বৈশ্বিক করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সারা দুনিয়ার শিক্ষাব্যবস্থায় অনেকটাই স্থবিরতা চলছিল। সারাবিশ্বের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো, বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের পাশাপাশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাও বারবার পিছিয়েছে। বর্তমানে ধাপে ধাপে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলছে। আর ইতোমধ্যেই দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা শুরুও হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে ৫১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। তবে নতুন তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়নি। ৫১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয় ৩৯টিতে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় হলে ভর্তিচ্ছুক শিক্ষার্থীদের রীতিমতো যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হয়। প্রায় তিন মাসেরও অধিক সময় ধরে অবিরাম ছুটতে হয় দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। দেখা গেছে, শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা হলে শনিবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা, আবার পরের দিন অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে। এমনো হয়েছে একইদিনে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা। এতে করে পরীক্ষার্থীদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ ও কষ্ট পোহাতে হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পরীক্ষা হওয়ার ফলে একজন শিক্ষার্থীর সময়, শ্রম, অর্থ ও মানসিক দুশ্চিন্তার পারদ প্রসারিত হতে থাকে। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জেলা পর্যায়েও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছুক শিক্ষার্থীর প্রায় ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ শিক্ষার্থী মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য অর্থের বিষয়টি অবশ্যই তাদের ভাবনায় রাখতে হয়। আবার কিছু শিক্ষার্থী আবেদন করেও যাতায়াত ও পরীক্ষাস্থলে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থার কথা চিন্তা করে পরীক্ষায় অংশগ্রহণই করেন না। এতে করে স্বভাবতই তারা ভর্তি পরীক্ষার প্রতিযোগিতায় কিছুটা পিছিয়ে থাকছেন। গত ১০ থেকে ১৫ বছরে দেশে অনেকগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বতন্ত্রভাবে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার ফলে শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ দিন দিন বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
গুচ্ছভুক্ত হয়ে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যুগান্তকারী এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ কমানোর জন্য এ বছর শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অক্লান্ত চেষ্টার ফলে অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছভুক্ত হয়ে পরীক্ষা নিতে একমত পোষণ করে। যদিও এ পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়ার জন্য বেশ কয়েক বছর ধরেই আলোচনা হয়ে আসছিল। শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ থেকে কিছুটা পরিত্রাণের জন্য এ বছর প্রথমবারের মতো ২০টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সফলভাবে গুচ্ছ ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষা নেয়।
গুচ্ছভুক্ত ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি ধাপে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। বিজ্ঞান বিভাগে ১৭ অক্টোবর, মানবিক বিভাগে ২৪ অক্টোবর এবং বাণিজ্য বিভাগে ১ নভেম্বর। পরীক্ষার কেন্দ্র হয় ২৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। একজন শিক্ষার্থী শুধু একটি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ থাকে। তবে তার যোগ্যতা অনুযায়ী ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনোটিতে ভর্তির সুযোগ পাবেন। গুচ্ছভুক্ত ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৩ হাজার আসনের বিপরীতে ৩ লাখ ৬১ হাজার ৪০৬ জন পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রায় তিন লাখ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছেন।
গত শিক্ষাবর্ষে কৃষি ও কৃষিতে প্রাধান্য থাকা সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় সফলভাবে গুচ্ছভুক্ত হয়ে ভর্তি পরীক্ষা নিয়েছে। দ্বিতীয়বারের মতো এবারও শিক্ষার্থীদের কষ্ট লাঘবে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কৃষি সংক্রান্ত কিছু বিষয়), চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় এবং খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ ভিতিত্তে পরীক্ষা নিতে যাচ্ছে। আগামী ২৭ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় সাতটিতে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।
এ ছাড়া প্রথমবারের মতো গুচ্ছভুক্ত হয়ে তিনটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট), রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট) এবং খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) ভর্তি পরীক্ষা নিতে যাচ্ছে। ১৩ নভেম্বর পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
গুচ্ছ ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষার ফলে পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে সঙ্গে তাদের অভিভাবকদেরও দুর্ভোগ ও মানসিক কষ্ট অনেকাংশে কমে আসবে। শিক্ষার্থীরা তাদের বিভাগীয় জেলার বিশ্ববিদ্যালয়েই পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাবেন। কেন্দ্রীভূত পরীক্ষা থেকে বিকেন্দ্রীকরণের ফলে শিক্ষার্থীদের সময় ও অর্থের অপচয় কমে আসবে। শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে হলেও গুচ্ছভুক্ত পরীক্ষা পদ্ধতি ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখা উচিত হবে। প্রত্যাশা করা যায়, আগামী বছর থেকে আরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছভুক্ত হয়ে ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করবে এবং শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের চাওয়াকেই প্রাধান্য দেবে।
বাবুল হোসেন : গবেষক ও জনসংযোগ কর্মকর্তা, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা