শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৫৭ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
কলকাতায় বাংলাদেশি কনস্যুলেট ঘেরাওয়ের চেষ্টা, সংঘর্ষে আহত পুলিশ চলমান অস্থিরতার পেছনে ‘উদ্দেশ্যমূলক ইন্ধন’ দেখছে সেনাবাহিনী জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে যারাই যাবে, তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে : জামায়াত আমির বিচারপতিকে ডিম ছুড়ে মারার ঘটনায় প্রধান বিচারপতির উদ্বেগ ইসরাইলের বিরুদ্ধে জয় ঘোষণা হিজবুল্লাহর বাংলাদেশ ইস্যুতে মোদির সাথে কথা বলেছেন জয়শঙ্কর ইসকন ইস্যুতে কঠোর অবস্থানে সরকার : হাইকোর্টকে রাষ্ট্রপক্ষ আইনজীবী সাইফুল হত্যা : সরাসরি জড়িত ৮, শনাক্ত ১৩ র‍্যাবের সাবেক ২ কর্মকর্তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজিরের নির্দেশ ছেলেসহ খালাস পেলেন বিএনপি নেতা খন্দকার মোশাররফ

বছরে বিদেশে পাচার হাজার কোটি টাকা

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : শনিবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২১
  • ১৮৭ বার

অনলাইন জুয়া ও অশ্লীল ভিডিও চ্যাটের সূত্র ধরে বছরে হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এই বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে মূলত জুয়া ও ভিডিও চ্যাটের ৬টি অ্যাপসে তরুণ-তরুণীদের আসক্ত করার মাধ্যমে। টাকা পাচার হচ্ছে হুন্ডি কিংবা ভার্চুয়াল মুদ্রার মাধ্যমে। অধিক লোভ ও লাভের আশায় ব্যবসায়ী, প্রবাসী থেকে শুরু করে স্থানীয় ছাত্রনেতারাও অনৈতিক এই ব্যবসায় জড়িয়েছেন। ভিডিও চ্যাটে আগ্রহী করে তুলতে অ্যাপসগুলোয় হোস্ট হচ্ছেন শোবিজ জগতের নামী-দামি তারকাও। এদিকে অনলাইন জুয়ার ১৭ গডফাদারের লেনদেনের তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্বল নজরদারির কারণে অর্থ পাচার হচ্ছে।

সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের অতিরিক্ত ডিআইজি কামরুল আহসান আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমরা অনেকগুলো অনলাইন জুয়ার সাইট খুঁজে পেয়েছি। এর মধ্যে ছয়টি সাইট বাংলাদেশে খুবই পরিচিত, যারা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এর মধ্যে মাত্র ৫ থেকে ১০ শতাংশ টাকা এখানকার এজেন্টরা পায়। বাকিটা চলে যায় দেশের বাইরে। এ ক্ষেত্রে কিছু ই-ওয়ালেটের দুর্বলতা খুঁজে পেয়েছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে মিটিং হয়েছে। আমরা দুর্বলতাগুলো খুঁজে টাকা পাচার ও জুয়া বন্ধ করতে সমন্বিতভাবে কাজ করছি।’

সিআইডি কর্মকর্তারা বলছেন, জুয়ার জন্য জনপ্রিয় হলো ‘ওয়ানএক্সবেট’, ‘বেট৩৬৫’ ও ‘বাইবেট’। ভিডিও চ্যাট ও জুয়ার জন্য জনপ্রিয় ‘স্ট্রিমকার’। এসব অ্যাপসের মাধ্যমে জুয়া ও ভিডিও চ্যাটে অংশ নেওয়া অধিকাংশই যুবক ও প্রবাসী। টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বেশ কয়েকটি ধাপ আছে। একাউন্ট খোলার পর এজেন্সির কাছ থেকে ভার্চুয়াল মুদ্রা কেনেন জুয়াড়িরা। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমে ভার্চুয়াল মুদ্রার অর্থ পরিশোধ করা হয়। ভার্চুয়াল মুদ্রার মধ্যে জনপ্রিয় হলো- বিনস ও জেমস। ভার্চুয়াল মুদ্রার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের জুয়ায় অংশ নেওয়া যায়। সাধারণত জনপ্রিয় খেলার সময় জুয়ার পরিমাণ বেড়ে যায়। এছাড়া অশ্লীল ভিডিও চ্যাটের জন্য স্থানীয় এজেন্টরা টাকার বিনিময়ে হোস্ট নিয়োগ দেয়। হোস্টদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তাকে বিনস ও জেমস কিনে হোস্টদের উপহার দিতে হয়। এদের বলা হয় ‘গিফটার’। হোস্টদের জমা হওয়া ‘গিফট’ মাস শেষে টাকায় রূপান্তর করে দেয় এজেন্টরা। হোস্টরা প্রতি চার লাখ বিনসের জন্য এজেন্সির কাছ থেকে ৩ হাজার ৬৯০ টাকা পান।

একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, অনলাইন জুয়ায় অল্প টাকা বিনিয়োগে বেশি টাকা আয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তরুণ সমাজকে আকৃষ্ট করা হচ্ছে। স্থানীয়ভাবে এসব সাইট বন্ধ করলেও ভিপিএন-এর সাহায্যে খোলা হয়। শুধু চুয়াডাঙ্গা জেলায় জুয়ার টাকা লেনদেনের ৫০ জন মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট পাওয়া গেছে। এসব এজেন্টের ১৫টির প্রত্যেকটিতে দিনে ১০ লাখের ওপরে টাকা লেনদেন করছে জুয়াড়ি চক্র। দিনে এই জেলায় ‘ওয়ানএক্সবেট’ নামে জুয়ার সাইটে প্রায় দুই কোটি টাকা লেনদেন হয়। মেহেরপুরে এই অ্যাপসের মাধ্যমে প্রতিদিনের লেনদেন গড়ে ৫ কোটি টাকা। ‘স্ট্রিমকার’ অ্যাপসের একজন এজেন্টের ব্যাংক একাউন্টেই ৩০ কোটি টাকা লেনদেনের প্রমাণ পেয়েছে সিআইডি। এভাবে প্রতি বছর জুয়া ও ভিডিও চ্যাট অ্যাপসের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে।

টাকা পাচারের পদ্ধতি হিসেবে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এজেন্টরা জুয়াড়িদের কাছ থেকে নগদ টাকা নেয়। সেটা ডলার কিংবা ভার্চুয়াল মুদ্রায় রূপান্তর করে বিদেশে অ্যাপস মালিকের কাছে পাঠায়। এরপর বাজিতে হারলে কমিশন রেখে মুদ্রা দেশের বাইরে চলে যায়। বাজিতে জিতলে জুয়াড়িকে নগদ টাকা সরবরাহ করা হয়। আর টাকার লেনদেন হয় হুন্ডির মাধ্যমে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে কম আসছে এবং হুন্ডির মাধ্যমেও দেশ থেকে টাকা বিদেশে পাঠানো হচ্ছে।

‘ওয়ানএক্সবেটে’ নিবন্ধন করলে একটি ইউজার নেম ও পাসওয়ার্ড দেওয়া হয়। এরপর ই-মেইল ভেরিফিকেশনের পর মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অ্যাকাউন্টে টাকা ডিপোজিট করে ‘ওয়ানএক্সবেটে’ ক্রিকেট, ফুটবলসহ অন্তত ৫০টির বেশি খেলায় বাজি ধরা যায়। লাইভ ক্যাসিনো, পোকারসহ বিভিন্ন ধরনের জুয়ার আসর বসে এই সাইটে। অনলাইনে জুয়া ও অশ্লীল ভিডিও চ্যাটের ফাঁদে ফেলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া চক্রের হোতাদের মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের এক নেতা, ব্যবসায়ী, প্রবাসী ও বিদেশি নাগরিকসহ শতাধিক ব্যক্তি। অ্যাপে সুন্দরী তরুণী ও শোবিজ তারকাদের নিয়ে লাইভ স্ট্রিম, লাইভ চ্যাট ও লাইভ ভিডিওতে আড্ডার লোভ দেখিয়ে জুয়ার ফাঁদে ফেলে চক্রগুলো। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এই অ্যাপের অন্তত ১৪ জন এজেন্টের সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। তার মধ্যে ৫ ‘টপার এজেন্টকে’ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নিষিদ্ধ এই অ্যাপে হোস্ট হয়ে কাজ করার অভিযোগ উঠেছে ঢালিউডের প্রায় ৩০ শোবিজ তারকার বিরুদ্ধে।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, ‘স্ট্রিমকার’ অ্যাপসের মূল মালিক হংকংয়ের ডেস্টার। মালিকের কাছ থেকে আমাদের দেশে টপার এজেন্ট নিয়েছে এমন ১৪ জনের সন্ধান মিলেছে। টপার এজেন্টরা অ্যাপস মালিকের কাছ থেকে ডলারসহ বিভিন্ন বিদেশি মুদ্রার মাধ্যমে ভার্র্চুয়াল মুদ্রা বিনস ও জেমস কেনে। হুন্ডি ও ব্যাংকের মাধ্যমে তারা এসব মুদ্রার দাম অ্যাপস মালিকের কাছে পাঠায়। এজেন্টরা ইউজারদের কাছে (অ্যাপস ব্যবহারকারী) এক হাজার ২০ টাকায় এক লাখ বিনস এবং ৬০০ টাকায় এক লাখ জেমস বিক্রি করে। বিনস ও জেমস দিয়ে ব্যবহারকারীরা তারকা ও তরুণীদের সঙ্গে লাইভ চ্যাট করে। তারকা ও খোলামেলা তরুণীদের সঙ্গে আড্ডায় বেশি পরিমাণে বিনস ও জেমস দিতে হয়। এই ভার্চুয়াল মুদ্রা দিয়েই অ্যাপসে জুয়া খেলা হয়। বিভিন্ন খেলায় হাজার হাজার টাকার বাজি ধরে জুয়াড়িরা।

সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাহমুদুল তালুকদার আমাদের সময়কে বলেন, ‘মোস্ট বেট’ ও ‘ওয়ান এক্সবেট’ জুয়ার সাইটের এজেন্টদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া ‘বেট৩৬৫’ জুয়ার সাইটসহ কয়েকটি জুয়ার সাইট সিআইডির নজরদারিতে আছে। জুয়ার ১৭ গডফাদারের হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে চাওয়া হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। এছাড়া স্ট্রিমকার, বিগো লাইকির মতো অ্যাপস ভিডিও চ্যাটিং ও জুয়ার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া ৫ টপার এজেন্টের মধ্যে ব্ল্যাকরোজ এজেন্সির মালিক জমিরউদ্দিন, স্বপ্ন এজেন্সির মালিক কামরুল হোসেন রুবেল, একটি এজেন্সির দেখভালের দায়িত্বে থাকা অনামিকা সরকারকে সম্প্রতি রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এসব টপার এজেন্ট তাদের হোস্ট হিসাবে নায়ক-নায়িকাসহ বিভিন্ন শোবিজ তারকাদের ব্যবহার করতেন। নাম উঠে এসেছে চিত্রনায়ক ওমর সানিরও।

এ ব্যাপারে ওমর সানি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘করোনায় সময় কাটানোর জন্য স্ট্রিমকার অ্যাপসে আড়াই মাস হোস্ট ছিলাম। আমাদের নিজস্ব কোনো এজেন্সি নেই। তবে মৌসুমী এটা কখনোই হোস্টিং করেনি। অবৈধ জানার পর তিনি হোস্টিং ছেড়ে দেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা না বুঝে হোস্টিং করেছি। কিন্তু যারা জেনে বুঝে এ দেশে এজেন্সি এনেছে এবং দেশের টাকা বিদেশে পাচার করেছে, তাদের শাস্তি হোক।’

সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা আমাদের সময়কে বলেন, ‘প্রধানত হুন্ডি করে এজেন্টরা টাকাগুলো অ্যাপস কোম্পানির কাছে পাঠায়, যা অর্থপাচার আইনে দ-ণীয় অপরাধ। এছাড়া ক্যাশবাবা, আপনার টাকা, আল-করিম টেলিকমসহ বেশ কয়েকটি মাধ্যমে টাকা পাচার করা হয়। এগুলো মনিটরিং করে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো। সিআইডিও তদন্ত করে।’ কিন্তু আমরা কেন ডিজিটাল মানিলন্ডারিং বন্ধ করতে পারছি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের কেন্দ্রীয়ভাবে উন্নত প্রযুক্তিগত পদ্ধতি নেই, যেখানে অস্বাভাবিক লেনদেন মনিটর করতে পারবে। বাংলাদেশ ব্যাংকে যেটা আছে, সেটা অনেক পুরনো। আমাদের কেন্দ্রীয় গেটওয়েতে একটা জাতীয় পরিচয় (এনআইডি) ও ব্যাংকের তথ্যসহ উন্নত প্রযুক্তির মেশিন লার্নিং সফটওয়্যার বসাতে হবে, যাতে কোনো অস্বাভাবিক লেনদেন হলে স্বয়ংক্রিয় বার্তা আসে। এরপর এনবিআরসহ অন্যান্য সংস্থা তদন্ত করে দেখবে।’

পুলিশ জানিয়েছে, ঢাকার সাভার থানার মজিদপুর থেকে গত ১৭ মে এন্টি টেররিজম ইউনিটের একটি দল ‘স্ট্রিমকার’ সাইটের ব্ল্যাকরোজ টপার এজেন্সির মালিক জমির উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে। পরে তার তথ্যের ভিত্তিতে কামরুল হোসেন রুবেল, মঞ্জুরুল ইসলাম হৃদয়, অনামিকা সরকার ও মাসুদুর রহমান খানকে গ্রেপ্তার করে। তাদের মোবাইল ও কম্পিউটার হার্ডডিস্ক পরীক্ষা করে দেখা যায় স্ট্রিমকার অ্যাপস ব্যবহার করে তারা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। পরে সিলেটের গোয়াইনঘাট থেকে ফরিদ উদ্দিন ও নিধিরাম দাসকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের ব্যাংক একাউন্ট তদন্ত করে দেখা গেছে ২০২০ সালের মাঝামাঝি থেকে তারা প্রায় ৩০ কোটি টাকা লেনদেন করেছে। তাদের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অন্যতম হোতা সিলেটের গোয়াইনঘাটের শুক্কুর আলী। অন্যদিকে মঞ্জুরুল ইসলাম এভারগ্রিন টপার এজেন্সির মালিক।

নিউজটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2019 bangladeshdailyonline.com
Theme Dwonload From ThemesBazar.Com