কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ব্যাংকের নিট মুনাফা কমে যাচ্ছে। বিদায়ী বছরে গ্রাহকের বকেয়া ঋণের ১৫ শতাংশ আদায় করে ঋণ অশ্রেণী বা খেলাপিমুক্ত করায় সমুদয় বকেয়া ঋণের ওপর দুই শতাংশ বাড়তি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। আর এ বাড়তি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়েই বেশির ভাগ ব্যাংকের আগের বছরের চেয়ে প্রকৃত মুনাফা কমে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা। আর প্রকৃত মুনাফা কমে গেলে শেয়ারহোল্ডারদের বছর শেষে আয় কমে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দুই বছর ধরে ব্যাংকের ঋণ আদায়ের ওপর ছাড় দেয়া হয়। বলা হয়, কোনো গ্রাহক ঋণ পরিশোধ না করলেও ওই ঋণকে খেলাপি করা যাবে না। এ নির্দেশনা কয়েক দফা বাড়িয়ে গত বছরের জুন পর্যন্ত টেনে আনা হয়। এরপর ঋণ আদায়ের শিথিলতা আস্তে আস্তে তুলে আনা হয়। সর্বশেষ বলা হয়, গত বছরের বকেয়া ঋণের ওপর কেউ ১৫ শতাংশ পরিশোধ করলে ওই ঋণ নিয়মিত হিসাবে দেখাতে পারবে ব্যাংক। অর্থাৎ গ্রাহক ৮৫ শতাংশ পরিশোধ না করলেও বকেয়া ঋণ খেলাপি করা যাবে না। নিয়মিত হিসাবে দেখাতে পারবে ব্যাংকগুলো। এতে প্রাথমিকভাবে অনেক ব্যাংকারই খুশি হয়েছিলেন। ভেবেছিলেন এবারও ঋণ আদায় না করেই আয় দেখাতে পারবেন। কিন্তু এ সুবিধা নিতে গেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে শর্ত আরোপ করেছে তা বিশ্লেষণ করে ও পরিপালন করতে গিয়ে হতাশ হন তারা।
এ বিষয়ে একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, ঋণ আদায়ের শিথিলতার ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সর্বশেষ যে নীতিমালা দিয়েছিল তাতে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ ছিল, যেসব ব্যাংক যে পরিমাণ ঋণ শিথিলতার আওতায় অশ্রেণীভুক্ত করবে তার বিপরীতে ১ শতাংশ সাধারণ প্রভিশনের সাথে বকেয়া ঋণের ওপর বাড়তি দুই শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হবে। আর এ বাড়তি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়েই কমে যাচ্ছে নিট আয়। কারণ হিসেবে ওই ব্যাংকার জানিয়েছেন, ব্যাংক গ্রাহকের কাছ থেকে যে পরিমাণ ঋণ আদায় করে তা থেকে প্রথমেই ওই বছরের প্রদেয় ঋণের ওপর মুনাফা সমন্বয় করে। বকেয়া কিস্তির ওপর ১৫ শতাংশ আদায় করলেই পুরো ঋণই নিয়মিত হয়ে যাবে। এ থেকে প্রথমেই মুনাফা সমন্বয় করা হবে। বাকি যে অর্থ বকেয়া থাকবে তার পুরোটার ওপরই ১ শতাংশ জেনারেল প্রভিশনের সাথে বাড়তি দুই শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। পরিচালন মুনাফা থেকে সরকারকে সাড়ে ৩৭ শতাংশ করপোরেট ট্যাক্স পরিশোধ করার পর অবশিষ্ট মুনাফা দিয়ে বর্ধিত প্রভিশন সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। এভাবে অনেক ব্যাংকের নিট মুনাফা গত বছরের চেয়ে কমে যাচ্ছে। কোনো কোনো ব্যাংকের মুনাফার পরিবর্তে নিট লোকসান হচ্ছে। এমনি পরিস্থিতিতে বেশির ভাগ ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপকরা নিট মুনাফার হিসাব চূড়ান্ত করতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা।
অপর আরেকটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। পরিচালন ব্যয় বড় করে দেখানো হলেও চূড়ান্ত হিসাবে এসে নিট মুনাফা থাকছে না। বরং নিট লোকসানের মুখে পড়ছেন। ফলে তারা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন কিভাবে শেয়ারহোল্ডারদের ডিভিডেন্ড দেবেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা শিথিলের সুযোগ নিয়ে গত বছর বেশির ভাগ ব্যাংক ভালো মুনাফা দিয়েছিল। প্রকৃত মুনাফা না করেও ব্যাংকগুলো নীতিমালার কারণে বাড়তি মুনাফা দেখিয়েছিল। ব্যাংকগুলোর আর্থিক ভিত্তি শক্তিশালী রাখতেই এবার নীতিমালায় কড়াকড়ি করা হয়েছে। বলা হয়েছে, মূলধন শক্তিশালী অবস্থানে রাখার জন্যই বাড়তি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে বলা হয়েছে। একই সাথে রিটেইন আর্নিংস অর্থাৎ রিজার্ভ তহবিল বাড়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা শতভাগ পরিপালনে কোনো ছাড় দেয়া হবে না। এতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের মূলধনভিত্তি শক্তিশালী হবে বলে ওই সূত্র জানিয়েছে।