গত মৌসুমে এ সময় প্রতি মণ লবণ বিক্রি করে চাষিরা যেখানে লোকসান গুনেছেন ১০০ টাকা থেকে ১১০ টাকা সেখানে চলতি মৌসুমে সব খরচ মিটিয়ে তাদের পকেটে আসছে প্রতি মণে ৬০ টাকা। শুক্রবার প্রতি মণ লবণ বিক্রি হয়েছে ৩৪০ টাকায়। উৎপাদন খরচ গড়ে ২৫০ টাকা এবং ধোলাই খরচ ৩০ টাকা চুকিয়ে এই টাকা পকেটে ঢোকায় উপকূলের হাজার হাজার চাষির মুখে খুশির ঝিলিক দেখা দিয়েছে। একই কারণে এবার লবণ চাষের পরিধি যেমন বাড়ছে তেমনি আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রত্যাশা করছেন বিসিক লবণ প্রকল্পের কর্মকর্তারা।
চলতি মৌসুমে ২৩ লাখ ৫৬ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে মাঠে ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। এদিকে গত মৌসুমের ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত যে লবণ উৎপাদন হয়েছে তা ছাড়িয়ে এবার একই সময়ের মধ্যে লবণ উৎপাদন হয়েছে এক লাখ ১১ হাজার মেট্রিক টন।
জানা গেছে, ২০২০-২১ মৌসুমে ২২ লাখ ১৭ হাজার মেট্রিক টন লবণ চাহিদার বিপরীতে ৫৪ হাজার ৬৫৪ একর লবণ মাঠে ১৬ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন হয়েছে। বলা যায় গত মৌসুমটি লবণ উৎপাদনের ঘাটতি নিয়েই শেষ হয়।
গত মৌসুমের শুরুতে উদ্বৃত্ত তিন লাখ ৪৮ হাজার মেট্রিক টনসহ বেসরকারিভাবে আমদানি হয়েছে প্রায় আট থেকে ৯ লাখ মেট্রিক টন লবণ। উদ্বৃত্ত থাকায় দেশে লবণের চাহিদার ঘাটতি দেখা দেয়নি।
জানা গেছে, প্রতি বছর নভেম্বরের ১৫ তারিখ থেকে পরের বছরের ১৫ মে পর্যন্ত দেশে লবণ উৎপাদন মৌসুম ধরা হয়। আর দেশে লবণ উৎপাদন হয় সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর নির্ভর করেই।
বাঁশখালী উপজেলার লবণচাষি সনুয়ার মোহাম্মদ বেলাল জানান, শুক্রবার প্রতি মণ ৩৪০ টাকা করে তিনি ১৮৬ মণ ক্রুড (অপরিশোধিত) লবণ পাইকারি বিক্রি করেছেন। সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতি মণে তার লাভ হয়েছে ৬০ টাকা।
এদিকে সমগ্র উপকূলে শুক্রবার (৪ জানুয়ারি) পর্যন্ত ওই দামেই লবণ বিক্রি হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন লবণ প্রকল্পের জেনারেল ম্যানেজার জাফর ইকবাল ভূঁইয়া।
বিগত কয়েক বছর ধরে কস্টিক সোডা উৎপাদনের জন্য সোডিয়াম সালফেটের আড়ালে অতিরিক্ত লাখ লাখ টন সোডিয়াম ক্লোরাইড (ভোজ্য লবণ) আমদানির পাশাপাশি দেশের কয়েক হাজার মিলকারখানায় ব্যবহারের জন্য বন্ড সুবিধার আওতায় অতিরিক্ত সোডিয়াম ক্লোরাইড আমদানি করা হচ্ছিল। আমদানি করা এসব অতিরিক্ত লবণই পরবর্তীতে চলে আসছিল বাজারে। এ কারণে বিগত কয়েক বছর ধরে উপকূলের চাষিরা তাদের উৎপাদিত লবণের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এসব কারণে উৎপাদন খরচের অর্ধেক দামে অসহায় চাষিরা লবণ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছিলেন। বিষয়টি নিয়ে দৈনিক নয়া দিগন্তে একাধিকবার সচিত্র সংবাদ প্রকাশিত হয়।
পরবর্তীতে সরকার ২০২১ সালে লবণশিল্প ও এর সাথে জড়িত হাজার হাজার চাষির স্বার্থ রক্ষায় নামমাত্র সুদে ঋণ দেয়। জনপ্রতি ৫০ হাজার টাকা ঋণ দেয়া হয়। গত বছরে মার্চে বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়সহ ১৬টি মন্ত্রণায়ের প্রতিনিধি সমন্বয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে লবণ শিল্প রক্ষাসহ দেশের স্বার্থ রক্ষায় বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় সোডিয়াম সালফেট (দেশে উৎপাদিত হয় না বিধায়) লিকুইড ফর্মে আমদানির সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া পরবর্তীতে সব ধরনের লবণ আমাদানির শুল্কহার ৩২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮৯ শতাংশ করা হয়।
সরকারের কয়েকটি সফল উদ্যোগের ফলে আমদানিকারকরা অতিরিক্ত লবণ আমদানিতে নিরুৎসাহিত হওয়ার কারণে উপকূলে উৎপাদিত লবণের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় লবণ চাষে প্রাণচাঞ্চল্য এসেছে।
জানা গেছে, উপকূলীয় উপজেলা চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও কক্সবাজার জেলাজুড়েই উৎপাদন হয় দেশের লবণ। গত বছর দেশে লবণ চাহিদা ছিল ২২ লাখ ১৭ হাজার মেট্রিক টন। এবার ২০২১-২২ অর্থবছরে লবণের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৩ লাখ ৫৬ হাজার মেট্রিক টন। বিসিক লবণ প্রকল্প সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বিসিক লবণ প্রকল্পের জেনারেল ম্যানেরজার জাফর ইকবাল ভূঁইয়া জানান, এবার শেষ পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে দেশে লবণ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে বলে প্রত্যাশা করছেন তিনি।