করোনা মহামারীতে চলমান প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর আওতায় ঋণ বিতরণের গতি ধীর হয়ে পড়েছে। এতদিন ছোটদের প্যাকেজের ঋণ বিতরণ গতিহীন থাকলেও এবার বড়দের প্যাকজেও একই ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, দ্বিতীয় পর্যায়ে বাস্তবায়নাধীন বড় শিল্প ও সেবা খাতের ৩৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ তহবিল থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র সাড়ে ২৭ শতাংশ বিতরণ করতে সক্ষম হয়েছে ব্যাংকগুলো। একই সময়ে ছোটদের (সিএমএসএমই) ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে ঋণ বিতরণের হার সাড়ে ২৪ শতাংশ। কৃষি খাতের ৩ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে ঋণ বিতরণের হার মাত্র সাড়ে ১২ শতাংশ। অন্যদিকে গত বছর চালু হওয়া পর্যটন খাতের হোটেল, মোটেল, থিম পার্কের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য গঠিত এক হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে কোনো ঋণই বিতরণ হয়নি। এর বাইরে প্রথম মেয়াদে চলমান প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট স্কিমের ঋণ বিতরণের হার মাত্র ১০ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, প্রথম পর্যায়ে বিতরণ করা ঋণের একটি অংশ এখনো আদায় করতে পারেনি ব্যাংকগুলো। ফলে ব্যাংকগুলোর মধ্যে ঋণ বিতরণে কিছুটা অনীহা রয়েছে। আবার উদ্যোক্তাদের দিক থেকেও ঋণের চাহিদা কম। সব মিলে ঋণ বিতরণে ধীরগতি চলছে। করোনার ক্ষতি মোকাবিলায় বিভিন্ন খাতে এ পর্যন্ত ২৮টি প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। এসব প্যাকেজের আর্থিক মূল্য ১ লাখ ৯১ হাজার ৯১৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১০টি প্যাকেজ বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
গত দেড় বছরে এসব প্যাকেজের আওতায় সুবিধাভোগী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখ ৮৭ হাজার ৯৬২। যার মধ্যে ৭২ লাখ ৮২ হাজার ২৫৩ জন সুদ ভর্তুকি সুবিধা পেয়েছেন। আর গার্মেন্ট খাতে বেতন-ভাতার সুবিধা নিয়েছেন ৩৭ লাখ ৭৮ হাজার ৯৬৯ জন। এ দুটো প্যাকেজের সুবিধা বাদ দিলে অন্য ৮টি ঋণ প্যাকেজের সুবিধাভোগী মাত্র ১০ লাখ ২৬ হাজার ৭৪০ জন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, এবার প্রণোদনার ঋণের চাহিদা কম মনে হচ্ছে। এ কারণে বড়দের প্যাকেজের ঋণ বিতরণও কম। ব্যাংকগুলোর দিক থেকে কোনো অনীহা আছে কিনা সেটা বলা মুশকিল। তবে এ ধরনের অভিযোগ এলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা ১০টি প্যাকেজের মধ্যে তিনটির প্রথম পর্যায়ের মেয়াদ গত বছরের জুনে শেষ হওয়ার পর একই বছরের জুলাই থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ে বাস্তবায়ন শুরু হয়। এ প্যাকেজগুলো হলো বড় শিল্প ও সেবা খাতের ৩৩ হাজার কোটি টাকা, কুটির অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) খাতে ২০ হাজার কোটি টাকা এবং কৃষি খাতে ৩ হাজার কোটি টাকা। আর রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন ভাতার ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল ওই সময়েই শতভাগ বাস্তবায়ন হয়। এর সুবিধা নেন ৩৭ লাখ ৭৮ হাজার ৯৬৯ জন, যার মধ্যে ২০ লাখ ১৫ হাজার ৬৪০ জনই নারী। করোনার কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ২০২০ সালের এপ্রিল ও মে মাসের ঋণের বিপরীতে সুদ ভর্তুকির ২ হাজার কোটি টাকার তহবিলের চাহিদা অনুযায়ী ১ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা বিতরণ হয়েছে। এ সুদ ভর্তুকির সুবিধা নিয়েছেন ৭২ লাখ ৮২ হাজার ২৫৩ জন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, দি¦তীয় পর্যায়ে বাস্তবায়নাধীন বড় শিল্প ও সেবা খাতের গ্রাহকদের জন্য ৩৩ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বিতরণ হয়েছে ৯ হাজার ১৩০ কোটি টাকা, যা মোট তহবিলের ২৭.৬৬ শতাংশ। দেশের ৯১৭টি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে চার শতাংশ সুদে দেওয়া হয়েছে এ ঋণ সুবিধা। তিন বছর মেয়াদি এ তহবিল থেকে গত বছরের জুন পর্যন্ত প্রথম পর্যায়ে তিন হাজার ৩০৬টি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয় ৩২ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৮১.৮৬ শতাংশ।
দ্বিতীয় মেয়াদের সিএমএসএমই শিল্প খাতের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩২ হাজার ২৩১টি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয় চার হাজার ৯২৭ কোটি টাকা বা ২৪.৬৪ শতাংশ। প্রথম পর্যায়ে ৯৭ হাজার ৮১৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৫ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা বা ৭৬.৯৩ শতাংশ ঋণ বিতরণ করা হয়। আবার কৃষি খাতে ব্যাংকগুলোর পুনঃঅর্থায়নে তিন হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে মাত্র ৩৭৯ কোটি টাকা বা ১২.৬৩ শতাংশ বিতরণ হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে বিতরণ হয়েছিল চার হাজার ২৯৫ কোটি টাকা বা ৮৪.৬৬ শতাংশ।
নিম্ন আয়ের পেশাজীবী, প্রান্তি কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের এনজিওর মাধ্যমে বিতরণের জন্য তিন হাজার কোটি টাকার তহবিলের গঠন করা হয়। গত দেড় বছরে (ডিসেম্বর পর্যন্ত) বিতরণ হয়েছে দুই হাজার ৪৯২ কোটি টাকা। চার লাখ ৯১ হাজার ৩৮২ জনের মধ্যে ৯ শতাংশ সুদে দেওয়া হয়েছে এ ঋণ। আবার প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট খাতে পাঁচ শতাংশ সুদের পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে ৬৭টি প্রতিষ্ঠান নিয়েছে মাত্র ৫১৩ কোটি টাকা বা ১০.২৭ শতাংশ। বিভিন্ন কঠোর শর্তের কারণে এ তহবিলের ঋণে অনীহা রয়েছে উদ্যোক্তাদের।
এদিকে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল ঋণের বিতরণের গতি বেশ ভালো। প্রায় ২১ হাজার ২৫০ কোটি টাকার তহবিলের প্রায় শতভাগ বিতরণ হয়ে গেছে। মাত্র দুই শতাংশ সুদে ১০ হাজার ৯১১ গ্রহীতা এ ঋণ পেয়েছেন। অন্যদিকে ছোট ঋণে গ্যারান্টি দিতে দুই হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এখান থেকে ৩১০টি প্রতিষ্ঠানের ৩৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকার গ্যারান্টি ইস্যু হয়েছে। এ ছাড়া গত বছরে পর্যটন খাতের হোটেল, মোটেল, থিম পার্কের কর্মচারীদের বেতন ভাতা পরিশোধে হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে। এখান থেকে মাত্র চার শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ হবে। বাকি চার শতাংশ ভর্তুকি দেবে সরকার। কিন্তু এ তহবিল থেকে এখন পর্যন্ত কোনো ঋণ বিতরণ হয়নি।