রাজনৈতিক বিষয়াদি সারা দুনিয়ার মানুষের কাছেই মুখরোচক আলোচনার উপাদান। রাজনীতির খুঁটিনাটি ঘটনাও মানুষের আলোচনায় যেমন উষ্ণতা বাড়ায় তেমনি পক্ষ-বিপক্ষে মতামত প্রতিষ্ঠার খোরাক জোগায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটি ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। চায়ের দোকান থেকে শুরু করে আড্ডাখানা এমনকি ঘরের খাবার টেবিলে পর্যন্ত চলত রাজনৈতিক উষ্ণতার ছড়াছড়ি। যুক্তিতর্কে কিছু সময়ের জন্য বন্ধু, পরিবারের সদস্যরা এমনকি পিতা-পুত্রের মধ্যেও বিভক্তির রেখা দেখা দিত। আড্ডা, আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের মধ্যেই অপছন্দের রাজনৈতিক দলের পতন হতো, আবার পক্ষের রাজনৈতিক দলকে মসনদে বসানো হতো। সে দিনের রাজনৈতিক আড্ডা-আলোচনার মধ্যে প্রাণ ছিল, রসবোধ ছিল।
আজকে আমরা যাদেরকে দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান, ঝানু রাজনীতিবিদ বলি তারা একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আজকের অবস্থানে এসেছেন। তারা একটি কমিটমেন্টের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক আদর্শকে উজ্জীবিত করার লক্ষ্য নিয়ে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করে আন্দোলন, সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কিন্তু আজকের রাজনীতিতে কে কীভাবে যে সোনার কাঠি রূপার কাঠির পরশে বড় নেতা বা এমপি, মন্ত্রী হয়ে যাচ্ছেন তা বোঝার উপায় নেই। হঠাৎ করেই বড় রাজনীতিবিদের তকমা লাগিয়ে কোটিপতি বনে চলে যাওয়াও নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘটনা ঘাটলেই দেখা যায়, একেকজন দুর্নীতির মহা দানব। তাই আজকালের রাজনৈতিক আড্ডা-আলোচনায় প্রাণ নেই, রসবোধও নেই, আছে শুধু ভোগ সংলাপ। এখনকার রাজনৈতিক আড্ডা-আলোচনার বিষয়বস্তু হলো কোন মন্ত্রী, এমপির দুর্নীতির মাত্রা কত? কয়টা বাড়ি, কয়টা গাড়ি, কোন দেশে বাড়ি? আমেরিকা না কি কানাডায়? সিঙ্গাপুর না কি মালয়েশিয়ায় ইত্যাদি।
কতগুলো গুণাবলির সমন্বয়ে রাজনৈতিক ‘নেতৃত্ব’ শব্দটি সংহত। নেতৃত্বে পৌঁছাতে হলে অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম করতে হয়। সাধারণ কর্মী থেকে এই যাত্রা শুরু। আদর্শের কষ্টিপাথরে শুদ্ধ হয়ে সিঁড়ির একেক ধাপ পেরিয়ে অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা ও ব্যক্তিত্বের সমন্বয় ঘটিয়ে একেকজন রাজনৈতিক কর্মীকে নেতৃত্বের শীর্ষে পৌঁছতে হয়। এমনভাবে বেড়ে ওঠা নেতারাই দেশ ও জাতির উন্নয়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকেন। কিন্তু রাজনীতির আঁতুড় ঘরের বাইরে জন্ম নেয়া পারফিউম-কসমেটিকসের জোরে যারা নেতা বনে যান; তারা রাজনৈতিক পদ-পদবিকে ব্যবসায়িক পণ্যে রূপান্তর করে নিজেদের স্বার্থ হাসিলেই ব্যস্ত থাকেন। দেশ ও জাতির চিন্তা তাদের মাথায় থাকে না। কোনো আদর্শিক প্রক্রিয়া ছাড়াই এমপি, মন্ত্রী হওয়ার ‘ভেলকি’ দেখান ওই কসমেকিটস নেতারা।
রাজপথ পরিহার করে, আন্দোলন-সংগ্রামে না থেকে, জেল-জুলুমের শিকার না হয়ে, আদর্শ চর্চা না করে দামি পারফিউম, কসমেটিকস মেখে নিশিরাতে নেতার বাসায় হাজিরা দিয়ে ‘খাম’ বিনিময়ে কিংবা তেল, নুন, লাকড়ির ব্যবস্থা করে পদ-পদবি বাগিয়ে নেয়াটাই বেশি সুবিধার। তাই আজকাল আদর্শিক নেতার পরিবর্তে ব্যবসায়িক নেতারই জন্ম হচ্ছে বেশি। রাজনীতি চলে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের দখলে। আদর্শহীন ব্যক্তিদের রাজনৈতিক সংগঠনের শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত করলে অবৈধ রোজগারে টাকার ‘কুমির’ হওয়াদের কাছে পদ বিক্রি করে তারা যেমন আর্থিকভাবে লাভবান হন তেমনি ব্যবসায়িক নেতাদেরও সংসদ, মন্ত্রণালয়ে জায়গা পাওয়া সহজ হয়ে যায়। একসময় টাকাওয়ালা ব্যবসায়িক নেতাদের টাকার জোরে আদর্শবান রাজনৈতিক নেতারা নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন।
রাজনীতির এই পট-পরিবর্তন আদর্শিক রাজনৈতিক নেতার পরিবর্তে তোষামোদি নেতার জন্ম দিচ্ছে। এই তোষামোদি নেতারা আবার মাঠের ঘাম ঝরানো কর্মীর পরিবর্তে টাকার বিনিময়ে সন্ত্রাসী বাহিনী লালন করে রাজনৈতিক কর্মীদের দমন করার চেষ্টা করেন। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অবৈধ দখল, ঘুষবাণিজ্য, লুটতরাজ করে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া এই নেতাদের কাছে আদর্শিক নেতারা খুবই অসহায়। ফলে এই দেশের বরেণ্য রাজনৈতিক নেতাদের ইতিহাস চাপা পড়ে যাচ্ছে আজকালকের এই তোষামোদে নেতাদের অনাদর্শিক কর্মকাণ্ডের কারণে। রাজনীতি আজ ব্যবসাখানায় পরিণত হয়েছে। নিলামে তোলা হচ্ছে পদ-পদবি। লাখ লাখ টাকা খরচ করে পদ কেনার লোকেরও অভাব হয় না। ঘাম না ঝরিয়ে সারা দিন ব্যবসায় করে টাকা কামিয়ে কসমেটিকস মেখে চেহারা সুন্দর করে রাতের আঁধারে দামি হোটেল রেস্তোরাঁ বা নেতার আড্ডাখানায় হাজির হয়ে শীর্ষ পদ বাগিয়ে নিয়ে নামের সাথে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বিশেষণ যোগ করে ব্যবসায় করাটাও বেশ মজার। সবাই সম্মানও করে, আবার জি হুজুর করার লোকেরও অভাব হয় না। সবই কসমেটিকস, পারফিউম আর টাকার খেলা। এই প্রক্রিয়ায় সামরিক-বেসামরিক আমলারও বড় বা শীর্ষ রাজনীতিবিদ হতে পারছেন। রাজনীতির এই রুগ্ণ দশায় আদর্শ চলে যাচ্ছে জাদুঘরে আর রাজনৈতিক নেতৃত্ব চলে যাচ্ছে অনাদর্শিক ব্যবসায়ীদের হাতে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, যারা কায়দা করে নানা ফন্দিফিকিরের মাধ্যমে রাজনীতিতে ঢুকে পড়ছেন তারাও জানেন, রাজনীতি তাদের জন্য নিরাপদ চারণভূমি নয়। তাই যতক্ষণ সময় পাওয়া যায়, ততক্ষণ সব লুটেপুটে খেয়ে নিচ্ছেন তারা। তাদের এই ভোগ উৎসবের উচ্ছিষ্ট অংশই সমাজের বাকি অংশের কপালে জুটছে। এটাই এখনকার রাজনীতির বাস্তবতা।
এই ভারত উপমহাদেশে অনেক প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতার জন্ম হয়েছে। যারা দেশ ও মানুষের কল্যাণের জন্যই রাজনীতি করেছেন। ভোগ-বিলাসিতা তাদের আদর্শকে স্পর্শ করতে পারেনি। বাংলা ভূমে জন্ম নেয়া শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক যিনি বাংলার বাঘ নামে খ্যাত। তিনি কৃষক-প্রজাদরদি নেতা ছিলেন। ব্রিটিশ ভারতের কৃষকদের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার জন্য তিনি ব্যাপক কাজ করেছেন। ঋণ সালিসি বোর্ড গঠন করে কৃষকদের ঋণ মওকুফ করেছেন। তার প্রস্তাবিত ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনের মধ্য দিয়ে ভারত-পাকিস্তান নামক দুটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যাকে কি না গণতন্ত্রের মানসপুত্র নামে ডাকা হতো। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী যাকে মজলুম জননেতায় ভূষিত করা হয়েছিল। দিনমজুর, শ্রমিক, গরিব অসহায় মানুষের অধিকার রক্ষা করার জন্য তিনি সারাটি জীবন আন্দোলন করে গেছেন। তারা একেকজন রাজনৈতিক আদর্শের লালন ও পালনকর্তা ছিলেন। তাদের রাজনৈতিক আদর্শ চর্চা ও কর্মের ইতিহাস বর্ণাঢ্য ও চকচকে। দেশ ও মানুষই ছিল তাদের রাজনীতির উপাদ্য।
আজকাল তরুণরা রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে উঠছে কিন্তু তারা আদর্শহীন রাজনীতিতে দীক্ষিত হচ্ছে। তারা রাজনৈতিক নেতার পরিবর্তে রাজনৈতিক ক্যাডার নামে চিহ্নিত হচ্ছে। রাজনৈতিক দলের আদর্শ বাস্তবায়ন না করে কোনো বিশেষ নেতার লোকে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু এই তরুণরাই যদি শতভাগ দলীয় আদর্শে প্রভাবিত হতে পারত তাহলে দেশ ও জাতির কল্যাণে তারা কাজ করতে পারত। তরুণদের শপথ যদি এমন হতো, আমাদের আত্ম পরিচয় নির্মাণের সাথে সাথে পুনর্নির্মাণ করতে হবে ধ্বংসপ্রাপ্ত রাজনৈতিক মূল্যবোধগুলো। রাজনীতির নষ্ট চরিত্রের ব্যক্তিদের পরিহার করে লুটেরা সমাজের প্রভাবকে বিনাশ করার লক্ষ্যে সব তরুণকে সততা ও ঐক্যের রাজনীতিতে অটুট হতে হবে। আজকে যারা রাজনীতির দীক্ষা নিচ্ছেন তাদের মূল স্পিরিটই হতে হবে ‘ন্যায়ভিত্তিক সমাজ’ প্রতিষ্ঠা। কারণ লুটেরা সংস্কৃতিনির্ভর তোষামোদের রাজনীতি, কসমেটিকস-পারফিউম মেখে এবং আদর্শহীন রাজনীতি দিয়ে দেশ ও জাতির আকাক্সক্ষা বাস্তবায়িত হবে না।
মনে রাখতে হবে, রাজনীতিতে নষ্ট চরিত্রের লোকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় নানা কৌশলে, প্রতারণায় এমনকি প্রকাশ্যে সমাজের মধ্যে দুর্বৃত্তায়ন সৃষ্টি করে চলেছে। যার কারণে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়েছে আর দুর্বৃত্তদের শক্তির পরীক্ষা-নিরীক্ষা বৃদ্ধি পেয়েছে। সমাজ ও রাষ্ট্রে বিভাজন সৃষ্টিকারী এই ব্যবসায়িক রাজনীতিকরা প্রকৃত অর্থেই গণতন্ত্রের শত্রু এবং তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার চিত্র খুবই ভয়াবহ ও উদ্বেগজনক। লোভী মানসিকতার কারণে রাজনীতি, গণতন্ত্র এবং রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধের অবক্ষয় হলেও কসমেটিকস মাখা রাজনীতিকরা এটিকে স্বাভাবিকই মনে করছেন। তাই তরুণ প্রজন্মের যারা রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে উঠছে তাদের রাষ্ট্র ও সমাজ বিনির্মাণের স্বার্থে আদর্শবাদী রাজনীতির চর্চা করা উচিত।