এ বছরের এপ্রিলে সারাদেশকে নাড়া দেন নুসরাত নামে মাদ্রাসায় পড়া এক তরুণী। ধর্ষণ-নির্যাতন তো অনেকই হয় কিন্তু নুসরাত অনন্য। নুসরাতকে বলা হচ্ছে বহ্নিশিখা। আমরা বলছি, নুসরাত এক বহ্নিশিখা। পহেলা বৈশাখের ঠিক আগে আগে এই নারীটি তার মাদ্রাসা অধ্যক্ষের যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ করেন। থানায় মামলা করেন। এই ‘অপরাধে’ তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয় অধ্যক্ষের লোকেরা। কয়েকদিন হাসপাতালে যুদ্ধ করে অবশেষে মারা যান নুসরাত। কিন্তু এই মৃত্যু শোকের চেয়েও বেশি বয়ে আনে দ্রোহ আর ক্ষোভ। সারাদেশেই বিক্ষোভ হয়। এর ফলে নুসরাতের খুনিদের বিচারের রায় দ্রুত হয়।
বরিশালে মিন্নি নামে এক তরুণীর স্বামীকে তার সামনেই কুপিয়ে মারা হয়। স্বামী রিফাত শরীফকে খুন হতে দেখে সে। আজব প্রশাসন এক সময় আসল ঘটনা আড়াল করে মিন্নিকেই গ্রেপ্তার করে। বছর শেষে এসব খবরের সঙ্গে যুক্ত হয় গত বছর বনানীর একটি হোটেলে দুই নারীকে ধর্ষণ করা আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলের বিদেশ যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা নেই এই খবরটি।
তো কেমন গেল পুরো বছর নারীর জন্য? গণমাধ্যম ও গবেষণা সংস্থার তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক হাজার ৩৫১ জন নারী, যাদের মধ্যে ৩০৮ জনই গণধর্ষণের শিকার। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৬৬ জনকে, ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ১০ জন এবং ধর্ষণচেষ্টার শিকার ২১১ জন।
এই সময়ে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন ২৩৬ জন এবং স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন ১৯৫ জন নারী। এই ১১ মাসে ৪১ জন শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। বলাই বাহুল্য, এই পরিসংখ্যান শুধু রিপোর্টেড এবং আলোচিত সংবাদের ভিত্তিতে করা। রিপোর্টেড হয় না এ রকম ধর্ষণ এবং নির্যাতনের খবর আরও কতশত হাজার আছে তার কোনো ঠিক নেই। নারীকে ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা এবং নানান নিপীড়নের পাশাপাশি বছরজুড়ে ট্রেন্ড ছিল নারীর প্রতি ভার্চুয়াল সন্ত্রাস। ভার্চুয়াল ধর্ষণ নিপীড়নের শিকার হয়েছেন নারীরা।
অভিনেত্রী মিথিলার সঙ্গে পরিচালক ফাহমির কিছু ছবিকে অন্তরঙ্গ নাম দিয়ে তা নিয়ে মিথিলার প্রতি ভার্চুয়াল ধর্ষণ চালায় অনলাইনে সব বয়সের পুরুষ। সমাজ নির্মিত নারীর সতীত্ব এবং চরিত্র বিষয়গুলোকে পুরুষরা এই ২০১৯ সালে এসে যেন আরও ভালোভাবে রপ্ত করেছে। নারী অধিকার এবং উন্নয়নের অনেক অনেক পরিসংখ্যান এবং সরকারি হিসাব সামনে এলেও নারীকে মানুষ হিসেবে দেখার যে চোখটি সেটি তৈরি হয়নি। তাই নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিটি বিষয়কে জায়েজ করতে দেখা গেছে ভিকটিম ব্লেমিং করে। নারী ধর্ষণের শিকার হলে তার পোশাকের দোষ হয়েছে অথবা চলাফেরা বা আচরণের। নারীর সামান্য প্রতিবাদকেও পুরুষরা গ্রহণ করতে পারল না। এ বছর ‘গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না’ নামে একটি মুভমেন্ট হলো।
বিজেনস নামে একটা অনলাইন বিক্রেতা গ্রুপ টি-শার্ট তৈরি করে। টি-শার্ট পরা মডেলের ছবি আর টি-শার্টের কথা সবই এত ইননোভেটিভ আর শক্তিশালী ছিল যে, পুরুষরা ক্ষেপে উঠল। টি-শার্টে লেখা ছিল বাসে গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না। এর পর শুরু হলো কুৎসিত আক্রমণ। ধর্ষণকামী পুরুষরা শুধু গা ঘেঁষে দাঁড়ানো তো বটেই, পারলে আরও যা যা কিছু করা সম্ভব নারীর সঙ্গে সব করে ফেলতে চাইল। সোশ্যাল মিডিয়া ভেসে গেল পুরুষদের ধর্ষণকামের ইচ্ছায়। অথচ কি সাধারণ একটা মেসেজ। গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না। নারীবাদীরা বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করে জানালেন। সাধারণ অগুনতি মেয়ে মুভমেন্টটাকে সাপোর্ট করলেন। বললেন যে, গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না মানে হলো বাসে, গণপরিবহনে যৌন হয়রানি করবেন না। ব্যস এটুকুই।
কিন্তু এটা পুরুষরা গ্রহণ করতে পারলেন না। মনে হলো, এটা সব পুরুষকে বলা হয়েছে। এভাবে বছরজুড়েই নারীর প্রতি নানান মাত্রার সহিংসতা আর নিপীড়নকে পুরুষরা এবং কখনো কখনো পুরুষতান্ত্রিক নারীরা জায়েজ করে গেছেন। নারীর জন্য অর্জন ছিল খেলাধুলায়। সমাজের নানান প্রতিবন্ধকতা ঠেলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীরা বিভিন্ন গেমসে সাফল্য দেখিয়েছেন। ক্রিকেটে জিতেছেন ম্যাচ। কিন্তু সব মিলিয়ে বলা যায়, নারীর চলার পথের জন্য যত রকম ব্যবস্থাই করা হোক না কেন, পুরুষের মন এবং মনন না বদলানোর কারণে আবারও একটা হতাশাজনক বছরই কাটাল নারীরা।