ই-কমার্স হচ্ছে বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে পণ্য কেনাবেচার জনপ্রিয় ও প্রয়োজনীয় মাধ্যম। মূলত এটি হলো অনলাইনে ব্যবসার প্লাটফরম, যেখানে বাজারে বা মার্কেটে না গিয়ে ই-কমার্সের মাধ্যমে পণ্য বেচাকেনা হয়। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান তার পণ্য অর্ডার অনুযায়ী মানুষের ঘরে পৌঁছে দেয়। তাদের নির্দিষ্ট সফটওয়ার থাকে। ওই সফটওয়ারের সাহায্যে গ্রাহক ঘরে বসে অনলাইনের মাধ্যমে নির্ধারিত পণ্যের ক্রয় আদেশ দেন এবং পণ্যের নির্ধারিত মূল্য পরিশোধ করেন। ক্রয় আদেশ পাওয়ার পর ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান তার প্রতিনিধির মাধ্যমে পণ্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠান অথবা বিভিন্ন দোকান থেকে তা ক্রয় করে গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেয়। এ হচ্ছে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের প্রক্রিয়া।
তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি সহায়ক বিভিন্ন গতিপথ সৃষ্টি হয়েছে। ই-কমার্স সে ধরনের একটি নতুন গতিপথ।
বিশ্বে অনলাইনে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় সর্বপ্রথম শুরু হয় ১৯৭১ সালে। সময়ের সাথে সাথে তার কলেবর কেবল বেড়েছে। ছোট পরিসরে শুরু হওয়া এই ই-কমার্স আজ এক বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই আজ অনেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ক্রমান্বয়ে ই-কমার্সের ওপর মানুষের নির্ভরতা বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের আমাজন, চীনের আলিবাবা আর ভারতের ফ্লিপকার্ট বিখ্যাত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। ১৯৯৫ সালে জেফ বোজেস যুক্তরাষ্ট্রে আমাজন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৯ সালে জ্যাক মা চীনে আলিবাবা এবং ২০০৭ সালে শচীন বানশাল ও বিন্নী বানশাল ভারতে ফ্লিপকার্ট প্রতিষ্ঠা করেন। এসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের ব্যবসার পরিধি দিন দিন কেবলই বেড়েছে এবং তারা আজ নিজ দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। একেবারেই ছোট্ট পরিসরে শুরু হওয়া ই-কমার্সের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী লেনদেনের পরিমাণ এখন কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার, ২০২১ সালে যার পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ডলার।
এমএলএম প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমও মূলত পণ্য বিক্রির সাথে সংশ্লিষ্ট। এমএলএম মানে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং। এই সিস্টেমে পিরামিড আকৃতির মার্কেটিং টিম গড়ে তোলা হয়। একজন ব্যক্তির আন্ডারে যত বেশি যখন লোক মার্কেটিং করে পণ্য বিক্রি করবে ততই ব্যক্তিটির পজিশন বড় হবে এবং তিনি প্রত্যেক ব্যক্তির বিক্রীত পণ্য থেকে কমিশন বাবদ অর্থ পাবেন। আবার কিছু কিছু এমএলএম কোম্পানি অধিক হারে মুনাফা প্রদানের অঙ্গীকারে জনগণ থেকে সরাসরি আমানত গ্রহণ করে। এমএলএম কোম্পানি জানায়, তারা জনগণ থেকে সংগৃহীত অর্থ বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ করে এবং তার মুনাফা থেকেই জনগণকে অধিক মুনাফা দেয়। প্রথম দিকে যারা এসব এমএলএম কোম্পানিতে টাকা জমা রাখে, কোম্পানি তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মুনাফা দেয়। ফলে এমএলএম কোম্পানির সুনাম ছড়িয়ে পড়ে এবং মানুষ তাদের কাছে বেশি বেশি টাকা জমা করতে থাকে। এক সময় কোম্পানির কর্মকর্তারা পালিয়ে যায় আর জনগণ টাকা হারিয়ে প্রতারিত হয়।
যুবক, ডেসটিনি, ইফনিপে-টু, এহসান গ্রুপ ফিরোজপুর ইত্যাদি এ ধরনের এমএলএম কোম্পানির কয়েকটি যারা এভাবে জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করেছে।
ই-কমার্স এবং এমএলএম সিস্টেম আধুনিক অর্থনীতিরই অংশ। বিশেষ করে ই-কমার্স আজকের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত। কারণ ই-কমার্স সময় বাঁচায়, ঝামেলা কমায়। জীবনকে করে সহজ এবং গতিময়। তাই এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ নয় বরং বিকশিত করতে হবে।
জনগণ না দেখেই পণ্য কেনে। এজন্য দেশে ই-কমার্স এবং এমএলএম কোম্পানির সুষ্ঠু বিকাশ এবং জনগণের স্বার্থ রক্ষার স্বার্থে সরকারকে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা এবং আইন প্রণয়ন করতে হবে। অর্থাৎ আইনের আওতায় এদেরকে ব্যবসা করতে হবে। পাশাপাশি জনগণকে ও সচেতন হতে হবে এবং অধিক মুনাফা অর্জন করে দ্রুত ধনী হওয়ার প্রবণতা ছাড়তে হবে। ই-কমার্স এবং এমএলএম কোম্পানিকে ব্যবসা পরিচালনার জন্য সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হবে। তাদেরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জামানত হিসাবে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা করতে হবে। যেমনটা করে থাকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। লোভনীয় এবং চটকদার বিজ্ঞাপন দেয়া যাবে না।
এমন নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে, যাতে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান পণ্য বিক্রির বিপরীতে কোনো অবস্থায়ই প্রতারণার আশ্রয় নিতে না পারে। বাজারদরের চেয়ে অনেক কম দামে কিভাবে পণ্য বিক্রি করবে তার ব্যাখ্যাও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানকে দিতে হবে। একইভাবে এমএলএম কোম্পানিগুলো যাতে দেশে বিদ্যমান মুনাফার চেয়ে অনেক বেশি মুনাফা দিতে না পারে এমন নীতিমালা থাকতে হবে। জনগণের টাকা এমএলএম কোম্পানি কোথায় এবং কোনো খাতে বিনিয়োগ করবে তার বিস্তারিত বিবরণ জানাতে বাধ্য থাকবে। ই-কমার্স এবং এমএলএম কোম্পানির অডিট প্রতি বছর যথাযথভাবে করতে হবে এবং আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে। অর্থাৎ স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া কেউ অন্যায় করলে তার জন্য শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক : প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক