিল-সমাবেশ করে জানাচ্ছে যে, তারা অসাম্প্রদায়িক। জনগণের ওই সার্টিফিকেট প্রয়োজন নেই।
আমাদের রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এ ধরনের সাম্প্রদায়িক মনন-নেশা ও রাজনীতির অন্ধকার গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ঔপনিবেশিক ধারার কুৎসিত রাজনীতি পরিত্যাগ করতে হবে। ওই ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে নতুন রাজনৈতিক চেতনার পাটাতনের ওপর দাঁড়াতে হবে নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আদর্শগত বিরোধ থাকবে, কিন্তু তার বিধ্বংসী নীতি ও আদর্শ অবশ্যই পরিহার করতে হবে। রাজনৈতিক কালচারে উঠে আসতে হবে, বিভিন্ন রাজনীতিক তাদেরই সহযোদ্ধা, জনগণের কল্যাণে, তাদের সেবা দিতে দুই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার মানসিকতা অর্জন করতে হবে। সমালোচনা করার যুক্তি-বুদ্ধিকে সামাজিক ন্যায়ের প্রতি তুলে আনতে হবে। তাহলেই দোষারোপের রাজনীতির অবসান হবে। কেউ আর বলতে পারবে না যে, ওই ঘটনার ‘হোতারা অমুক’ জায়গায় মিটিং করে পরিকল্পনা করেছে। এই বস্তাপচা রাজনৈতিক দুরাচার যতদিন পর্যন্ত পরিত্যক্ত না হবে, ততদিন পর্যন্ত ‘জজ মিয়া ও ‘ইকবাল’ নাটকের অবসান হবে না।
রাজনীতিকরা দয়া করে জনগণের নামে নিজেদের করা অন্যায়-অবিচার ঢেকে না রেখে নিজেদের ‘অসততা ও রাজনৈতিক মিথ্যাচারের অবসান’ ঘটান। দলীয় সঙ্কীর্ণ স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিন। সেই সাথে, এটি তলিয়ে দেখতে বলি, কোনটা রাজনীতি আর কোনটা রাজনৈতিক কৌশল এবং কোনটা রাজনীতি আর কোনটা রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, মিথ্যাচার সেগুলো ঠাণ্ডা মাথায় বুঝতে হবে, বোঝার জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করতে হবে।
তা হলেই দেশে আর মন্দির, পূজামণ্ডপ ভাঙা বা হনুমানের মূর্তির পায়ে পবিত্র কুরআন রাখার আয়োজন হবে না, প্রয়োজন পড়বে না। আমরা আর কতকাল রাজনৈতিক মিথ্যাচার বহন করে বাঁচব?