গত ৯ নভেম্বর (মঙ্গলবার) সব ক’টি জাতীয় দৈনিকের প্রধান খবর ছিল পরিবহন ভাড়া নিয়ে। কয়েকটি পত্রিকার শিরোনাম ছিল – ‘বলির পাঁঠা সাধারণ মানুষ’, ‘বাড়তি ভাড়ায় নৈরাজ্য ক্ষুব্ধ যাত্রীরা’, ‘বাসভাড়ায় নৈরাজ্য’, ‘নতুন বাসভাড়ায় পুরনো নৈরাজ্য’, ‘ভাড়া নিয়ে বচসা শুরুতেই’, ‘চলছে নৈরাজ্য’, ‘ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য’ ইত্যাদি। গত ৪ নভেম্বর জ্বালানি তেলের (ডিজেলের) দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়া হয়। এর প্রতিবাদে পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেয় মালিক সমিতি। ৭ নভেম্বর পরিবহন ভাড়া বাড়ানো হয়। ডিজেলের দাম বাড়ানো হয় ২৩ শতাংশ, আর ভাড়া বাড়ানো হয় ২৭ শতাংশ (গড়ে)। ৫২ সিটের দূরপাল্লার বাসের ভাড়া ১ দশমিক ৪২ থেকে ২৭ শতাংশ, দূরপাল্লার ৪০ সিট ১ দশমিক ৮৫ থেকে ২৬ দশমিক ৪৮, নগর পরিবহন ১ দশমিক ৭০ থেকে ৬ দশমিক ৫ আর নগর পরিবহন মিনিবাসের ভাড়া ১ দশমিক ৬০ থেকে ২৮ দশমিক ১২ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। তবে সরকারের নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে দ্বিগুণ, কোথাওবা তিনগুণ পর্যন্ত ভাড়া আদায় হচ্ছে। অতীতেও একই বাস্তবতা দেখা গেছে। সরকার যে পরিমাণ ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়, তার চেয়ে দ্বিগুণ বা তিনগুণ ভাড়া আদায় করা হয় যাত্রীসাধারণের কাছ থেকে। শুধু বাস-ট্রাকের ভাড়াই বাড়ানো হয়নি, বেড়েছে নৌযানের ভাড়াও। আর সেই সাথে বেড়েছে সিএনপি চালিত অটোরিকশা এমনকি রিকশা ভাড়াও।
ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির পর পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধির সরাসরি চাপটি পড়ল জনসাধারণের ওপর। বিশেষ করে নিম্ন-মধ্যবিত্তের ওপর। এক দিকে অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হচ্ছে, অন্য দিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আরেক দফা বেড়েছে। নানা জন নানা কথা বলছেন। কেউ বলছেন, পরিবহন ভাড়া বাড়ানোর জন্য ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে, কেউবা বলছেন সরকার জনগণের সাথে রসিকতা করছে। সরকার আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য বৃদ্ধির দোহাই দিয়ে জ্বালানি তেলের (ডিজেলের) দাম বাড়াল। অর্থনীতিবিদরা জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সরকার আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ালেও আন্তর্জাতিক বাজারের চিত্রটা ভিন্ন।
গত ১ নভেম্বর আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দামের চিত্রটা হলো – ভেনিজুয়েলায় প্রতি লিটার তেলের দাম বাংলাদেশী মুদ্রায় এক টাকারও কম। ইরানে প্রতি লিটার বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় এক টাকা। সৌদি আরবে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম প্রায় ১১ টাকা, সিরিয়ায় ১৩ টাকা, আলজেরিয়ায় ১৮ টাকা, এঙ্গোলায় ১৯ টাকা, কুয়েতে ৩২ টাকা, তুর্কমেনিস্তানে ৩৩ টাকা, ইথিওপিয়ায় ৩৩ টাকা, বাহরাইনে ৩৬ টাকা, মালয়েশিয়ায় ৪৪ টাকা, শ্রীলঙ্কায় ৪৭ টাকা, কাতারে ৪৮ টাকা, নাইজেরিয়ায় ৫৩ টাকা, সুদানে ৫৬ টাকা, রাশিয়ায় ৬০ টাকা, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৬৫ টাকা, আফগানিস্তানে ৬৫ টাকা, মিয়ানমারে ৬৭ টাকা, ইন্দোনেশিয়ায় ৬৮ টাকা, ভিয়েতনামে ৭১ টাকা আর তুরস্কে ৭৩ টাকা। বাংলাদেশে জ্বালানি তেল মূলত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে আসে। বিশেষ করে কুয়েত থেকেই বেশি তেল আমদানি করা হয়। আর কুয়েতের তেলের দামের চিত্রটা তো তুলে ধরাই হলো। বর্তমানে জ্বালানি তেলের অভ্যন্তরীণ চাহিদা প্রায় ৫০ লাখ টনের কিছু বেশি। বিপিসি থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে অপরিশোধিত তেল আমদানি হয়েছিল সাড়ে ১১ লাখ টনের কিছু বেশি, আর পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি হয়েছিল ৩৮ লাখ ৭৩ হাজার ১৩২ টন। আমদানি মূল্য ছিল (সিঅ্যান্ডএফ) পেট্রল প্রতি লিটার ৭৮ টাকা ৭৮ পয়সা, অকটেন ৮১ টাকা ৮ পয়সা, জেটফুয়েল ৬২ টাকা ৩৮ পয়সা, কেরোসিন ৬০ টাকা ৭৬ পয়সা আর ডিজেল ৫৯ টাকা ৭১ পয়সা। আর সেসব দেশেই সবচেয়ে কম মূল্যে জ্বালানি তেল রফতানি করা হয় বা হচ্ছে।
পরিবহন ভাড়ার বৃদ্ধির সাথে সাথেই পণ্যের বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ল। হু হু করে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয়, বিশেষ করে ভোগ্যপণ্যের দাম। চাল, ডাল, তেল, মাছ-গোশত, তরিতরকারি, শাকসবজিসহ যাবতীয় ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। এক কেজি সরু চালের দাম ৬৮ থেকে ৭২ টাকা, মোটা চাল ৫৬ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে গত ৯ নভেম্বর রাজধানীর বাজারে। কোভিড-১৯ এর প্রভাবে দেশে পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করে। সেই থেকে দামের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত রয়েছে। দফায় দফায় ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। মূল্যস্ফীতির গতি এখন আর সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলছে। গত সেপ্টেম্বর মাসে দেখাল যে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতি ৬ থেকে বেড়ে ৬ দশমিক ১৯ শতাংশে দাঁড়ায়। একই সময়ে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ২১ শতাংশ, যা আগের মাসে ছিল ৫ দশমিক ১৬ শতাংশ। বিবিএসের তথ্য মতে, গ্রামাঞ্চলে একই সময়ের ব্যবধানে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬৭ থেকে বেড়ে হয় ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ। জ্বালানি তেল, গ্যাস, পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়বে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। অন্য দিকে দারিদ্র্যের হারও বাড়ছে। করোনার নেতিবাচক প্রভাবে বাংলাদেশে নতুন করে প্রায় এক কোটি লোক নতুন করে দারিদ্র্যের তালিকায় উঠে এসেছে বলে বিশ্বব্যাংক গত এক বছর আগেই বলেছে। অন্য দিকে বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে গ্রামাঞ্চলে সার্বিক দারিদ্র্য ছিল ২৬ দশমিক ৪ শতাংশ, যা ২০২০ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫ দশমিক ৩ শতাংশে। অথচ মাথাপিছু ব্যয় বেড়েই চলছে। কোভিড-১৯ শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে বিভিন্ন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান যেসব জরিপ চালিয়েছে, সেগুলোর ফলাফলে পাওয়া চিত্রটা খুব একটি ইতিবাচক নয়। বিভিন্ন জরিপে বলা হয়, কোভিডের মধ্যে বেকারত্ব বেড়েছে, বেড়েছে দারিদ্র্য আর কমেছে আয়। এ সময়ে দৈনিক সোয়া পাঁচ কোটি মানুষের দৈনিক আয় দুই ডলারের নিচে নেমে আসে। এ দিকে সরকারি প্রতিষ্ঠান বিবিএসের জরিপে বলা হয়, করোনায় সারা দেশে মানুষের আয় কমেছে ২০ শতাংশ। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জরিপে বলা হয়, তৈরী পোশাক, চামড়া, নির্মাণশিল্প ও চা-শিল্প এই চার খাতে ৮০ শতাংশ শ্রমিকের মজুরি কমেছে। একই সময়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের জরিপে বলা হয়, করোনায় দেশের ৫০ শতাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠানই ৭৬ শতাংশের ওপরে শ্রমিক ছাঁটাই করেছে।
২০২০ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাকের যৌথ জরিপে বলা হয়, গত ২০১৯ সালে আড়াই কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। বাড়ছে মাথাপিছু ব্যয়। মাথাপিছু আয়ের হিসেবে পাওয়া গেলেও ব্যয়ের কোনো হিসাব নেই সরকারিভাবে। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে ব্যয়ের পরিমাণ বেড়েই চলছে। অন্য দিকে কমছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। আমরা মাথাপিছু আয়ের কথা বলি, কিন্তু আমরা কি খবর রাখি যে, আমাদের মাথাপিছু বিদেশী ঋণ কত? আজ যে শিশুটি জন্ম নেবে, তার মাথার ওপর ঋণ দাঁড়াবে প্রায় ৪০ হাজার টাকা আর মাথাপিছু বিদেশী ঋণ প্রায় ২৫ হাজার টাকা। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কনজিউমারস অ্যাসোনিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) গত ২০২০ সালের জরিপে বলেছিল, দেশে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ এবং বিভিন্ন পণ্য ও সেবা-সার্ভিসের মূল্য বেড়েছে ৬ দশমিক ৩১ শতাংশ। এখন তো আর সেখানে স্থির নেই। ব্যয়ের মাত্রা বেড়েই চলছে। আয়-ব্যয়ের ব্যবধানটা বেড়েই চলেছে। সেই সাথে নিত্যপণ্যের দাম ক্রমাগত বৃদ্ধির ফলে নিম্ন-মধ্যবিত্ত তথা দরিদ্র মানুষের ওপর চাপ বাড়ছে। শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিই নয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যয় বাড়ছে। এক কথায় বলতে গেলে, নিম্ন-মধ্যবিত্ত গরিব মানুষ ক্রমেই চাপের মুখে পড়ছে।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার এবং পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট