আগেকার দিনে উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তানরা রাজনীতিতে আসতেন। কোনো নিু-মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে রাজনীতির খাতায় নাম লেখালে বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন হায়-হায় করে বুক চাপড়াতেন। সে সময়ের বাবা-মায়েরা জানতেন, রাজনীতি মানে নিজের খেয়ে পরের ঘরে বাতি জ্বালানো।
রাজনীতি মানে, গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে বেড়ানো, গরিব-দুঃখীর সঙ্গে এক ফ্লোরে বসে খাওয়া। রাজনীতি মানে, কার ছেলে মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশ করে আর কলেজে পড়ার টাকা পাচ্ছে না, কার মেয়ের বিয়ের টাকা জোগাড় হচ্ছে না, ঝড়ে কার ঘর পড়ে গেছে-এসব দেখে দশজন মানুষ জোগাড় করে তাদের সাহায্য করা।
বাবা-মায়েরা এসব দেখে ভাবতেন, মনে করেছিলাম ছেলে লেখাপড়া শিখে পাশ-টাশ দিয়ে একটা চাকরি করবে, নয়তো ব্যবসায় নামবে যাতে দুটো পয়সা আসে আর সংসারের হাল ধরতে পারে। তা না করে ছেলে রাজনীতি করা শুরু করেছে!
তবু তাদের একটা অহঙ্কারের জায়গা ছিল এই যে, প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, দেশ আর সমাজের মানুষের কাছ থেকে তাদের হবু নেতা সন্তানরা বিপুল সম্মান পেতেন। রাজনীতি করে এ কথা তারা যেমন বুক চিতিয়ে বলতে পারতেন, তেমনি সাধারণ মানুষও রাজনীতিকদের অন্তর থেকে দোয়া করত। শহর থেকে তারা গ্রামের বাড়িতে গেলে পাড়া-প্রতিবেশী দেখা করতে আসত; দেশ-জাতির নানা সংকট প্রসঙ্গে খবর জানতে চাইত আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীরা।
জনসেবা করতে করতে জীবনের বেশিরভাগ সময় চলে গেলে ভাগ্যক্রমে একবার এমপি বা মিনিস্টার হতে পারলে এলাকার জন্য তখন কাজ করার সুযোগ হতো। তখন মানুষের অঢেল সম্মান আর অঢেল ভালোবাসা পেতেন তারা। রাজনীতি করার মূল লক্ষ্যই ছিল ওটা।
তখনকার দিনে রাজনীতিকরা দেখতেন প্রশাসন জনগণের স্বার্থে কাজ করে কিনা। তারা ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক বা মুরব্বি। প্রশাসনও তখন রাজনীতিককে শ্রদ্ধার চোখে দেখত, কিছুটা ভয়ও পেত।
কারণ, রাজনীতি ভুল করত না, ভুল ধরত। অল্প দামের পোশাক পরে মঞ্চে উঠে চেয়ারে বসলে গগনবিদারী চিৎকার উঠত-আমার ভাই, তোমার ভাই, অমুক ভাই! অমুক ভাই! এরকম ‘আমার ভাই, তোমার ভাই’ স্লোগান শোনার আশায় আর ভবিষ্যতের এক বৃহৎ সামাজিক দায়িত্ব বা কর্তৃত্ব অর্জনের নেশায় পেয়ে বসলে ছাত্ররা রাজনীতির খাতায় নাম লেখাত। সেই নেশা কিশোর বয়সে প্রেম করার নেশার মতো ছিল।
প্রেমিকাকে মনের মতো উপহার কিনে দিতে হবে, কিছু নেওয়া চলবে না! আত্মত্যাগ না করলে প্রেম হয়? প্রেমিকা ছিল দেশ এবং জাতি। অর্থ, প্রতিপত্তি, ভালো ব্যবসা, ভালো চাকরির হাতছানি বিসর্জন দিয়ে রাজনীতি করতেন সে সময়ের ছাত্রনেতারা। যারা অপেক্ষাকৃত অসচ্ছল পরিবারের সন্তান, তারা গায়ে খেটে, শ্রম দিয়ে সংগঠনের জন্য আত্মত্যাগ করতেন। রাতভর পোস্টার সাঁটিয়ে, দিনভর মিছিলে থেকে পুষিয়ে দিতেন; তারপর একদিন নেতা।
রাজনীতি করে ছেলেমেয়ে গোল্লায় যায়, এমন ধারণা তখন প্রচলিত ছিল না। মেধাবী ছাত্ররা আসত রাজনীতিতে। বিভাগের সেরা সেরা ছাত্রদের রাজনীতির আসরে দেখে সেই সমাবেশ সম্পর্কে একটা উচ্চ ধারণা তৈরি হতো সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। ছাত্রনেতারা যেমন মিছিল করত, বক্তৃতা দিত, তেমনি আবার বইয়ের ভেতরে ডুবে থাকত।
বক্তৃতার মসলা জোগাড়ের জন্য, অনুসারীদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য প্রচুর পড়াশোনার দরকার হতো। ইতিহাস, ভূগোল, দর্শন সবই জানতে হতো তাদের। এভাবে তাদের নিজেদের যোগ্যতা, সাহস আর পরিচিতির ক্ষেত্র বাড়িয়ে চাকরির পরীক্ষায়ও ছাত্র রাজনীতিকরা ভালো করতে পারতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল সংসদের বা কেন্দ্রীয় সংসদের ভিপি, জিএস এবং অন্যান্য পদাধিকারী ছাত্রনেতারা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে ভালো ভালো চাকরি পেয়ে যেতেন। তখন তারা স্নাতক ডিগ্রিটা পকেটে করে রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়ে কর্মজগতে প্রবেশ করতেন।
আগেকার দিনে রাজনীতিরও একটা আলাদা ক্যারিয়ার পথ ছিল। যারা ছাত্র রাজনীতিতে ভালো করে কোনো নিয়মতান্ত্রিক সরকারি চাকরিতে না গিয়ে রাজনীতিবান্ধব পেশায় থাকতেন এবং রাজনীতিকেই ধরে রাখতেন, তাদের জন্য ওপরে ওঠার সুযোগ ছিল। বাইরে থেকে নবাগতরা এসে রাজনীতিতে ভালো করতে পারত না। ছাত্রনেতারাই কালক্রমে জাতীয় নেতায় পরিণত হতেন। সেই ধারা গেছে পালটে।
এখন নানা পেশার লোক মাঝপথে এসে রাজনীতিতে সদ্য যোগ দিয়ে নানা পদে মনোনয়ন পেয়ে ছাত্রনেতাদের টপকে যাচ্ছেন। ফলে ছাত্র রাজনীতিতে এক হতাশা বিরাজমান। এভাবে দুই দিক দিয়েই জাতির জন্য ক্ষতি। একদিকে আমলাতন্ত্রের নিরপেক্ষ অবস্থানে চিড় ধরছে, অন্যদিকে রাজনীতির ধারাবাহিকতার জায়গায় ছাত্র রাজনীতি নিজের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে পারছে না। এ হতাশা কাটবে কবে, আদৌ কি কাটবে? এ দেশে একবার যা হারায়, তা আর ফিরে আসে না।
গাজী মিজানুর রহমান : লেখক ও সাবেক সিভিল সার্ভেন্ট