যশোর শিক্ষা বোর্ডের সম্মেলন কক্ষে এইচএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি সভা চলছিল। বিভিন্ন জেলা থেকে কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এসেছেন। আগাগোড়াই পরীক্ষার আগে এমন সভার রেওয়াজ শিক্ষা বোর্ডগুলোর। কিছু নির্দেশনা, সতর্কতা ও শুভেচ্ছার মোড়কে এমন অনুষ্ঠান বারবার শেষ হতে দেখেছি। এবার একটা ভিন্নতার স্বাদ অনুভব করলাম। প্রেক্ষিত, ঝুঁকি ও সময়ের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অসাধারণ বক্তৃতা করলেন। ব্যবস্থাপনায় সক্রিয় অংশীদারত্বের উদার আহ্বান জানালেন।
সত্যিই তো, কয়েক মাস আগেও মনে হয়নি এসএসসি অথবা এইচএসসি পরীক্ষা সশরীরে অনুষ্ঠিত হবে। কর্তাব্যক্তিদের কর্থাবার্তায় ও আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি ধরা পড়েছিল। আগেভাগেই বলে রেখেছিলেন-পরীক্ষা অনুষ্ঠান সম্ভব না হলে বিকল্প পথে হাঁটতে হবে। স্কুল-কলেজ খোলা নিয়েও এমনই আভাস ছিল। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার ভাবনাও ছিল। অনিশ্চয়তার পাহাড় মাথায় নিয়ে দেশ আবার শিক্ষায় ফিরেছিল।
বিশ্বের অনেক দেশ তখনো সংশয়ের ঘোর কাটাতে পারেনি। আমাদের স্কুল-কলেজ কিন্তু মুখরিত হয়ে উঠেছিল। বড়দের লজ্জা দিয়ে বাচ্চারা মাস্ক মুখে রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দলে দলে ক্যাম্পাস ভরিয়ে ফেলেছিল। প্রমাণ হয়ে গেল, কোমলমতি শিশুরা যে কোনো বৈরিতাকে অবলীলায় বশ করতে পারে; যা বয়স্করা সহজে পারে না।
এসএসসি পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ২২ লাখের বেশি পরীক্ষার্থী এতে অংশ নিয়েছে। আট মাস পর অনুষ্ঠিত হয়েছে এ পরীক্ষা। সামনের বছরেও বিলম্ব হবে বলে মনে হচ্ছে। ঝরে পড়ার সংখ্যা নিয়ে হিসাব-নিকাশ চলছে। নিবন্ধিত ছাত্রছাত্রীর তুলনায় অবতীর্ণ পরীক্ষার্থীর সংখ্যায় সব সময় একটা গরমিল ধরা পড়ে। মহামারি এখানে নির্ণায়ক কোনো ভূমিকা রেখেছে কিনা, এখনই বলা যাবে না; তবুও বলতে হবে-উপস্থিতি মোটামুটি সন্তোষজনক।
ফলাফল প্রকাশ হবে এক মাসের মধ্যে। প্রস্তুতি চলছে জোর কদমে। সিলেবাস সংক্ষিপ্ত। সময় অর্ধেক। বিষয় কম। পরিবেশটা একদম অন্যরকম। কিন্তু সশরীর পরীক্ষা তো বটেই। কাজেই এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠানে আর কোনো সংশয় নেই। পরীক্ষা হবে মৌখিক নির্দেশনায়। আগের ছাপানো প্রশ্নপত্রে। পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব অনেক। নির্ধারিত সময়ের সাত মাস পর অনুষ্ঠিত হচ্ছে এ পরীক্ষা। পরীক্ষার আকার ও গঠন একই ধাঁচে সংক্ষিপ্ত।
পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের গলায় তাই আত্মবিশ্বাসের সুর। ১৪ লাখেরও বেশি পরীক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে। ছাত্রজীবনের গুরুত্বপূর্ণ এক সন্ধিক্ষণে গোটা বিশ্ব যখন করোনা তাণ্ডবে তছনছ, এমনই এক বিভ্রান্ত সময়ে পূর্ববর্তী ফলাফল ম্যাপিং করে শিক্ষার্থীদের পাস করানো হয়েছিল। ফলাফল কী হয়েছিল, তা আমরা জানি। কী নির্মমই না ছিল! বিচিত্র সমালোচনার বিষাক্ত দংশন। রাজনীতির কারবারিরা একটুও ভাবেনি-কাদের নিয়ে তারা এ খেলা খেলছে? কী বিকল্পই বা ছিল হাতে? এবার সেই অপ্রীতিকর পরিস্থিতি অন্তত এড়ানো গেছে, এ কথা এখন বলা যাচ্ছে।
এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সাধারণভাবে জনসংখ্যার বড় একটা অংশের পরিচয় আছে। শুধু শিক্ষার্থীর পরিবার নয়, প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে নানা শ্রেণির মানুষ এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। বিশেষ করে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা তৈরির জন্য এ পরীক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। গত বছর পরীক্ষা না হওয়া এবং সে পটভূমিতে এবারেও পরীক্ষা নিয়ে তীব্র অনিশ্চয়তা থাকায় শিক্ষার্থী-অভিভাবক শুধু নয়, বৃহৎ জনগোষ্ঠীর তীব্র কৌতূহলের কেন্দ্রে থেকেছে এ পরীক্ষা।
করোনা এমনভাবে জীবনকে থামিয়ে দিয়েছিল, যা শতবর্ষে ঘটেনি। জীবন ও সম্ভাবনা কার্যত বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। অনেক দেশ এখনো শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতেই পারেনি। বাংলাদেশ তা পেরেছে। শিক্ষার বন্ধ দরজা খুলে দেওয়ার উদ্যোগ তাই খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আগেই বলেছি, পরীক্ষার আয়তন স্বাভাবিকের তুলনায় অর্ধেক। নম্বর-বিষয়-সিলেবাস সবই সংকুচিত।
যেসব বিষয়ে একসঙ্গে অনেক শিক্ষার্থী জড়ো হতে পারে, অভিভাবক ভিড় জমাতে পারে-সেগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে। আর এ কথাও ভুললে চলবে না যে, এ ধরনের পরীক্ষা যাতে সশরীরে অনুষ্ঠিত হয়, সে জন্য জনমানসে একটা চাহিদাও তৈরি হয়েছিল। ‘অটোপাশ’ শব্দটি নিয়ে যে বিরূপ সমালোচনা শিক্ষার্থীদের মনোজগৎ তোলপাড় করেছিল, এ উদ্যোগ অন্তত তাকে সামলে দেবে।
করোনা আক্রান্ত ১৯০টি দেশের মধ্যে ১৪১টিতে শিক্ষা কার্যক্রম ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। ১৬০ কোটি শিশু ঝরে গেছে, এমন কথা বলছে ইউনিসেফ। শুধু অনুজীব নয়, চলেছে নিরক্ষরতার সংক্রমণ দেড় বছর ধরে। এখন ক্ষত মেরামত করতে এগিয়ে আসতে হবে সমাজকে। স্কুল-কলেজ খোলার সিদ্ধান্তকে সবাই খোলামনে স্বাগত জানিয়েছে। বিশ্ব স্থাস্থ্য সংস্থাও বলছে সঠিক পদক্ষেপ।
ইউনিসেফের সমীক্ষায় দেখা গেছে, শিশুদের ভবিষ্যৎ আয়ের নিরিখে ক্ষতির পরিমাণ ১০ লাখ কোটি মার্কিন ডলারের সমান। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষতি এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ছাত্রপ্রতি মাসিক তিন হাজার টাকা। দারিদ্র্যের আকার বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় গরিব মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে শিক্ষায় বিমুখ হবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। শুধু পাঠ্য নয়, দেহ-মনের সুস্থতাও প্রয়োজন; যা কেবল আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কাঠামোই দিতে পারে।
শিক্ষার মুক্তধারা যেন রুদ্ধ হয়ে না পড়ে, সেদিকে নজর দিতে হবে। ভাষা-বিজ্ঞান-গণিতের বিষয়গত সামর্থ্য যতটা জরুরি, ততটাই প্রয়োজন সমাজকে জানা, আবেগকে চেনা। প্রকৃতি-বন্ধু-খেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের ঘরে নিভৃত জগতে শিশু হয়তো বন্দি হয়ে পড়েছিল। কেউ হয়তো বিষণ্ন, কেউ একাকিত্বের অন্ধগলিতে পথহারা, কেউবা অপরাধের পথে পা বাড়িয়ে দিয়েছিল। আসলে কয়েক কোটি নিষ্পাপ মানব সন্তানের শৈশব কার্যত কেড়েই নেওয়া হয়েছিল।
কলেজ খুললে দেখেছি, ছাত্রছাত্রীদের বাঁধভাঙা আনন্দের জোয়ার। ক্লাসরুমে নজিরবিহীন প্রাণচাঞ্চল্য, যা অনেকদিন দেখিনি। এরপরও বলতে হবে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রচুর কাজ করেছে। গবেষণা করেছে। সত্যিই সেখানে সদিচ্ছা ছিল। বরং মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা হিমশিম খেয়েছে। তবে এ কথাও মানতে হবে, কিছু বিষয় হয়েছে দায়সারা। বিশেষ করে একের পর এক নির্দেশনা। সঙ্গে রুটিন সংশোধনী। ফলোআপ করার আগ্রহ কম। তবুও বলতে হবে, করোনাকালে অনেক চিন্তাভাবনা হয়েছে। সংকট মুহূর্তই সৃষ্টি ও উদ্ভাবনের উত্তম ক্ষেত্র-উইনস্টন চার্চিলের এ অমোঘ উক্তির যেন সার্থকতা খুঁজে পাওয়া গেছে করোনা বিধ্বস্ত অসুস্থ এ সময়ে।
মহামারি দেখিয়েছে, বৈষম্য দূর করার জন্য রাষ্ট্রের সদিচ্ছা থাকলে প্রযুক্তি বাহন হতে পারে। বিভক্তি নয়, মানসম্পন্ন শিক্ষার অংশীদারত্ব নিতে পারে প্রান্তিক শিক্ষার্থী। শিক্ষা কারিকুলামও ভাবনা চিন্তার টেবিলে এসেছে। যুগের প্রয়োজনে কীভাবে শিক্ষক ও শিক্ষার পরিবেশকে বদলে ফেলতে হয়, তার হয়তো অনেকটা ইঙ্গিতও মিলেছে। শিক্ষার উপকরণও গুণগতভাবে পালটে যাচ্ছে। অনলাইন ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট, ভার্চুয়াল সভা, কো-কারিকুলার কার্যক্রম, প্রকৃতির স্পর্শে শিক্ষা, শিষ্টাচার, পরিচ্ছন্নতা-অনেক কিছুই করোনাকালের শিক্ষা।
তবে ইউরোপ-আফ্রিকায় করোনার যে স্ট্রেন নতুন করে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে, তা শিক্ষার আঙ্গিনায়ও প্রভাব ফেলছে। যে উদ্দীপনার স্রোত বয়ে যাচ্ছিল, তাতে খানিকটা ভাটা পড়েছে বলেই মনে হয়। তবে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, মানুষের প্রবৃত্তিগত স্বার্থপরতাই এ নতুন সংক্রমণের জন্য দায়ী। উন্নত দেশগুলো ভ্যাকসিন কূটনীতিতে যে বৈষম্যের জাল বুনেছিল, তারই প্রতিফলন ঘটেছে ভ্যাকসিন না পাওয়া দরিদ্র জনপদে।
আবার প্রমাণ হয়েছে কোনো মানুষ একা সুস্থ থাকতে পারে না। অন্যকে ভালো রাখার মাঝেই নিজের ভালো থাকার গোপন রহস্যটি লুকিয়ে থাকে-তা ভুলে গেলে সভ্যতার বিপন্নতাকেই ডেকে আনা হয়। করোনার নতুন এ ভ্যারিয়েন্টের নাম ওমিক্রন। শোনা যাচ্ছে, সদ্য প্রচলিত ভ্যাকসিন এ বিবর্তিত প্রজাতির বিরুদ্ধে ততটা কার্যকর নয়। অন্যদিকে এর সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষমতাও অনেক বেশি।
সুতরাং, সম্ভাবনার রোদে ঝলমল আকাশে শঙ্কার মেঘ উঁকি দিতে শুরু করেছে। আমাদের প্রথম চাওয়া হবে, অর্জিত অভিজ্ঞতার সুবিধা নিয়ে আমরা যেন আগ্রাসী ওমিক্রনকে রুখে দিতে পারি। সে জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার সচেতনতা; আচরণে, দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন। দেখেছি, শিশুরা সাবধান থাকছে শতভাগ। মাস্ক পরছে। বিধি মানছে। ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্য লম্বা লাইনে অপেক্ষা করছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। পরীক্ষার আগেই এ দুষ্প্রাপ্য ভ্যাকসিন তৃণমূলে পৌঁছে গেছে অবিশ্বাস্য গতিতে। এ স্মার্ট পদক্ষেপের জন্য কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই ধন্যবাদ দাবি করতে পারে।
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের জন্য জাতিসংঘ বাংলাদেশকে অনুমতি দিয়েছে। উন্নত বিশ্বে দক্ষ জনবলের উপচেপড়া চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। সম্ভাবনা দেশকে হাতছানি দিচ্ছে। এখন দরকার নতুন বিশ্বব্যবস্থার উপযোগী হয়ে গড়ে ওঠার প্রস্তুতি। সেখানে প্রয়োজন হবে প্রযুক্তি। চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষা। মানসিক গড়ন, দৃষ্টিভঙ্গি। অবশ্যই আমরা আবহমান সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ধর্মীয় মূল্যবোধ-সবকিছুকে গুরুত্ব দেব।
কিন্তু মানসম্মত শিক্ষা, জ্ঞান ও দক্ষতা যদি আমরা অর্জন করতে না পারি, তবে আমরা গরিব হয়ে পড়ব। আমাদের অগ্রগতি অনেক; কিন্তু তাকে টেকসই করতে গেলে অবশ্যই আমাদের শিক্ষা নিয়ে আরও ভাবতে হবে। এ মুহূর্তে শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা যাবে না। শিক্ষাকে মূলধারায় ফিরিয়ে আনা সময়ের প্রথম অগ্রাধিকার। করোনাকালে উদ্ভূত শিক্ষালাভের কাঠামোগত বৈষম্য বহু শিক্ষার্থীর জীবনপথ বদলে দিয়েছিল।
সমাজ প্রাকৃতিকভাবেই সমতাভিত্তিক নয়; কিন্তু শিক্ষার সমতা সব অসাম্য দূর করবে-এমন প্রত্যাশা আমাদের। মহামারি যেন একটা প্রজন্মের ভবিষ্যৎ ছিনিয়ে নিতে না পারে, তা পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব নিশ্চয়ই শিক্ষাব্যবস্থাকেই নিতে হবে। বিশ্বাস করি, সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে শিক্ষা আবার সংযুক্ত হবে নিজস্ব কক্ষপথে। দেশ এগিয়ে যাবে সমৃদ্ধির পথে।
অমিত রায় চৌধুরী : সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ