করোনা মহামারীর কারণে ব্যাংকের মতো নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতেও বিভিন্ন ছাড় চলমান। তারপরও এ খাতে ব্যাপকভাবে বেড়েছে খেলাপি ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১ সালের প্রথম নয় মাসে এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা। মূলত নানা অনিয়ম ও জালিয়াতির কারণে এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল নজরদারির কারণে এ খাতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে নামে-বেনামে বের করে নেওয়া হয়েছে প্রচুর অর্থ, যা ফেরত আসেনি। আবার গ্রাহকের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না অনেক প্রতিষ্ঠান।
সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ত্রৈমাসিক আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর শেষে নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ৭৫৭ কোটি টাকা, যা ওই সময় পর্যন্ত বিতরণ করা ঋণের ১৭.৬২ শতাংশ। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে এ খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ১০ হাজার ৫৩ কোটি টাকা বা ১৫.০২ শতাংশ। অর্থাৎ নয় মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা। প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, ২০১৯ সাল এ খাতে খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ছয় হাজার ৪৪১ কোটি টাকা বা ৯ শতাংশ। অর্থাৎ দুই বছরেরও কম সময় এ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৫ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা।
জানা যায়, বর্তমানে হাতেগোনা কয়েকটি বাদে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেরই নাজুক অবস্থা। নানা অনিয়মে বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সময়মতো অর্থ ফেরত পাচ্ছেন না গ্রাহক। শুধু গ্রাহকই নয়, ব্যাংক বা বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান টাকা রাখলেও তা যথাসময়ে তাদের ফেরত দিতে পারছে না অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট আমানত দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ৯৪১ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে আমানতের পরিমাণ ছিল ৪৩ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা। আমানত কমেছে ৫৩২ কোটি টাকা। আর গত বছরের ডিসেম্বর শেষে আমানতের পরিমাণ ছিল ৪৩ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত কমার পাশাপাশি ঋণ স্থিতি বাড়ছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। সেপ্টেম্বর শেষে বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ৫৬ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে পরিমাণ ছিল ৫৫ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা।
গত কয়েক বছর বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ঋণের নামে প্রচুর অর্থ বের করার ঘটনা ঘটেছে। এ কারণে এ খাতের আর্থিক ভিত অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। ২০১৯ সালে পিপলস লিজিং অবসায়নের উদ্যোগের পর এ খাতের অবস্থা বেশি খারাপ হয়েছে। এর কিছুদিনের মধ্যে আবার এনআরবি গ্লোবাল ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার হালদারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দখল করে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের বিষয়টি সামনে আসে। এ ছাড়া ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও বিআইএফসিতে চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়েছেন আদালত। অত্যন্ত নাজুক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘রেড জোন’ চিহ্নিত করে বিশেষ তদারকিতে রেখেছে।
এদিকে আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায়, গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ৬১টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণ ১ লাখ ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা, যা ওই সময় পর্যন্ত মোট বিতরণ করা ঋণের ৮.১২ শতাংশ। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে এ খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা বা ৭.৬৬ শতাংশ। অর্থাৎ ২০২১ সালের ৯ মাসের হিসাবে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১২ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা। এই খেলাপি ঋণের বড় অংশই রয়েছে সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের প্রায় অর্ধেকই রয়েছে শীর্ষ ৫ ব্যাংকে। বাকি ৫৬টি ব্যাংকে রয়েছে ৫৬ হাজার কোটি টাকা। তবে মোট খেলাপি ঋণের মধ্যে শীর্ষ ১০টি ব্যাংকে রয়েছে ৬৩ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৫১টি ব্যাংকে রয়েছে ৩৮ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের কারণে এসব ব্যাংকের মোটা অঙ্কের অর্থ প্রভিশন খাতে আটকে রয়েছে। এর বিপরীতে মূলধন ঘাটতিও রয়েছে। সব মিলে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকির মাত্রা বেড়েছে।